এই মুহূর্তে ভারতীয় রেলে চাকরি করা মোট কর্মীর সংখ্যা ১৪ লক্ষ। কর্মরত এই ১৪ লক্ষ কর্মীর মধ্যে ১৩ লক্ষ কর্মীকেই ছাঁটাইয়ের পথে চলেছে রেল।
রেলমন্ত্রী পীযুষ গয়ালের নেতৃত্বে সম্প্রতি একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। তাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে রেলে কর্মরত ১৪ লক্ষ কর্মীর মধ্যে ১৩ লক্ষ কর্মীকে আকর্ষণীয় ভিআরএস প্যাকেজের মাধ্যমে স্বেচ্ছাবসর প্রকল্পের মধ্যে আনা হবে। এবং এ সবকিছুই আগামী আর্থিক বছরের মধ্যে করে ফেলা হবে বলে দিল্লী রেল মন্ত্রক সূত্রে জানা গেছে।
এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সরকার সূত্রে রেলের কিছু উচ্চ পদস্থ অফিসার জানিয়েছেন নিজেদের স্থায়ী কর্মীদের বদলে বেসরকারী আউটসোর্সিং কোম্পানিদের থেকে কর্মী নিয়োগ করলে রেলের পারফরমেন্স আরো ভালো হবে।
এই পর্যন্ত পড়ে যে সমস্ত ভক্তরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে চিৎকার করে বলছেন আবার মোদীজির একটি খুব বড় ‘মাস্টারস্ট্রোক’ তাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলছি - জাস্ট রিলাক্স লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান ! জাস্ট রিলাক্স !
ভক্তরা মনে হয় জানেন না যে ভারতীয় রেল বিশ্বের বৃহত্তম ও ব্যস্ততম রেল পরিবহন ব্যবস্থাগুলির অন্যতম। প্রতিদিন ১ কোটি ৮০ লক্ষেরও বেশি যাত্রী এবং ২০ লক্ষ টনেরও বেশি পণ্য ভারতীয় রেলপথে চলাচল করে। তাই রেলে চাকরি করা ১৪ লক্ষ মানুষের মধ্যে ওই ১৩ লক্ষ মানুষেরই শুধু চাকরি চলে যাবে না, এর সরাসরি প্রভাবও আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনে পড়বে। এটুকু তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার রেলের ওই ১৩ লক্ষ কর্মী ছাঁটাই করে সেই কর্মী নিয়োগের দায়িত্ব সহ রেলের সবকিছুই আস্তে আস্তে আম্বানি আদানীদের হাতে বিক্রি করে দেবে মোদী-শাহ।
আপনি হয়তো ভাবছেন আমার পরিবারের তো কেউ রেলে চাকরি করেনা,তাই আমার কিছু এসে যায়না। তাদের সকলের উদ্দেশ্যে আবার বলছি - জাস্ট রিলাক্স লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান ! জাস্ট রিলাক্স !
একটু জেনে রাখুন। আপনি যে ৫ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতেন সেটা বেড়ে দাঁড়াবে ২০ টাকা, ১০০ টাকা দিয়ে যে মান্থলি কাটতেন সেটা বেড়ে হবে ৪০০ টাকা, প্রতিটি বড় স্টেশন থেকে বিনামূল্যে ওয়েটিং রুমে থাকার সুবিধে ও আর থাকবে না। শিয়ালদা স্টেশনে দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের ওয়েটিং রুম অলরেডি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তার বদলে শিয়ালদা স্টেশনের দোতলায় এক ঝাঁ চকচকে ওয়েটিং রুম বানিয়েছে কলকাতার একটি বেসরকারী কোম্পানি। ওই ওয়েটিং রুমে ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষা করতে হলে গুনে গুনে দিতে হবে প্রতি ঘণ্টাতে ৪০০ টাকা।
নীতি আয়োগের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ১৫০টি ট্রেন ও ৫০টি স্টেশনকে বেসরকারী মালিকানার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন এইসব ট্রেন আর স্টেশন বেসরকারী কোম্পানিদের হাতে চলে গেলে ইআরএমইউ-র হিসাব অনুযায়ী রেল স্টেশনকে কেন্দ্র করে যে কোটি কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের রুটি রোজগার সরাসরি বন্ধ হয়ে যাবে। রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে রেলের জমিতে অটো, টোটো, বাস, ট্রেকার, কুলি, হকার কিছুই আর থাকবে না। সবটাই তুলে দেওয়া হবে আম্বানি-আদানিদের মতো বেসরকারী কোম্পানি দের হাতে।
বেসরকারী কোম্পনির হাতে গেলে ভাড়া কিভাবে বৃদ্ধি পাবে তার জ্বলন্ত ২টি উদাহরণ হলো তেজ এক্সপ্রেস ও হাওড়া স্টেশন-এর বাইরে ক্যাব।
লক্ষ্নৌ থেকে দিল্লী পর্যন্ত গোমতি এক্সপ্রেসের এসি চেয়ারকারের আগে ভাড়া ছিল ৬৪০ টাকা, সেই ট্রেন বেসরকারী হয়ে এখন নাম হয়েছে তেজ এক্সপ্রেস, যার ভাড়া এখন ৬৪০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭০০ টাকা ! আর হাওড়া স্টেশনের বাইরে ক্যাব রোড রেলের হাতে থাকার সময়ে ভাড়া ছিল ৪০ টাকা, যা এখন বেসরকারী হওয়ার পর বেড়ে হয়েছে ২৫০ টাকা।
সুতরাং রেলের বেসরকারীকরণ হলে যে দেশের সাধরণ মানুষের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে সেটুকু বোঝার জন্য বিরাট কোনো পড়াশোনার দরকার হয় না, যেটা দরকার হয় সেটি হলো চোখ থেকে ভক্তের ওই চশমাটা খুলে ফেলা।
আপনি অন্ধ মোদি ভক্ত হতেই পারেন, জী নিউজ-অর্ণব গোস্বামীদের মুখ নিঃসৃত বাণী আপনার সবই সত্য বলে মনে হতেই পারে, সারাদিনে কয়েকশো বার হিন্দু-মুসলিম না করলে রাতে আপনার ঘুম নাই ধরতে পারে, ফেইসবুক-হোয়াটস অ্যাপে ফেক নিউজ শেয়ার না করলে আপনার ভাত হজম নাই হতে পারে কিন্তু জেনে রাখুন মশাই আপনার বাড়ির যে ছেলেটি রাতদিন পড়াশোনা করে রেলে চাকরি করার স্বপ্ন দেখছে তাদের স্বপ্ন গুলো শেষ হয়ে যেতে চলেছে।
এই বছর ২৮ ফেব্রুয়ারী রেল ‘এনটিপিসি’ বলে একটি নোটিফিকেশন বের করে যাতে করে ৩৫,২০৮টি ভ্যাকেন্সি আছে। কিন্তু প্রায় ১০ মাস হয়ে গেলেও সেই পরীক্ষা কবে হবে বা আদৌও হবে কিনা সেই নিয়ে রেল মুখে কুলুপ এঁটেছে।
এছাড়া রেল ১২ মার্চ ‘লেভেল ওয়ান’ বলে আরো একটি নোটিফিকেশন বের করেছিল যাতে করে ১,০৩৭,৬৯টি ভ্যাকেন্সি আছে বলে জানায়। কিন্তু প্রায় ৯মাস হয়ে গেলেও সেই পরীক্ষা কবে হবে বা আদেও হবে কিনা সেই নিয়ে রেল মুখে কুলুপ এঁটেছে।
পুরো দেশ জুড়ে প্রায় ২কোটির উপরে ছেলে মেয়ে এই ২টি পরীক্ষার ফর্ম এক একটা ৫০০ টাকা করে ফিলাপ করেছিল। কিন্তু আচ্ছে দিনের সরকার তাদের সব স্বপ্ন গুলো গলা টিপে খুন করে দিচ্ছে দিনের পর দিন।
তাই এখনো সময় আছে, অন্ধ ভক্তি ছাড়ুন, কোনো বিষয়ে ভালো করে জানুন পড়ুন আর তারপর পক্ষ নিন। আজ না হয় কাল অথবা পরশু পক্ষ আপনাকে নিতেই হবে। কারণ নিরপেক্ষতা বলে কিছু হয় না।
আমরা এই ফ্যাসিবাদ সরকারের যা কিছু অন্যায়, যা কিছু ভুল তার বিরুদ্ধে আমাদের সীমিত ক্ষমতা অনুযায়ী লিখে যাবো, বলে যাবো, প্রতিবাদ করে যাবো।
কারণ আমরা জানি অধিকার কখনো কেউ কাউকে দেয়না, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। বাঁচতে গেলে লড়াই করতে হবে কারণ লড়াই করেই বাঁচতে হবে।
-- শুভ্রেন্দু সমাজদার