সারা দেশে এখন চলছে পঞ্চম দফা লকডাউন। কোভিড-১৯ থেকে বাঁচতে শ্রমিক, মজুর, গ্রামীণ কৃষিনির্ভর শ্রেণীগুলিও ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বা ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ জাতীয় প্রবাদের পুনরাবৃত্তি করছে নতুন নতুন পদ্ধতিতে। এই সামাজিক প্রবৃত্তি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার ছড়ানো নিরন্তর গুজবের ফল। এইরকম সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার বিষয়টি ঘটছে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নেতারা এখন হঠাৎ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য চোখের জল ফেলতে শুরু করেছে, যদিও ঘরে ফেরার পথে পরিযায়ি শ্রমিকদের মৃত্যুর মর্মন্তুদ ঘটনাগুলিকে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের “ছোট ঘটনা” বলার মধ্যে দিয়েই তাদের মন-কি-বাত প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ওপর-বিবৃতির স্তরে নিজেদের খুব উদ্বিগ্ন হিসেবে তুলে ধরার সাথে সাথে স্থানীয় স্তরে বিজেপি জনতার কানে কানে ক্রমাগত প্রচার করে চলেছে ‘পরিযায়ী শ্রমিকেরা করোনা বাহক, ওদের একঘরে করো’। একদিকে মানুষের মনে কোভিড সংক্রমণে মৃত্যুর প্রবল আশঙ্কা ও অন্যদিকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যর্থতা -- এই দুইকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ শ্রমজীবিদের মধ্যে নতুন বিভাজন ঘটাতে চাইছে ওরা। মহামারী ও লকডাউনের এই গোটা পর্বে কেন্দ্র সরকারের চরম অমানবিক আচরণ ও শ্রমিকবিরোধী কার্যকলাপ আড়াল করতে মরিয়া বিজেপি। সারা দেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার যে জনস্রোত চলছে তার দিকে তাকালে ও তাদের কথা শুনলে একথা বোঝা যায় যে তাদের মধ্যে মোদি ও হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রতি মোহমুগ্ধতা দ্রুত ভাঙতে শুরু করেছে।
যাঁরা বিদেশ বিভুঁইয়ে দুর্দশা ও অবহেলায় ক্ষুধায় অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পড়তেও শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরে আসতে পারলেন, তখন বাড়িতে পাড়ায় নিকটজনদের মাঝে তা যতটা সুমিষ্ট অনুভূতির মধ্যে দিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তার বদলে জুটলো তীব্র আতঙ্ক, তাঁদের পরিচয়ের সাথে জড়িয়ে দেওয়া হল বিপজ্জনক তকমা।
দেশ জুড়েই আওয়াজ উঠেছিল – পরিযায়ী শ্রমিকদের সুস্থ ভাবে নিরাপত্তার সাথে বাড়ি ফেরাও। কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার করলো অন্যরকম। দীর্ঘদিন সে টালবাহানা করল। আটকে পড়া শ্রমিকদের দুর্দশা বাড়িয়ে চলল। ট্রেনের ভাড়া নিয়ে বেগড়বাই করল। অবশেষে রেলপথে ফেরত পাঠাতে যখন শুরু করল তখন দেখা গেল স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য চেক-আপ, খাবার পাওয়ার গ্যারান্টি ও অন্যবিধ নিরাপত্তার জরুরি বিষয়গুলি সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের যেন-তেন প্রকারেণ রাজ্যে নিয়ে ফেলতে পারাটাই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠল বিজেপির। এভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায় তারা -- রাজ্য সরকারকে দোষারোপ উপরিস্তরে, আর নীচে পরিযায়ী শ্রমিকের বিরুদ্ধে সমস্ত পাড়া ও ক্লাবকে লেলিয়ে দেওয়া। এই খেলাটা বিজেপি-সঙ্ঘ-পরিবার করেই থাকে : সংকট তৈরি করে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার রাজনীতি।
আপাত ভাবে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার দুই জেলাশাসক, জেলাজুড়ে বাম সংগঠনগুলি স্মারকলিপি জমা দেওয়ার পর, ঘোষণা করেছেন যে, পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরার পর, তাঁরা পরিবহনের সাহায্যটুকু দেবেন এবং আলাদাভাবে কোয়ারেন্টাইন করবেন। এই চাপ সৃষ্টি জরুরি ছিল কারণ বিজেপির উস্কানিসহ সাধারণ মানুষও মৃত্যু-ভয়ের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর সর্বত প্রচেষ্টা দিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের, ‘অচ্ছুৎ’ বানিয়ে সামাজিক বয়কট করাকেই সঠিক বলে ভাবতে শুরু করছে। ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইন মুখে শুনতে ভালো লাগলেও সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের পক্ষেই বাস্তবে প্রায় অসম্ভব, তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থার দুর্দশার কারণেই। তাই তাঁদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষা সরকারকেই করতে হবে, এ'কথা জোর দিয়ে বলার ভীষণ প্রয়োজন এই সময়েই।
পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি অস্পৃশ্যতা ও সামাজিক বহিষ্কারের নিদারুণ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমরা। বিষ্ণুপুর মিউনিসিপালিটির ৬ নং ওয়ার্ডে ১৯ মে দু-জন জন শ্রমিক চেন্নাই থেকে বাড়ি ফেরেন। কোনোরকম স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে বাড়ি ফেরার অবস্থাতেও তাঁরা ছিলেন না। পরবর্তী ৩-৪ দিন ধরে পাড়ার লোকজনের ক্রমাগত গঞ্জনার ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। তাঁদের একঘরে করে দেওয়া হয়। ওয়ার্ড কাউন্সিলর আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হন, উল্টে জনতার চাপে তিনি পরিযায়ী শ্রমিক পরিবার দুটির ওপরই গলা চড়ান। যদিও এর মধ্যে সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা তাদের হয়ে গেছিলো। আম্ফান ঝড়ের দিনও অশান্তি হয়। এর ৩-৪ দিন বাদে ওই পরিবার দুটির একটি পরিবার ত্রাণ নিতে পর্যন্ত অস্বীকার করেন চরম দুর্দশার মধ্যে থেকেও, পাছে লোক জানাজানি হয়, যদি আবার পাড়ার লোকের গঞ্জনা শুনতে হয়। চরম মানসিক অবসাদ ঘিরে ধরেছে মানুষগুলোকে। বাড়ির মহিলারা বিড়ি বাঁধার কাজ করেন। তারা বিড়ি জমা দিতেও বাধার সম্মুখীন হয়েছে। পাড়ার তাঁতিদের মহাজনরা ছুটিতে থাকার কথা বলছে কারণ, পাড়ার মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিক এসেছে, বলা চলে, “করোনা এসেছে” বলছে।
মনুবাদী পরম্পরা, শাস্ত্রের পুরোনো সব বিধান, সংকটকালের দায়িত্ব ইত্যাদি ভারতবাসীর মনকে এখন অনুপ্রাণিত করছে। কিন্তু এই পর্বের সমগ্র অভিজ্ঞতার ফলে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের যে মোহ ভঙ্গ হতে শুরু করেছে এবং যে বাস্তব অর্থনৈতিক মন্দায় দেশ পড়েছে তাতে অনেকেই বুঝতে শুরু করেছেন কিম্বা আগামীতে বুঝতে পারবেন যে, নাগরিকদের, শ্রমিকদের স্বস্তায় গোলাম বানিয়ে রাখার রাষ্ট্রীয় মনুবাদী চেতনা অপেক্ষা আম্বেদকার সংকলিত ভারতীয় সংবিধানে দেওয়া অধিকারগুলির গুরুত্ব কতখানি। তাই পরিযায়ী শ্রমিক বনাম স্থানীয় শ্রমিকদের কাজ পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে যে দ্বন্দ্বের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, যার পিছনে সর্বত পরিকল্পনা মাফিক কাজ সারবে সঙ্ঘপরিবার বা বিজেপি, সেই স্থানে আমাদের সংগঠিত করতে হবে শ্রমিক শ্রেণিকে তার হারানো অধিকার ও মর্যাদা ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে। কাজের দাবি বা কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা আগামীতে মৌলিক অধিকারের মধ্যে নিয়ে আসার কথাও উঠতে পারে মানুষের মধ্যে থেকেই। ১০০ দিনের কাজ নয়, বরং সারা বছর মেহনতি জনগনকে কাজ দেওয়া সুনিশ্চিত করো। শুধু ‘আত্মনির্ভরতার’ নামে লোন দিয়ে গুটিকয়ের ব্যবসা খোলানোর কায়দা বন্ধ করো। নতুন পরিস্থিতিতে নতুন আন্দোলন ও বৃহত্তর ঐক্যের সম্ভাবনাগুলোর সন্ধান করতে হবে আমাদের।
-- ফারহান হোসেইন খান