মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ-বিরোধী প্রতিবাদের চলমান প্রবাহ এবং ভারতে তার অনুরণন
mlu

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দৃঢ় শিকড় চাড়ানো বর্ণবাদী পক্ষপাত ও হিংসার বিরুদ্ধে বিপুল আকারের বিদ্রোহ ফেটে পড়ছে। এই বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটানো সাম্প্রতিক ঘটনাটা এইরকম : মিনিয়াপোলিসে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসাররা এক আফ্রিকান আমেরিকান পুরুষ জর্জ ফ্লয়েডকে মাটিতে শুইয়ে মুখ নীচের দিকে করে চেপে ধরে এবং তাদের মধ্যে একজন তার ঘাড়ের ওপর হাঁটু চেপে রেখে শ্বাসরোধ করে ওকে মেরে ফেলে। ফ্লয়েড বারবারই বলছিল যে ওর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আর ও মরে যাচ্ছে, এ সত্ত্বেও পুলিশগুলো ওর শ্বাসরোধ করে চলেছিল। ফ্লয়েডের হত্যা কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয় – পুলিশ এবং এমনকি শ্বেতাঙ্গদের হাতে আফ্রিকান আমেরিকানদের হত্যার দীর্ঘ তালিকায় এটা সাম্প্রতিক সময়ে আর একটা সংযোজন মাত্র।

এই ধরনের হত্যার ঘটনা যেমন বহুসংখ্যকই ঘটে, তেমনি নিজেদের জীবনে কালো মানুষদের মুখোমুখি হতে হওয়া বর্ণবিদ্বেষের ঘটনাও অসংখ্যই দেখা যায়। পুলিশ স্বেচ্ছাচারীভাবে কালো মানুষদের আটক করে তাদের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার চালায়, এবং কালো মানুষদের হুমকি দিতে ও চোখ রাঙাতেও শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীরা পুলিশকে ডেকে আনে।

পুলিশ বাহিনীর মধ্যে এবং অপরাধ বিচার ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত প্রণালীবদ্ধ বর্ণবাদী পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে এবং বর্ণবাদ প্রসূত হত্যার ঘটনাগুলোতে হয়ে চলা ন্যায় বিচারের বঞ্চনার বিরুদ্ধে কয়েক বছর আগে শুরু হয় ‘কালো মানুষের জীবনেরও মূল্য আছে’ আন্দোলন যা আজও অব্যাহত রয়েছে। এই প্রতিবাদগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী কী ভয়ঙ্কর যুদ্ধবাজ এবং যুদ্ধের মনোভাবে সম্পৃক্ত পরিকাঠামো ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা কতটা প্রবল মাত্রায় ঔপনিবেশিক দখলদারির রাষ্ট্র ইজরায়েলের মডেলকেই অনুসরণ করে। বর্তমানে প্রতিবাদের যে ঢেউ দেখা যাচ্ছে তা আগের প্রতিবাদগুলোরই ধারাবাহিকতা হলেও ব্যাপ্তি ও অভিঘাতের দিক থেকে অভূতপূর্ব ও ঐতিহাসিক।

blac

 

কোভিড-১৯ অতিমারির প্রকোপে কালো মানুষরাই তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়েছেন, যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে  এই সম্প্রদায়ের মানুষদের ব্যাপক সংখ্যকই দরিদ্র, অনথিবদ্ধ এবং শ্রমিক শ্রেণীর সবচেয়ে অসহায় ও নিরাপত্তাহীন অংশের অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন সমাজের অঙ্গ হয়ে থাকা অসাম্যের সর্বব্যাপী ও সুগভীর ফাটল ওই সমাজকে অতিমারির কারণে বিদ্রোহের জন্ম নেওয়ার পক্ষে বিশেষভাবে অনুকূল করে তুলেছে। এখন জনগণের ক্ষোভ ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে থাকা  অসাম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে ফেটে পড়ে দায়বদ্ধতার দাবি জানাচ্ছে।

প্রতিবাদগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শান্তিপূর্ণ ছিল, তবে কোথাও-কোথাও ক্রুদ্ধ প্রতিবাদকারীরা পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং সমবায় বিপণিগুলোতে ভাঙচুর চালায়। এই ফেটে পড়া রোষ ও ক্রোধ একেবারেই ন্যায়সংগত, এবং ঘটনা হল ক্ষতিগ্ৰস্ত অনেক বাড়ি ও দোকানের মালিকই আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প প্রতিবাদকারীদের ‘গুণ্ডা’ ও ‘লুটেরা’ বলে ছাপ মেরেছেন, তাদের দমন করতে জাতীয় রক্ষী বাহিনীকে নামিয়েছেন এবং রাস্তায় ‘কর্তৃত্ব করার জন্য’ সামরিক বাহিনীকে নামানোর কথাও বলছেন। যুদ্ধবাজি মানসিকতায় সম্পৃক্ত পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রোধের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে ট্রাম্প প্রতিবাদকারীদের গুলি করে মেরে ফেলা অথবা গ্ৰেপ্তার করে অন্তত এক দশক জেলে পুরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

peace

 

ট্রাম্প শ্লোগান দিয়েছেন, “লুট শুরু হলে গুলি চালানোও শুরু হয়।” এই শ্লোগান আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের কিছু ঘটনাকে মনে পড়িয়ে দেয় – যথা, শ্রমিকরা যখন ৮-ঘন্টার শ্রমদিবসের জন্য ধর্মঘট করেছিলেন কিংবা বর্ণবাদ-বিরোধী প্রতিবাদকারীরা নাগরিক স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিলেন, তখন তাদের “লুটেরা” বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর সংবাদপত্রগুলো ও রাজনীতিবিদরা তাদের গুলি করে মেরে ফেলার দাবি তুলেছিল। আজ দুনিয়া জুড়ে যে প্রতিবাদ চলছে এবং ট্রাম্প প্রশাসন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের ওপর যেভাবে দমন নামিয়ে আনছে তা মার্কিন গণতন্ত্রের  পলকা চরিত্রকে উন্মোচিত করে দিচ্ছে এবং সামরিক একনায়ক হওয়ার মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের অভিপ্রায়কেও সামনে নিয়ে আসছে।

ভারতে এটা স্মরণে রাখা জরুরি যে, বিজেপি নেতারা “দেশ কো গদ্দারো কো, গোলি মারো শালো কো”র (বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করে মারো)  যে শ্লোগান দিয়েছেন তা “লুট শুরু হলে গুলি চালানোও শুরু হয়” শ্লোগানেরই জুড়ি। ট্রাম্প যেমন বর্ণবাদ-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের লুটেরা বলে ছাপ মারছেন এবং তাদের পাইকারি হারে মেরে ফেলার দাবি তুলছেন, একই ভাবে বিজেপি এবং মোদী সরকারও গণতন্ত্রকামী, সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের “বিশ্বাসঘাতক” বলে ছাপ মেরে তাদের কচুকাটা করা ও গুলি করে মেরে ফেলার দাবি জানিয়েছিল। ভারতে মোদী ২০২০র ফেব্রুয়ারীতে যখন ট্রাম্পকে আপ্যায়ন করছিলেন, কপিল মিশ্রর মতো বিজেপি নেতারা তখন সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের এবং ওই প্রতিবাদগুলোকে সমর্থন জানানো মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের হত্যা করার জন্য দাঙ্গাবাজদের প্ররোচিত করছিলেন।

caa

 

সেই কপিল মিশ্রই এখন টুইট করে বলেছেন যে, তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এবার উপলব্ধি করতে হবে যে “খারাপ লোকেরা” যখন রাস্তার দখল নেয় তখন “ভালো মানুষদের” রাস্তায় নেমে এসে তাদের আটকাতে হবে। এর ইঙ্গিতটা দ্ব্যর্থহীন: বিজেপির বিশ্ব বীক্ষায় আমেরিকায় আফ্রিকান আমেরিকানরা, কালো মানুষ এবং বর্ণবাদ-বিরোধীরা আর ভারতে মুসলিমরা ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী প্রতিবাদকারীরা হল “খারাপ মানুষ” আর আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা এবং ভারতে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলোর ক্যাডাররা হল “ভালো মানুষ”।

ভারতের পুলিশ ও অপরাধ বিচার ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত সাম্প্রদায়িক, জাতপপাতবাদী ও শ্রেণী পক্ষপাতিত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার  যথার্থ সময় উপস্থিত। এই পক্ষপাতিত্ব একেবারেই নতুন নয় – স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ছড়িয়ে রয়েছে পুলিশ ও সেনা বাহিনীর হাতে মুসলিম, শিখ ও খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের, দলিত-আদিবাসী-কাশ্মীরী-মনিপুরী-নাগাদের গণহত্যার অসংখ্য ঘটনা; আরও রয়েছে সাম্প্রদায়িক ও সামন্ততান্ত্রিক সংগঠনগুলোর হাতে মুসলিম ও দলিতদের গণহত্যার বহুসংখ্যক ঘটনা। বিক্ষোভকারীদের দমন করতে কাঁদানে গ্যাস, লাঠি ও গুলির ব্যবহার (কাশ্মীরীদের দমনে ছররা বন্দুক) খুবই সাধারণ ব্যাপার। এই সমস্ত ঘটনার অধিকাংশর ক্ষেত্রেই প্রণালীবদ্ধভাবে ন্যায়বিচারের বঞ্চনা হয়েছে, এবং গণহত্যার সংঘটকদের পদোন্নতি ঘটিয়ে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার আসনে বসিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

usaa

 

আমেরিকায় জেলে বন্দী মানুষদের মধ্যে আফ্রিকান আমেরিকান এবং কালো মানুষদের সংখ্যা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অনেক বেশি এবং তারাই বন্দীদের ব্যাপকতর অংশ – ভারতে দলিত, আদিবাসী ও মুসলিমদের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্যি। ভারতের জেলগুলোতে যত বন্দী রয়েছে তার ৫৩ শতাংশই হল মুসলিম, দলিত ও আদিবাসী। জনগণের এই অংশটার বিরুদ্ধে – যে অংশটা আবার দরিদ্রতম ভারতীয়দের মধ্যে পড়ে – পুলিশের নিপীড়ন, মিথ্যা অভিযোগ দায়ের এবং ভুয়ো সংঘর্ষে তাদের হত্যা (হেফাজতে হত্যা) ব্যতিক্রম না হয়ে নিয়ম হয়েই দাঁড়িয়েছে।

মোদী সরকারের নেতৃত্বাধীন গত ছ-বছরে ব্যবস্থার মধ্যেকার এই প্রবণতাগুলো আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক দলবল মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা করেছে, আর পুলিশ পিটিয়ে হত্যায় যুক্ত দলবলকে সুরক্ষা যুগিয়েছে এবং মৃতপ্রায় মুসলিমদের সঙ্গে নির্মম আচরণ করেছে। সম্প্রতি, যখন কোভিড-১৯ অতিমারী চলছে সেই সময়  মধ্যপ্রদেশের বেতুলে পুলিশ এক দলিত মানুষকে প্রচণ্ড প্রহার করে। পুলিশ পরে তার কাছে “ক্ষমা চাওয়ার” চেষ্টা করে, এবং এই অজুহাত দেয় যে তার দাড়ির জন্য সে তাকে মুসলমান বলে মনে করেছিল! সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদ চলার সময় পুলিশ জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে অন্ধ করে দেয় এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে পঙ্গু করে তোলে, মুসলিমদের চোখে গুলি করে, উত্তরপ্রদেশ ও কর্ণাটকে নিরস্ত্র মুসলিমদের গুলি করে হত্যা করে, এবং সুপরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের ঘরবাড়ি তছনছ করে।

amp

 

পুলিশ এখন আবার সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের গ্রেপ্তারে উঠেপড়ে লেগেছে এবং যারা প্রকৃতই হিংসা চালিয়ে ছিল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটুকু দায়ের করতে পর্যন্ত অস্বীকার করছে। ছত্তিশগড়ে পুলিশ ও সেনারা যে আদিবাসীদের গ্ৰেপ্তার করছে এবং যাদের ওপর হেফাজতে নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের আইনি সহায়তা দিয়েছিলেন আইনজীবী ও সমাজ আন্দোলনের কর্মী সুধা ভরদ্বাজ। মোদী জমানায় তাঁকে দানবীয় ইউএপিএ আইনে মিথ্যাভাবে অভিযুক্ত করে জেলে পোরা হয়েছে। ট্রাম্প বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করে এক দশক জেলে বন্দী করে রাখার দাবি তুলছেন; আজ ভারতে কোভিড-১৯ অতিমারী চলার সময় সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের ইউএপিএ আইনের অধীনে জেলে পোরা হচ্ছে, আর এই আইনে কোনো বিচার বা জামিন ছাড়াই বছরের পর বছর আটক রাখার বিধান আছে। একইভাবে কাশ্মীরীদেরও বিচার ছাড়াই দানবীয় পিএসএ আইনে দশকের পর দশক ধরে জেলে বন্দী করে রাখা হচ্ছে।

পুলিশের নির্যাতনে আহত হয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর ফৈজানকে দিল্লীর পুলিশ লাথি মারছে আর জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করছে (যা সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের এক প্রতিবাদী সঙ্গীত এবং সমাবেশ ঘটানোর উদ্দীপনাময় আওয়াজ হয়ে উঠেছিল) – এই অত্যাচারের ভিডিও টেপ পুলিশের পক্ষপাতিত্ব ও পৈশাচিকতাকে কোনো অংশেই আমেরিকার পুলিশ বাহিনীর জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেয়ে  কম ভয়ংকর বলে দেখায় না।

wo

 

আমেরিকায় চলমান গণ আন্দোলন জর্জ ফ্লয়েডের জন্য এবং বর্ণবাদী পুলিশ ও শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের হাতে নিহত অন্য সমস্ত আফ্রিকান আমেরিকানদের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি জানাচ্ছে। এই আন্দোলন পুলিশ বাহিনী এবং অপরাধ বিচার ব্যবস্থার গভীরে শিকড় চাড়ানো বর্ণবাদ ও যুদ্ধবাজি মানসিকতার অবসানেরও দাবি জানাচ্ছে। এই বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানানোর সাথে-সাথে ভারতে আমরা ভারতের বিদ্যমান ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত পুলিশ বাহিনী এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের পক্ষপাতিত্ব ও নিপীড়নকে গ্রাহ্য করার দাবি জানাচ্ছি, যে পুলিশ বাহিনী ও রাষ্ট্র যন্ত্রকে মোদী সরকার মুসলিম সংখ্যালঘু এবং গণতন্ত্রকামী প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২ জুন ২০২০) 

খণ্ড-27