কোভিড-১৯ গোটা পৃথিবী জুড়ে অনেক কিছুকেই বেআব্রু করে দিয়েছে। নগ্ন করে দিয়েছে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। শাসকের নির্দায় নির্দয় চেহারাটাকে, নৃশংস স্বার্থপরতাকে উন্মোচিত করেছে।
ভারতবর্ষে লকডাউন পর্ব শাসকশ্রেণিকে অনেক সুযোগ করে দিয়েছে, আড়াল তৈরি করে। নির্বিচারে চলছে কর্পোরেট তোষণের জন্য যথেচ্ছ লুঠ তরাজ। বন জঙ্গল হু হু করে সাফ হয়ে যাচ্ছে। চলছে ভূমিপুত্র আদিবাসীদের ঘর-বসতি জ্বালিয়ে দেওয়া। সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের উপর নগ্ন আক্রমণ। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি, অবস্থান, মনোভাব। সরকারের মিথ্যাচার। সরকার যেমন আড়ালের সুযোগ নিয়েছে, সেই আড়ালকে ছিন্ন করে সত্যিটাকে সামনে আনার জন্যও একদল অসমসাহসী মানুষ নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সত্যান্বেষণের দুরূহ দুর্গম উপত্যকায়, দুরারোহ শৃঙ্গচূড়ায় তারা অনুসন্ধানী আলো ফেলে ঘুরে বেড়ান প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। গদি মিডিয়ার বিপরীতে, শাসকের রক্তচক্ষু তথা ইউএপিএ-এর ‘আপ্যায়ন’কে তুচ্ছ করে। তেমনই এক বলিষ্ঠ কলমের প্রথিতযশা সাংবাদিক বরখা দত্ত ‘হিন্দুস্তান টাইমস'-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে সম্প্রতি জানিয়েছেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টে ভারত সরকারের সলিসিটর জেনারেলের অবস্থান ছিল ন্যায়বিরুদ্ধ। সত্য উদ্ঘাটনের সেই কাহিনি তাঁর মরমী কলমেই পড়ুন :
“লকডাউন উচ্চ-মধ্যবিত্তদের সুরক্ষা দিয়েছে। হতদরিদ্র নাগরিকদের ঠেলে দিয়েছে প্রান্তসীমায়।
আমার মনে হয়, সলিসিটর জেনারেলের সংজ্ঞা অনুযায়ী, আমি এক ‘সর্বনাশের দূত’-এক কুনজরের মানুষ। সুপ্রিম কোর্টে তিনি যা বলেছেন, তার কয়েকটি শব্দে আমি হতবাক। বিষণ্ণ। অবশ্য সামলে নিয়েছি-অনেক পরে হলেও শীর্ষ আদালত পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে।
আমার ৭০ দিনেরও বেশি সময় কেটে গেছে, ১২টা রাজ্যে ঘড়ি ধরে ১৫০০০ কিলোমিটার চষে বেড়িয়ে – সেই সব কর্মীবাহিনীর নৈরাশ্যের দিনপঞ্জি লিখে – যারা আমাদের শহরগুলো গড়ে তুলেছে, কারখানাকে মজবুত করেছে, আমাদের রান্নাঘরগুলো চালু রেখেছে, বাচ্চাদের দেখভাল করেছে – আর অভিজাত শ্রেণির নির্মম ঔদাসীন্য আর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব যে শক্তিকে কার্যত অনাথ করেছে। মাননীয় এস জি হয়তো আমাকে একটা “শকুন” বলে নস্যাৎ করে দেবেন।
কিন্তু লক্ষ লক্ষ ভারতীয় অদৃশ্য থেকে যেত যদি না কয়েকটি মানুষ, তাদের গল্প বলার অদম্য জেদ নিয়ে তাদের পিছু নিত। আমরা সবাই মানছি যে ভারতের মতো এত বিশাল, এত জটিল একটা দেশকে আমরা পরিচালনা করছি না। আমরা এটাও বুঝি যে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। আর এটাও বুঝি, পৃথিবীর বৃহত্তম লকডাউন কার্যকর করতে গিয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি ত্রুটি বিচ্যুতি হতেই পারে।
কিন্তু যারা গরিবদের জন্য মুখ খুলেছে, অনেক সময় নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করেও, লক্ষ লক্ষ মানুষের স্থানান্তর গমনের জন্য পথে নামাকে তথ্যায়িত করেছে, তাদের আক্রমণ করাটা অদ্ভুত। হৃদয়হীনতার পরিচয়ও বটে।
প্রথম লকডাউন ঘোষণার ঠিক পরেই, এক পরিযায়ী শ্রমিক – কোনো অটোমোবাইল কারখানার ঠিকে শ্রমিকের সঙ্গে পথ হাঁটার কথা মনে পড়ছে। গন্তব্য উত্তর প্রদেশের পথে তাকে কয়েক শো মাইল হাঁটতে হবে। রাগে ফুটতে ফুটতে বলেছিল, “ওরা কি আমাদের জন্যে বাসের ব্যবস্থাটুকুও করতে পারে না? না কি, আমরা গরিব বলে করছে না?” ক্রোধে ফেটে পড়ে বলেছিল “শুধু গরিব মানুষই মরবে! একটা নেতার একটা বাচ্চাও মরবে না”।
করোনা ভাইরাস নিয়ে প্রচলিত ধারণা – তার নিক্তিতে নাকি সবাই সমান – গরিব বড়লোক বাছবিচার নেই; এটা আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় ধোঁকা। মুম্বাই থেকে দিল্লি, তেলেঙ্গানা থেকে কেরালা – ভারতবর্ষের গরিব মানুষেরাই আমাদের শ্রেণিকে নিরাপদে রাখার মূল্য চুকিয়েছে। লকডাউন ধনী এবং উচ্চবিত্তদের সুরক্ষিত করেছে। দরিদ্রতম নাগরিকদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে একেবারে প্রান্তসীমায়।
গত দু’মাস বাস্তবের মাটিতে থেকে, দলীয় রাজনীতির কোন্দলে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। কংগ্রেস উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্য নাথের সঙ্গে বাস নিয়ে সংঘাতে তো ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)-র আক্রমণের লক্ষ্য আবার মহারাষ্ট্রের শিবসেনা। আমি দূরদর্শনের হাই-তোলা, অসম্ভব ক্লান্তিকর বিতর্কগুলো দেখি না। ওখানে মূল সমস্যার বাইরের বিষয় নিয়েই চর্চা হয়। ঐ চৌহদ্দির বাইরে, আমাদের দেশের বস্তি-মহল্লায় বা উপচানো-ভীড় ট্রাকের পিঠে যেখানে এক চিলতে জায়গার জন্যে শ্রমিকদের ৩০০০ টাকা করে দিতে হয়, সেখানে বড্ড বেমানান এসব। আর ‘সামাজিক দূরত্বের’ মতো কথাগুলো বিদ্রূপের মতো শোনায়।
অন্তত ৯ কোটি ২০ লক্ষ ভারতীয় পরিবারের সংসার একটা ঘরের মধ্যে, কোথাও কোথাও ছয় থেকে আট জন মানুষ থাকে এক চিলতে জায়গায় যার আয়তন একটা বাসনের আলমারির থেকে বেশি নয়। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এমন একটা ধারণা যা অর্থহীন। যেহেতু সব কিছুই চলমান এবং দেশে আজ, দেশভাগের পর বৃহত্তম স্থানান্তরগমনের ঘটনা ঘটছে, স্বাস্থ্য আর ভীড় না করা নিয়ে আমাদের শহর-উজ্জ্বল করা শ্লোগানগুলো শুধু খোওয়া যাওয়া সুযোগগুলোর একটা রকম ফের মাত্র। মুম্বইয়ের ধারাবি, যেখানে খবর করার জন্যে আমি অনেক দিন কাটিয়েছি, সেখানে ৮ লক্ষ লোকের জন্য মাত্র ৮ হাজার সাধারণ শৌচাগার আছে। এখানে ভাইরাসের সংক্রমণ রোখা তো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ!
এই অতিমারী আমাদের স্তরবিন্যস্ত বৈষম্যের সমাজকে ঠিক তার আসল চেহারায় উন্মোচিত করেছে, এই বৈষম্যগুলো আমাদের যুগ-পরম্পরাগত উত্তরাধিকার। এবং প্রত্যেকটি সরকারের তাতে দায়ভাগ আছে।
কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর আচমকা এক বিপর্যয়কর পরিবর্তনের নীতি চাপিয়ে দেওয়াটার কোন ব্যাখ্যা হয় না। ৩০ মার্চ মেহতা কোর্টকে জানালেন “রাস্তায় কোনো পরিযায়ী শ্রমিক নেই”। কিন্তু সত্যটা (পরিষ্কার দ্ব্যর্থহীনভাবে ক্যামেরায় ধরা আছে) হল, এর পর প্রায় দু’মাস ধরে আমাদের শ্রমিকরা রাস্তায় ছিলেন। এমনকি এক সপ্তাহ আগেও, ট্রেন আর বাসের জন্য আর অপেক্ষা করতে নারাজ অথবা অপারগ হয়ে, হাইওয়ের পর হাইওয়ে ধরে হেঁটে চলা নারী, পুরুষ, শিশুদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। হাত জোড় করে, ড্রাইভার বিনিময়ে যা চাইছে তাই দিতে রাজি হয়ে, গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কাতর আকুতি নিয়ে ট্রাকের পিছনে দৌড়াতেও দেখেছি কতজনকে।
প্রথম যখন ট্রেনের ঘোষণা হল, আমি সুরাত থেকে বিহারগামী ট্রেনটায় শ্রমিকদের হাত নেড়ে বিদায় জানাতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও পরিচালনায় ছিল অহেতুক স্বচ্ছতার অভাব আর ভুল তথ্য। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার জোর দিয়ে বলল, শ্রমিকদের ট্রেনের টিকিটের দাম দিতে হচ্ছে না।কিন্তু তাদের দিতে হচ্ছে। আমি কর্ণাটক থেকে উত্তর প্রদেশগামী একটা ট্রেনে উঠেছিলাম। সেখানে যত জন শ্রমিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, প্রত্যেককে হয় ঋণ নিয়ে, ফোন বেচে বা অন্য কোনোভাবে টাকা যোগাড় করে টিকিটের দাম মেটাতে হয়েছিল। বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনেই মৃত কাজী আনোয়ারের স্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাদেরও নিজের পয়সায় টিকিট কাটতে হয়েছিল, উপরন্তু টিকিট পেতে দালালকে অতিরিক্ত ৭০০ টাকা দিতে হয়েছিল। এসজি’র জানা উচিত, আমরা সবাই ভালো খবর পেতেই চাই। কিন্তু আশা কখনও বাস্তবকে ছাপিয়ে যেতে পারে না, যেমন মধুর প্রলেপে বিষাদকে ঢাকা যায় না। আমি বলব-সেটা করাটা-কর্তব্যকে অস্বীকার করা-নীতিগত এবং পেশাগত উভয় দিক থেকেই।”
(The Solicitor General is wrong on migrant workers :
Barkha Dutt; Hindustan Times)
সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ, নির্ভীক সাংবাদিকতাকে আমরা কুর্নিশ জানাই।
– জয়ন্তী দাশগুপ্ত