একই সাথে বয়ে চলেছে দুই লড়াই। যেমন বয়ে চলে মিসিসিপি-মিসৌরি বা আমাদের পদ্মা-মেঘনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের বন্দর-নগরী সিয়াটেলেও মিলেমিশে একাকার হয়ে বয়ে চলেছে দু’টি আপাত-দৃষ্টিতে স্বতন্ত্র গণআন্দোলন।
মিনিয়াপোলিসে প্রকাশ্য রাস্তায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম হত্যাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদী ঝড় যখন আছড়ে পড়ছে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে তখন তার তীব্রতম অভিব্যাক্তি অনুভূত হচ্ছে সিয়াটেল অঞ্চলেই। আবার, অতিমারী মোকাবিলায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ চিকিৎসা-ব্যবস্থা ও সংকটে জর্জরিত কর্পোরেট স্বার্থবাহী অর্থনীতির বিরোধিতাতেও আমরা সম্মুখ সমরে দেখতে পাই মার্কিন মুলুকের এই প্রখ্যাত শহরকেই। এখানে আজ একই খাতে প্রবাহিত হচ্ছে বর্ণ-বৈষম্য ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, রেসিজম ও ক্যাপিট্যালিজম, দু’ইয়েরই বিরুদ্ধে এক প্রতিস্পর্দ্ধি গণ-উত্থান। পাশাপাশি বয়ে চলা দু’টি নদী যেমন প্রবল প্লাবনে ফুলে-ফেঁপে উঠে, কুল ছাপিয়ে, মিলিয়ে যায় এক অবিচ্ছেদ্দ স্রোতধারায়, সিয়াটেলে তেমনই ঢেউয়ে ঢেউ মিলিয়ে একই ধারায় লীন হয়ে গেছে মানবাধিকারের লড়াই এবং শ্রেণীসংগ্রাম, এই দু’ইয়েরই মহাপ্লাবন।
সিয়াটেলের ইতিহাসেই আছে এই মহামিলনের সক্রিয় উপাদান। সাগর, পাহাড় আর চিরসবুজ জঙ্গলে ঘেরা ওয়াশিংটন রাজ্যের এই বৃহত্তম নগরীর পত্তন হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। ওই শতক জুড়েই, বিশেষ করে ১৮৬৫-১৮৯০ সালে, ঔপনিবেশিক প্রস্পেক্টররা – ইউরোপ থেকে আগত শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীর দল – পুঁজি আহরণের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজে একের পর এক অভিযান চালিয়েছিল – ‘গোল্ড রাশ’ – বিস্তীর্ণ পশ্চিম অঞ্চলে – ‘দ্য ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’। ১৯৩০ থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত অসংখ্য হলিউড ছবিতে প্রতিফলিত হয়েছে এই দুঃসাহসিক অভিযানগুলি – সিনেমার এক অনন্য শিল্পরূপ হিসাবে ছবিগুলির পরিচয় ‘ওয়েস্টার্ন’ নামে। জন ফোর্ডের ‘স্টেজকোচ’ কিংবা ‘মাই ডারলিং ক্লেমেন্টাইন’, জন হাস্টনের ‘মলটিজ ফ্যাল্কন’, হাওয়ার্ড হকসের ‘রেড রিভার’, ফ্রেড জিনেমানের ‘হাই নুন’ এবং আরও অনেক ছবি তো ক্ল্যাসিকের মর্যাদাও অর্জন করেছে। বলা বাহুল্য, ছবিগুলিতে রচিত হয়েছে শ্বেতাঙ্গ বসতিকারীদের জয়গাথা, তাদের বীরত্বের কল্প কাহিনী। যা বলা হয়নি তা হল ওই শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রীরা কী ভয়ংকর হিংসা, অত্যাচার ও হত্যালীলা চালিয়েছিল ওইসব অঞ্চলের জঙ্গলবাসী মানুষজনের ওপর। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম, জঙ্গল সাফ করে, পাহাড় গুঁড়িয়ে দিয়ে, নদী-ঝর্না দূষিত করে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ওই লাল-মুখো মানুষগুলির – রেড ইন্ডিয়ানদের – বেঁচে থাকার রসদ, চিরতরে ধ্বংস করা হয়েছিল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রীতিনীতি, সংস্কৃতি। ডি ব্রাউন রচিত ‘ব্যেরি মাই হার্ট এট উন্ডেড নী’ নামক গবেষনামূলক ইতিহাসের বইতে এর প্রভূত বিবরণ পাওয়া যায়।
দেখা যাচ্ছে, বর্ণ-বিদ্বেষের ওপর দাঁড়িয়েই গড়ে উঠেছিল মার্কিন পুঁজিবাদী সভ্যতা। সেটলার কলোনিয়ালিজম যে বর্ণের আধারেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে তা সিয়াটেলের ইতিহাস ঘাঁটলেই পরিষ্কার হয়ে যায় : দুওয়ামিশরা ছিল এখানকার আদি জনগোষ্ঠী। নগর পত্তনের সাথে শুধু এদের জঙ্গল-জমি ছিনিয়ে নেওয়া হয়নি, বঞ্চিত করা হয়েছিল মানুষের অধিকার থেকেও। এমনকি, ১৮৬৫ সালে সিয়াটেল বোর্ড অফ ট্রাস্টি একটি অর্ডিনান্স পাশ করে শহর-সীমার মধ্যে ইন্ডিয়ানদের বসবাস নিষিদ্ধ করে দেয়। এবং আজ অবধি মার্কিন সরকার সিয়াটেলের আদিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিচিতি স্বীকার করেনি। যদিও সিয়াটেল নামটা রাখা হয়েছিল তৎকালীন দুওয়ামিশ প্রধান সি’আহল-কে স্মরণ করেই।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে শিল্প ও উচ্চ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশের মাধ্যমে দেশে দেশে পুঁজিবাদ আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় এবং পুঁজির বিশ্বায়িত হওয়ার তাড়নায় বেঁধে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এরই সুযোগ নিতে ১৯১৬ সালে সিয়াটেলে চালু হয় বিমান প্রস্তুতকারী শিল্প – কম্পানির নাম বোয়িং। এরই প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম বোয়িং আনুষঙ্গিক কয়েকটি আইন তৈরি করেন যার ফলে অ-শ্বেতাঙ্গদের কাছে শহর ও শহরতলির কোনও রিয়েল এস্টেট বিক্রয় নানান বাধানিষেধের গণ্ডিতে আটকে দেওয়া হয়। বর্ণবাদের যে একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি আছে তা এর থেকেই পরিষ্কার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দু-এক দশক আপাত-স্থিতিশীল থাকলেও পুঁজিবাদের আরও গভীর সংকট ক্রমশ ঘনিয়ে আসতে থাকে। এরই মোকাবিলায় ১৯৯০-এর শুরুতে বিশ্ব জুড়ে চালু করা হয় নয়া-উদারনীতিবাদ। যা আসলে পুঁজিবাদের সবচেয়ে আগ্রাসী, দাঁত-নোখ বার করা, হিংস্র, ধ্বংসাত্মক রূপ। এবং যা পুঁজির সঞ্চয়ন বাড়িয়ে দেয় শত শত গুণ, আপামর সাধারণ মানুষকে নিংড়ে, শুষে, নিঃস্ব করে দিয়ে।
নব্বই দশকের শুরুতেই, নয়া-উদারনীতির হাত ধরে, ঘটে যায় তথ্য-প্রযুক্তি (আইটি) বা ডিজিটাল বিপ্লবও। ঘরে ঘরে পৌঁছয় কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেট, আরও কত কী। এর প্রভাবে ব্যাপকভাবে পালটে যেতে থাকে স্বাভাবিক জীবনযাপন। এই আইটি বা ডিজিটাল বিপ্লবকে পাথেয় করে আসরে নামে একঝাঁক নয়া-পুঁজিপতি, যারা মাত্র দু-আড়াই দশকেই বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নয়া-উদারনীতিবাদ ও ডিজিটাল বিপ্লবের জোট যে অনেকটাই পালটে দিয়েছে পুঁজিবাদের মৌলিক চরিত্রকে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজকের এই ‘নয়া দুনিয়া’-য় সিয়াটেলের গুরুত্ব এইখানেই। একদিকে মার্কিনি পুঁজিপতিদের কাছে তাদের প্রাণের এই শহরটি যেন নয়া-উদারনৈতিক বিশ্বপুঁজির বেস ক্যাম্প, অপরদিকে ডিজিটাল বিপ্লবের কান্ডারীদের এটাই আঁতুড়ঘর, এটাই মুল ঘাঁটি। বিল গেটস্-এর সফটওয়্যার কম্পানি মাইক্রোসফট্ কিংবা জেফ বেজস-এর অনলাইন সার্ভিস প্রোভাইডার আ্যমাজন-এর হেড আপিস তো এই সিয়াটেলেই। এরাই সিয়াটেলের সমৃদ্ধশালী অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক, দুনিয়ার অর্থনীতির স্টিয়ারিংও এদের হাতে। প্রসঙ্গত, গত পাঁচ বছর ধরে দুনিয়ার প্রধান বিত্তশালীদের তালিকায় একেবারে প্রথম স্থানে আছেন বিল গেটস্ ও জেফ বেজস (আ্যমাজনের সমস্ত সম্পদের মূল্য প্রায় $১৪০ বিলিয়ন; করোনা ভাইরাস আগমনের পরে, লকডাউনের জমানাতেও, এদের আয় $৩৩ বিলিয়ন – সূত্রঃ ইন্টারনেট)।
এই নয় যে সাড়ে সাত লক্ষ জনসংখ্যার মেগা-নগরী সিয়াটেল কেবলমাত্র ধনশালী ও পুঁজিবাদীদের শহর। ন্যুনতম অধিকার-বর্জিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এছাড়াও এই শহরাঞ্চলে রয়েছে শিল্পে ও বিভিন্ন সংস্থায় নিয়োজিত সাধারণ মজদুর ও মাইনে-পাওয়া কর্মী, যারাও নানা উপায়ে শোষিত, বঞ্চিত। একেবারে গরিব, সর্বহারা না হলেও, পৃথিবীর বৃহত্তম ধনকুবেরদের নিজেদের জায়গায় এদের আয়ের হিসেব নিলে ভয়ানক অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্রটি পরিষ্কার ফুটে ওঠে। সিয়াটেলে তাই সব সময়েই চলে আসছে পুঁজি ও শ্রমের স্বার্থের সংঘাত। এখানকার র্যাডিক্যাল আ্যকটিভিজমের সূত্রপাত সেখান থেকেই। ১৯১৯ সালে যুক্ত রাষ্ট্রে বিংশ শতাব্দীর প্রথম সাধারণ ধর্মঘট হয়েছিল এ অঞ্চলেই। আবার ১৯৯৯ সালে নয়া-উদারনীতির বিরুদ্ধে জ্বলে উঠে বিশ্ব জুড়ে আন্দোলনের সূচনা করেছিল সিয়াটেলই।
১৯৭০ সালে একদিন ব্ল্যাক প্যান্থার-এর নেতৃত্বে এখানকার ইন্ডিয়ান ও শ্রমজীবী মানুষেরা শহরের সমৃদ্ধশালী এলাকা ম্যাগনোলিয়া দখল করে নেয়। পুলিশ নির্দয় আঘাত হানে কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদীরাই জয়ী হয়। এ ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে গেল জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরে, আরও বিশাল পরিসরে : অন্যান্য শহরের মতো সিয়াটেলেও কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষ চলছিল। ৫ জুন বিক্ষোভকারীরা ক্যাপিটল হিল এলাকায় পুলিশ সদর দপ্তর ঘেরাও করে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ থানা পরিত্যাগ করে চলে যায়। জনতার দখলে চলে যায় ক্যাপিটল হিল। ব্যারিকেডের মুখ ঘুড়িয়ে মুক্ত এলাকাটি পাহারা দিতে থাকে সশস্ত্র যুবকেরা। খোলা রাস্তায়, চত্বরে বক্তৃতার সাথে চলতে থাকে বাচ্চাদের হুটোপুটি, সিনেমা দেখা, গিটারের ঝংকার, গণ-হেঁসেলে রান্না আর একসাথে খাওয়াদাওয়া।
এলাকাটির নাম দেওয়া হয়েছিল : ‘ক্যাপিটল হিল অটোনমাস জোন’ (চ্যাজ)। পরে নাম পালটে হয় : ‘ক্যাপিটল হিল অক্যুপায়েড প্রোটেস্ট’ (চপ)। কোনো একটি পোস্টারে আবার লেখা ছিল : ‘পিপলস রিপাবলিক অফ ক্যাপিটল হিল’। স্লোগান উঠেছিল : ‘নো কপ, কো-অপস’ – ‘পুলিশ নয়, সমবায়’। অর্থাৎ, পুলিশের সাথে নয়া-উদারনৈতিক চেতনার ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকেও বিদায় জানানো, যৌথ জীবনেই খুঁজে নেওয়া মুক্তির স্বাদ। এটাই কি ছিল মার্কসের সমাজতন্ত্র – ‘ফ্রী আ্যসোসিয়েশন অফ ফ্রী ইন্ডিভিজুয়ালস্’!
ডোনাল্ড ট্রাম্প সিয়াটেলের আন্দোলনকারীদের ‘ডোমেস্টিক টেররিস্ট’ আখ্যা দিয়েছেন, মিলিটারী নামিয়ে দমন করার হুমকিও দিয়েছেন। প্রতিবাদীরা অবশ্য পিছিয়ে যাচ্ছেন না, দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তারা বুঝেছেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক লড়াইকে শ্রেণিসংগ্রামের আলোকে পরিচালিত করতে পারলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তরে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া সম্ভব। জাতি-প্রথায় জীর্ণ ভারতবর্ষে আমাদের কি শেখার কিছুই নেই?
-- সুমিত