স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর ন্যায়সংগ্রামের পাশে দাঁড়ান
swa

ভারত সরকারের সর্বাধিনায়ক আত্মনির্ভর ভারত গড়ার ডাক দিয়েছেন এবং সেজন্য ২০ লক্ষ কোটি টাকার (এর মধ্যে কতটা ফাঁপাপনা আছে, সে আলোচনায় আমরা যাচ্ছি না) প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন।

একটি দেশ আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে তখনই, যখন তার নাগরিকরা, তার গরিব-মেহনতি নারী-পুরুষেরা, আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মাথা তুলে নিজেদের পায়ে দাঁড়ান। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা নির্বাহ মিশন (এনআরএলএম)-এর প্রায় এক কোটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী। সম্প্রতি এ কথা খুব ভালো ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ভারত সরকারের গ্রামীণ বিকাশ মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুসারে, এ বছর ১৫-৩০ মার্চের মধ্যে ১৪,৫২২টি গোষ্ঠীর ৬৫ হাজার ৯৩৬ জন সদস্য ১৩২ লক্ষ মাস্ক তৈরি করেছেন। এই গোষ্ঠীগুলো ভারতের চব্বিশটি রাজ্যের মোট ৩৯৯ জেলায় ছড়িয়ে আছে। এ থেকেই বোঝা যায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর কর্মক্ষমতা এবং দেশের প্রয়োজনে বড় ভূমিকা নেওয়ার দক্ষতা কত বেশি। তবে এখানে সমস্যাও আছে অনেক। যেমন বিহার সরকার ঘোষণা করেছিল গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে প্রচুর মাস্ক তৈরি করা হবে, যাতে প্রত্যেক পরিবারকে চারটি করে মাস্ক দেওয়া যায়। কিন্ত বাস্তবে অল্প কয়েকটি গোষ্ঠীকেই এই কাজ দেওয়া হয়। তাঁরা যথাসময়ে মাস্ক তৈরি করলেও তাঁদের কাছ থেকে সরকার তা কিনছে না। অর্থাৎ সেই গোষ্ঠীগুলো আরো বিপদে পড়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, সরকারের সদিচ্ছার ওপরই সব কিছু নির্ভর করে।

এটা খুব পরিস্কার যে, সরকার নেহাত দায়ে পড়েই গোষ্ঠীগুলোকে সবচাইতে সস্তায় মাস্ক তৈরির অর্ডারটা দিয়েছিল। এটা ছিল নেহাতই ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ। কিন্তু ঠিকমত কাঁচা মালের অপ্রতুলতা ও বাজারের অভাব – এই দুটো মূল সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধানের সদিচ্ছা ভারত সরকার দেখায়নি। বহু বিজ্ঞাপিত আর্থিক প্যাকেজে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর জন্য শুধু দুটি ঘোষণা আছে। তা হল, এই বছর তাঁদের ঋণ শোধের কিস্তি দিতে হবে না এবং এখন থেকে তাঁরা বছরে ১০ লক্ষর বদলে ২০ লক্ষ টাকা ঋণ নিতে পারবেন। কিন্তু এতে গোষ্ঠীগুলোর কোনো সুরাহা হবে না। কারণ ঋণ মকুব করা হচ্ছে না, পুরনো ও নতুন ঋণ পরে এক সাথে শোধ করতে হবে। সেটা ঋণের বোঝায় ভারাক্রান্ত এই গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অথচ বেসরকারী মাইক্রো ফিনানস কোম্পানিগুলো (যাদের দাপট অন্ধ্র প্রদেশে সবচাইতে বেশি) এবং পশ্চিমবঙ্গে বন্ধন ব্যাংকের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে পাত্তা না দিয়ে এখনই কিস্তি শোধ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। এটা বন্ধ করার জন্য রাজ্য বা কেন্দ্র কোনো সরকার অথবা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কেউই কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না!

hg

 

আমরা জানি, কেন্দ্রীয় সরকার প্রায়শই বড় বড় পুঁজিপতিদের বিপুল পরিমাণ ঋণ মাফ করে দিয়ে থাকে। তথাকথিত ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজেও এ জন্য সংস্থান রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন এমনটা করা হবে? ধনকুবেরদের কাছ থেকে সব টাকা আদায় করা, আর গরিব মহিলাদের, কৃষকদের, অন্যান্য শ্রমজীবীদের ঋণ মকুব করা -- এই নীতিই কি ন্যায়সংগত নয়? এ কথাও মনে রাখা উচিত যে মাল্য-চোকসি-নীরব মোদীর মতো ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট অর্থাৎ সাঙাত পুঁজিপতিরা যেখানে সরকারী ব্যাংকের টাকা চুরি করে বিদেশে পালায় সেখানে স্বনির্ভর সংস্থাগুলোর ঋণ-পরিশোধের রেকর্ড অত্যন্ত ভালো। সুতরাং আজ যখন লকডাউনের মারে তাঁরা বিপর্যস্ত, পশ্চিমবঙ্গে যখন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে নেমে এসেছে উমপুনের ধ্বংসলীলা, তখন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে অবশ্যই কার্যকরীভাবে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

এবং তা কেবল গোষ্ঠীর সদস্যদের স্বার্থে নয়। দেশ এবং দশেরও স্বার্থে। ভারতীয় অর্থ ব্যবস্থা এখন গভীর মন্দায় তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এর মোকাবিলায় একটি ইঞ্জিন হল বিনিয়োগ আর একটি হল কার্যকরী চাহিদা বা সোজা কথায় মানুষের হাতে কিছু টাকাপয়সা, যা দিয়ে তাঁরা কেনাকাটা করবেন। বিপুল সংখ্যক স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ঋণ মকুব করে দিয়ে নতুনভাবে বিনা সুদে ঋণ দিলে কি ঘটবে? তাদের একাংশ সেই অর্থ ছোটখাটো কারবারে বিনিয়োগ করবে, যেটা সবচেয়ে বাঞ্ছনীয়। আর যেসব গোষ্ঠী নানা কারণে সেটা পেরে উঠবে না তাদের সদস্যরাও সেই টাকা দিয়ে বাজার থেকে কিছু না কিছু কিনবেন। এটাও বাজারকে চাঙ্গা করতে কিছুটা হলেও অবদান রাখবে।

এই সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেতৃত্বে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলো ২৯ মে দেশের বহু জায়গায় ধরনা প্রদর্শন করে। মূল দাবি ছিল :

* সমস্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সরকারি - বেসরকারি ঋণ মকুব করতে হবে ।
* মাইক্রো ফিনানস কোম্পানী থেকে নেওয়া ঋণ সরকারকে পরিশোধ করতে হবে।
* লকডাউন শিথিল হওয়ার সাথে সাথে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলো যাতে আবার কাজে নামতে পারে সেজন্য তাঁদের বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে।
* স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোকে উৎপাদনের উপকরণ সরবরাহ করতে হবে ও উৎপন্ন দ্রব্য সরকারকে কিনে নিতে হবে ।
* স্বনির্ভর গোষ্ঠী, পঞ্চায়েত, বিডিও ও ব্যাংকের সমন্বয়কারী (সিএসপি)-কে মাসিক নূন্যতম ১৫০০০ টাকা পারিশ্রমিক দিতে হবে।

pat

 

এই সমস্ত দাবি নিয়ে বিহার, ঝাড়খণ্ড, উওরপ্রদেশ, উওরাখন্ড, কার্বি আংলঙ, আসাম, উডিষ্যা, রাজস্থান, পাঞ্জাব, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাডু, কর্নাটক সহ আরো কিছু জায়গায় প্রতিবাদী ধরনা সংগঠিত হয়। সর্বত্রই ব্যাপক এবং বহুলাংশে স্বতঃস্ফূর্ত গণ সমাবেশ দেখা যায়।

পশ্চিমবঙ্গে হাওড়ায় আইপোয়ার জেলা সম্পাদিকা কমরেড কল্যাণী গোস্বামীর নেতৃত্বে দুটি ব্লকে কর্মসূচী পালিত হয়। আমতার তিনটি এলাকায় “আশার আলো” নামে গোষ্ঠীর মহাসংঘের পক্ষ থেকে কমরেড অঞ্জনা মন্ডলের উদ্যোগে এবং বাগনানে বাঙ্গালপুর অঞ্চলে “মাতংগিনী” ও “বিবেকানন্দ” নামে দুটি গোষ্ঠী একসাথে পোস্টার সমেত বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। গোষ্ঠীর মহিলাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মেজাজ ছিল চোখে পড়ার মতো।

কলকাতার যাদবপুরে শহীদ নগর অঞ্চলে আইপোয়ার নেতৃবৃন্দ পোস্টার সমেত বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। কর্মসূচীর নেতৃত্বে ছিলেন রাজ্য সম্পাদিকা কমরেড ইন্দ্রাণী দত্ত। একই সাথে প্রবীণ বিপ্লবী সাংস্কৃতিক কর্মী ভারভারা রাও-এর মুক্তির দাবিও তোলেন কমরেডরা।

polb

 

হুগলি জেলার পোলবা ব্লকে এই দিন বেলা ১১টা থেকে বিডিও অফিসে বিক্ষোভ অবস্থান ও ডেপুটেশন কর্মসূচী নেওয়া হয়। লকডাউনে যানবাহন প্রায় বন্ধ থাকলেও গোষ্ঠীর মহিলারা দলে দলে যথাসময়ে সমাবেশিত হন। পোস্টার সমেত সুসজ্জিত অবস্থান শুরু হয়। বেলা যত বাড়তে থাকে মুখে মুখে আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে এবং সন্ধ্যা ৬টায় বিক্ষোভকারীর সংখ্যা প্রায় ৩০০ দাঁড়ায়। আইপোয়ার পক্ষ থেকে বিডিও-কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।

এই কর্মসূচী সফল করার জন্যে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির উদ্যোগও থাকে। গোটা আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেন আইপোয়া জেলা সদস্যা কমরেড অর্পিতা রায় ও পার্টির ও কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির রাজ্য নেতা কমরেড সজল অধিকারী সহ অন্যান্য জেলা ও ব্লক নেতৃবৃন্দ। ঋণ মুক্তির দাবিতে আগামীদিনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। আইপোয়ার জেলা কমিটির পক্ষ থেকে একই দিনে জেলা শাসকের কাছেও ডেপুটেশনের কপি ই-মেইল করা হয়।

-- চৈতালি সেন 

খণ্ড-27