সেমিনার থেকে ওয়েবিনার : সৌজন্য লকডাউন
semi

সে এক দিন ছিলো – যখন সেমিনার মানে সংশ্লিষ্ট কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান বা অধ্যক্ষ মশাইয়ের মেয়ের বিয়ে, হইচই হাঁকডাকে তার একমাস আগে থেকেই কাজকর্মের দফারফা। দুপুরের ভূরিভোজ (“ওয়ার্কিং লাঞ্চ”) থেকে আরম্ভ করে বহিরাগত অতিথিদের (“রিসোর্স পার্সন”) যাতায়াতের গাড়ি-দুই বা একদিনের মধ্যে সবটা বেঁধে ফেলা ছিলো অনেকটা ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের গৌড়সারঙ্গ রাগিনী গায়নের মতো … সীমিত সময়ে আরোহ অবরোহসহ শেষ করে ওঠাই মুশকিল। মুশকিল আসানের জন্যও থাকতেন কিছু শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী-অধ্যক্ষ বা বিভাগীয় প্রধান জানতেন, তাঁর স্যুটের ক্রিজ বা পাঞ্জাবির ভাঁজ নষ্ট হবে না, সব ঠিক ‘ম্যানেজ’ হয়ে যাবে। লকডাউন সেই মুশকিল আসানদের একঝটকায় মূল্যহীন করে দিলো – সেমিনারের জায়গা পাকাপাকিভাবে দখল করলো ওয়েবিনার।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, অনলাইন সেমিনার বা ওয়েবিনার বা স্কাইপ প্রেজেন্টেশন এর আগেও ছিলো – কিন্তু এমন সর্বজনীন স্তরে তা নেমে আসেনি। অনলাইন প্রেজেন্টেশন ছিলো একটা সমান্তরাল মাধ্যমের মতো, কিছুটা বিকল্পের ধারণাও নিহিত থাকতো তার মধ্যে … কিছুটা ‘আদারনেস’-এর ধারণাও কি ছিলো না? অনেক সেমিনারে সার্টিফিকেটে লিখেও দিতো – “পেপার প্রেজেন্টেড থ্রু স্কাইপ/অনলাইন মোড” … লকডাউন এসে ‘সেন্টার’ আর ‘মার্জিন’-এর সেই ধারণাকে একেবারে ঘুরিয়ে দিলো! গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে … ওয়েবিনার হয়ে উঠলো লকডাউনকালীন বিদ্যাচর্চার স্টাইল আইকন। ফল? লকডাউনে গৃহবন্দী পুরাতত্ত্বের গবেষককেও টিটকিরি খেতে হলো – “ওয়েবিনারে একটাও প্রেজেন্টেশন দাওনি? লকডাউন কি খেয়ে-ঘুমিয়ে কাটালে?” কে বোঝাবে – তার সাবজেক্টে ঘুরে বেড়ানোটাই একটা কাজ, ঘরে বসে অনলাইনে আর্কিওলজির গবেষণা হয় না! কোথাও বা আবার ছাত্রছাত্রীরা ব্যস্ত হয়ে পড়লো কে কটা ওয়েবিনার অ্যাটেন্ড করেছে, প্রমাণসহ তার সংখ্যা ফেসবুকে পোস্টাতে … শিয়ালদা শাখার বনগাঁ লোকালে একই কামরায় দুজন হকার দুদিক থেকে উঠে এলে নিত্যযাত্রীরা জানেন, দুজনের হাঁকাহাঁকিতে দাম কমতে বাধ্য – এ দশ টাকায় আটটা দিতে চায় তো ও ওদিক থেকে হেঁকে ওঠে, “দশে দশ, দশে দশ-শুধু নিয়ে যান” – তেমনি এই কলেজ বলে, আমরা আটটা ওয়েবিনার করেছি, তো পাশের কলেজ আস্তিন গুটিয়ে তেড়ে আসে : আমরা যে দশটা করলাম, তার বেলা?

২০১৫-র ১২ মার্চ আর্জেন্তিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে একটি বক্তৃতা দেন এই সময়ের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তক নোয়াম চমস্কি। তাতে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, পুঁজিবাদী আধুনিকতার স্বার্থে মানুষের প্রযুক্তিনির্ভরতা যদি মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ে, তাহলে নাগরিকরা খুব সহজে তাদের অজান্তেই চলে আসবে রাষ্ট্রীয় নজরদারির আওতায়, যেমনটা হচ্ছে চিনে। করোনা পরবর্তী সময়ে ২০২০-র এপ্রিল-মে মাসের বক্তৃতা বা সাক্ষাৎকারে তিনি নিও লিবারেলিজমের আড়ালে পুঁজিবাদের আকাশচুম্বী অহংকারের পতনের কারণ অনুসন্ধানের মধ্যেও প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন এই দেশগুলির প্রযুক্তিনির্ভরতার ‘মাত্রা’র দিকে। প্রযুক্তিকে আমি আমার স্বার্থে ব্যবহার করবো, কিন্তু প্রযুক্তি যদি সিন্দবাদের বৃদ্ধের মতো আমার ঘাড় থেকে না নামতে চায়, তখন?

reser

 

আপাত মজাটুকু বাদ দিয়ে এই সেমিনারগুলির কিছু ভালো দিকও ছিলো – ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন করতে শিখতো, তরুণ গবেষকরা নিজেদেরকে আরো অনেক ধারালো করে তোলার সুযোগ পেতেন, বিভিন্ন চিন্তাধারার ধাক্কায় যে আগুনের ফুলকি উঠে আসতো, উত্তাপের সঙ্গে তা আলোও যোগাতো। অল্প হলেও উদ্ভাসিত হয়ে উঠতো জ্ঞানচর্চার জগৎ। সবথেকে মলিন সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি বা সবচেয়ে সাধারণ চেহারার ছেলেটি প্রশ্নোত্তর পর্বে আমন্ত্রিত বক্তার চোখে চোখ রেখে অনেক সময় এমন সব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিত, সেই সারল্যভরা বিশুদ্ধ জিজ্ঞাসার সামনে অনেক তাবড় তাবড় বক্তা থমকে যেতেন !

তরুণ গবেষকের প্রশ্নে নাস্তানাবুদ হয়ে কখনো রেগে গিয়ে, কখনো সস্নেহ হেসে,আবার কখনো বা নিজের বক্তব্যকে প্রত্যাহারও করে নিতে দেখেছি অনেকবার। মধ্যভারতের একটি জাতীয় নাট্য কর্মশালায় আদিবাসী লোকনাট্য আর থার্ড থিয়েটারের তুলনামূলক আলোচনায় এক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞকে প্রায়োগিক প্রশ্নে নাকানিচোবানি খাইয়ে দিয়েছিলেন ঝাড়খণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাইবাল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচারের একদল তরুণ গবেষক … অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত সেই প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে অভিনন্দনের উত্তরে উত্তেজনায় চকচকে মুখে তাঁদেরই একজন বলেছিলেন, “স্যর, অগর আপনে বিসওয়াস মে দম হ্যায়, তো ঠোককে বোলনা চাহিয়ে।” ওয়েবিনারের প্ল্যাটফর্ম সেই ‘ঠোককে বোলনা চাহিয়ে’র গণতান্ত্রিক পরিসরকে কোথাও যেন নষ্ট করে দিলো … ইন্টারনেটের পাসপোর্ট ছাড়া সেখানে ঢোকা বারণ যে! ইন্টারনেটের থেকে যারা দূরে, এ জগতে তাদের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এ ওয়েবিনার তাদের জন্য নয়, যাদের জামা কোঁচকানো, চোখের কোনে কালি, গায়ে ঘামের গন্ধ, পেটে খিদে-অথচ থাকার মধ্যে আছে হায়ার সেকেন্ডারির একটা চোখধাঁধানো মার্কশিট আর দুচোখে জ্বলজ্বলে স্বপ্ন। যে ছেলে সকালে পান্তা খেয়ে মাঠে হাল দিয়ে এসে সকালের ক্লাসে বসে ঘুমে ঢুলতে থাকে, এ ওয়েবিনার তার জন্য নয়; যে মেয়ে বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে কলেজে ঢুকে গার্লস কমন রুমে পোষাক বদলে প্র্যাক্টিকাল করতে দৌড়োয়, এ ওয়েবিনার তার জন্য নয়; যে গবেষক পয়সার অভাবে রোজ সকালে স্টেশনে গিয়ে খবরের কাগজ পড়ে আসে, আর তড়িঘড়ি বাড়িতে ফিরে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অংশ খাতায় টুকে রাখে-এ ওয়েবিনার তার জন্য নয়। তাই এখানে কোনো ঠোকাঠুকি লাগে না, কোনো অস্বস্তিকর প্রশ্ন নেই, কোনো হঠাৎ চেয়ার ঠেলে বেরিয়ে যাওয়া নেই – আবার কোনো পায়রা ওড়ানো হাততালিও নেই। নোয়াম চমস্কির বক্তৃতার চিনের মতো অনলাইনে ভার্চুয়ালি নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে পারলেই … কেল্লাফতে!

আমরা, যারা প্রতি মুহূর্তে “শিক্ষা বেসরকারী হাতে চলে যাচ্ছে” বলে গলা ফাটাই, তারা বুঝিও না বা বুঝেও বুঝতে চাই না এভাবেই ‘ডিজিটাল’ আর ‘নন ডিজিটাল’ দুটি শ্রেণি তৈরি করে ফেলছি আমরা। আর এভাবেই, কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ তালিকাভুক্ত শিক্ষা ও গবেষণার দম বন্ধ হয়ে আসছে … উচ্চশিক্ষার ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় বেমানান অনেক প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীর মতো সে হয়তো গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে না, গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়ছে না, মায়ের প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে লুকিয়ে আলজোলাম কিনছে না … সে নিঃশব্দে, নীরবে তার প্রতি মুহূর্তের বাঁচা বন্ধ করে বসে আছে!

-- ঋষি ঘোষ 
গৌড় মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক (বাংলা বিভাগ) 

খণ্ড-27