পশ্চিমবঙ্গের নির্মাণ শ্রমিকদের দাবি নিয়ে প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী তারপর শ্রমমন্ত্রীর নিকট অনেক আগেই দাবিপত্র পেশ করা হয়েছিল।মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে খোলা চিটি লেখা হয়েছিল, কিন্তু কোনো সদোত্তর পাওয়া যায়নি। ক্রমশ নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ বিক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। শেষে আমরা ঠিক করি বিগত ২১ মে রাজ্যজুড়ে বিডিও থেকে ডিএম, এএলসি থেকে ডিএলসি মারফত মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দ্যেশ্যে যে যেখানে সম্ভব গণস্বাক্ষর সহ গণডেপুটেশন দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই আমফানের আক্রমনে বাংলা তছনছ হয়ে গেছে। ফলে ডেপুটেশনের দিন পরিবর্তন করে ২৯/০৫/২০২০ শুক্রবার করা হয়। শত বাধা উপেক্ষা করেই কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ২৯/০৫/২০২০ গণ স্বাক্ষর সহ গণডেপুটেশন দেওয়া হয়।
গণডেপুটেশনের মূল বিষয় ছিল – আমাদের হকের অর্থ আমাদের দাও।আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে দাও।
আমাদের রক্ত, ঘাম, পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ পশ্চিমবঙ্গ নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ তহবিলে সঞ্চিত। অথচ আমরা অর্ধাহারে, অনাহারে। অতএব, উক্ত সঞ্চিত তহবিল থেকে সমস্ত নির্মাণ শ্রমিকদের লকডাউন ভাতা হিসাবে ১০০০০ টাকা দেওয়া হোক।
নির্মাণ শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিসনদ নিয়ে রাজ্য সরকারের নিকট বারংবার আবেদন করা সত্বেও সরকারের কর্ণপাত না হলে, লকডাউন উঠে যাওয়ার পর রাজ্য স্তরে বড় বিক্ষোভ কর্মসূচী নেওয়া হবে।
কলকাতা
আমাদের হকের অর্থ আমাদের দিন আত্মসন্মান নিয়ে বাচতে দিন। এই দাবিতে ২৯ মে নির্মাণ শ্রমিকদের রাজ্য সদর দপ্তরে ১৫ জন নির্মাণ শ্রমিক সহ মোট ২০ জন বিক্ষোভ দেখায়। তারা দাবি তোলে নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য নির্মাণ শ্রমিকদের বোর্ডে গচ্ছিত টাকা থেকে সরকারিভাবে নাম নথিভুক্ত শ্রমিকদের ১০০০০ টাকা তাদের ব্যাঙ্ক একাউন্টে দিতে হবে। এর পাশাপাশি নির্মাণ বোর্ডের অন্যতম সদস্য এডিশনাল লেবার কমিশনারের সাথে এক প্রতিনিধিদল দেখা করে দাবিপত্র পেস করে। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু ও প্রবীর দাস। উল্লেখ্য পুরো কর্মসুচীতে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল)-র রাজ্য নেতা জয়তু দেশমূখ ও পশ্চিমবঙ্গ গৃহ ও অন্যান্য নির্মাণ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা স্বপন কুমার রায়চৌধুরীর।
উত্তর ২৪ পরগণা
বসিরহাট-১ ব্লকে বিক্ষোভ কর্মসূচীতে প্রায় ১৭০ জন নির্মাণ শ্রমিক অংশগ্রহণ করেন। ব্লক অফিসের সামনের রাস্তা জুড়ে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নিয়ে তারা দীর্ঘক্ষণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। নির্মাণ শ্রমিকদের ১০০০০ টাকা লকডাউন ভাতার দাবিতে গণস্বাক্ষর সহ ডেপুটেশন চারজনের প্রতিনিধি দল বিডিও-র কাছ তুলে ধরেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন এআইসিসিটিইউ-র অনুমোদিত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের জেলা সভাপতি দেবব্রত বিশ্বাস, হাসানুর জামান মোল্লা, মলয় মন্ডল ও নূর ইসলাম মোল্লা। বিডিও-র সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলে। আলোচনা প্রসঙ্গে বিডিও জানান যে প্রায় ১০০০ পরিযায়ী শ্রমিক আজ বসিরহাটে তাদের ঘরে ফিরেছেন, ফলে প্রশাসন এই নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত।
হাবড়া ব্লক-২ অফিসে এই কর্মসূচীতে নির্মাণ শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছিলো উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আয়ারলার কর্মীরাও এই বিক্ষোভে সামিল হয়। অজয় বসাক, গোবিন্দ টুডু ও নাজিম মন্ডল – এই তিনজনের প্রতিনিধি দল ইউনিয়নের পক্ষ থেকে গণস্বাক্ষর সম্বলিত দাবিসনদ বিডিও-র হাতে তুলে দেন। আলোচনা চলাকালীন প্রতিনিধিরা গ্রামীণ এলাকায় ১০০ দিনের কাজ চালু না হওয়ার অভিযোগ তুললে বিডিও জবাব দেন যে ১০০ দিনের কাজের জন্য শত শত মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন, ফলে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হচ্ছে না বলে কাজ করানো যাচ্ছে না। সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিটি গ্রাম ধরে আলাদা আলাদা কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করার দাবি জানানো হয়।
এই কর্মসূচীর ঠিক এক ঘণ্টা আগে পুলিশ থেকে সংগঠকদের জানানো হয় যে আজকের কর্মসূচীতে ৫ জনের বেশি অংশগ্রহণ করলে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তা সত্বেও শ্রমিকরা কৌশলে একটু দূরে জমায়েত হয়ে শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ দেখান। ঐ ব্লকে পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফিরছেন এবং তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারিনটাইনের চরম অব্যবস্থার ফলে করোনা আক্রান্তদের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অঞ্চলের মানুষ আতঙ্কে লোকালয়ের স্কুলগুলিতে কোয়ারিনটাইনের বিরোধিতা করায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। আর তার সাথেই বেড়ে চলেছে প্রশাসনের প্রতিবাদী কর্মসূচীর উপর বিধি নিষেধ আরোপ।
এরপর নেতৃবৃন্দ অশোকনগর পৌরসভায় যান আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানাতে। পৌরসভা থেকে তাদের জানানো হয় যে শহরাঞ্চলের ক্ষতিপূরণের দাবি জানানোর শেষ দিন গতকালই শেষ হয়ে গেছে। মানুষকে অন্ধকারে রেখে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার এই ধরনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুততার সঙ্গে কয়েকজন নির্মান শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের আবেদন পত্র জমা দিতে তারা সমর্থ হয়। পরে গ্রামীণ অঞ্চলের ক্ষেত্রে এই আবেদনের শেষ দিন কবে তা জানতে চাওয়া হলে বিডিও কোনো সুস্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি।
ব্যারাকপুর ব্লক ১-এর নৈহাটি গ্রামীণ, বীজপুর ও জগদ্দল কমিটির নির্মাণ সংগঠনের কর্মীরা মিলিতভাবে পানপুর ব্লক অফিসে বিক্ষোভে সামিল হন। এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে আয়ারলা-ও যুক্ত হয়। দীর্ঘক্ষণ বিক্ষোভ চালানোর পর চারজনের এক প্রতিনিধি দল বিডিও-র কাছে ৩০০ জনের গণস্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি জমা দেন। আলোচনায় বিডিও জানান গ্রামীণ এলাকায় যে সমস্ত নির্মাণ শ্রমিক কাজ পাচ্ছেন না তারা পঞ্চায়েতে জব কার্ডের জন্য আবেদন করুক। যদি কাজ পেতে অসুবিধা হয় বিডিও নিজে তার সমাধান করবেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন নির্মাণ সংগঠনের জেলা সম্পাদক নারায়ণ রায়, এআইসিসিটিইউ-র জেলা নেতা নারায়ণ দে ও শম্ভু ব্যানার্জী এবং শিবদাসপুর ইট ভাটা মজদুর ইউনিয়নের সম্পাদক সেখ আব্দুল মফিজ।
শিবদাসপুর ইট ভাটায় কর্মরত প্রায় ৯০৭ জন পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের তালিকা এআইসিসিটিইউ-র পক্ষথেকে আগেই বিডিও-র কাছে জমা দিয়ে তাদের ঘরে ফেরানো ও জিআর-এর দাবি জানানো হয়েছিলো। সংগঠনের এই দাবি মেনে ১৫০ জন শ্রমিককে বাসে করে প্রশাসন কয়েকদিন আগেই ঝাড়খন্ডে পৌঁছিয়ে দেয় এবং দুদিন আগে আরো ১৫২ জন পরিযায়ী শ্রমিকের কাছে জিআর-এর চাল পৌঁছিয়ে দেয়। বিডিওর কাছে এই দিন নেতৃবৃন্দ দাবি করে বাকি শ্রমিক পরিবারগুলোর (যারা মূলত বিহার থেকে এসেছেন) কাছেও জিআর পৌঁছানোর ও তাদের ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করার।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা
বিষ্ণুপুর-২ নং ব্লকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। সাঁজুয়া নতুন রাস্তার মোড় থেকে বিবিরহাটে ব্লক অবধি মিছিল করে নির্মাণ শ্রমিকরা ব্লকে উপস্থিত হয়। মিছিল শেষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে জমায়েত করে কেন্দ্র রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায় নির্মাণ শ্রমিকরা। জমায়েতে বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা কমিটির সদস্য কমরেড শুভদীপ পাল।ডেপুটেশনের প্রতিনিধি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ গৃহ ও নির্মাণ শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়নের জেলা কমিটির সদস্য কমরেড নিখিলেশ পাল।
পশ্চিম বর্ধমান
আসানসোলে যুক্ত শ্রমিক কমিশনরের কাছে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়। সকাল ১০টা থেকে আসানসোল বিএনআর রবীন্দ্র ভবনের সামনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে জমায়েত করে প্রায় দুই ঘণ্টা বক্তব্য রাখার পর স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়।