তেত্রিশ ফুট গাছের ডালে ঝুলছে ঘরের চাল। ঝড় এসেছিল কুড়ি বাইশ দিন আগে। এখনও ঘর সারাই করা যায়নি। ঘরের ঝুলন্ত চালের দিকে আঙুল তুলে মাহিরা বেওয়া বলল, ‘কেমন আছি বুঝতে পারছেন তো?’ ইঁটের সরু রাস্তাটা মূল রাস্তা থেকে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে নদী বাঁধ পর্যন্ত। পথের দু’পাশে নীচু চাষের জমির আর অস্তিত্ব নেই। পুরোটাই জলের তলায়। মাথা উঁচিয়ে থাকা রাস্তাটাও জলে থইথই। হাঁটু অব্দি জলে ডোবা ঐ পথেই পৌঁছলাম নদীবাধের কাছে। হিঙ্গলগঞ্জের লস্করভেড়ির মানুষ গুলো বাঁধ বাঁচানোর লড়াইটা শুরু করেছেন আবার। দিন চারেক আগে বাঁধা হয়েছিল ভাঙা বাঁধটি। নতুন করে ভেঙে পড়া বাঁধের সামনে মানুষের জটলাটা এখনো একই রকম। লড়াইটা জারি রেখেছেন আজো। চোখেমুখে সব হারানোর হতাশা। চারপাশে জলে ভাসছে মরা গরু, ছাগল, মাছ। খাবার নেই। জল নেই। খালি পেটে বমি ওঠার যোগাড় দুর্গত মানুষগুলোর।
এর মধ্যেই চোখে পড়ল চেনা মুখ। সুভাষ দাশ। হতাশ চোখে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সুভাষ বললেন, জমিটা বাঁচাতে পারলাম না। ঐ দেখুন আমার জমি। সম্বচ্ছরের চালটা ওখান থেকেই হয়ে যায়। এখন সেখানে জোয়ারের পানি। কথা হল শিবচন্দ্রপুরের গোপাল নস্করের সঙ্গেও। প্রতিবেশির বাড়িতেই রয়েছেন গোপালবাবু পুরো পরিবার সহ। কোনো ত্রিপল এখনো জোটেনি তাঁদের। এর আগেও বেশ কয়েকবার ঝড়ে উড়েছিল বাড়ির চাল। কোনো এক রাজনৈতিক প্রতিনিধি এসে বলেছিলেন একটু শক্তপোক্ত করে খুঁটি পুঁততে পারেন না যাতে ঝড় বৃষ্টি এলেই এভাবে ক্ষতির শিকার হতে না হয়। ইটভাটায় ফাইফরমাশ খাটা গোপালবাবু সেই রাজনৈতিক প্রতিনিধিদলকে বোঝাতেই পারেননি যে ইটভাটায় কাজ করলেও নিজের বাড়ি তৈরির জন্য একটা ইট কেনার সামর্থ্য ও তাঁর নেই, শক্তপোক্ত বাড়ির স্বপ্ন তাই তাঁর কাছে অধরাই থেকে যায়। উত্তর ২৪ পরগণার দেগঙ্গায় পূজা দে-র উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা এখনও বাকি আছে দুটো। আমপানে বইপত্র তো বটেই, অ্যাডমিট কার্ড ও ভেসে গেছে। পাশের গ্রাম নস্করঘেরির প্রভাত নস্করের বড় ছেলে সুবলের বড় পছন্দ পূজাকে। ছেলেটার মাথায় একটু ছিট মতো আছে। তাই এতদিন পূজার মা বিরোধ করছিল, কিন্তু আর বোধহয় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। আর ঠেকিয়ে হবেই বা কী? মনে আশা ছিল মেয়েটা পাশ দিলে কোথাও একটা কাজ-টাজে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। তিনু দাদা ওরকম বলেছিল। এখন কোথায় কী? তিনু দাদা নাকি বিজেপিতে লাইন মারছে। তার চেয়ে বরং এই ভালো। প্রভাত নস্করের জমিজিরেত আছে অনেকখানি। মেয়েটার ভাতের অভাব হবে না। আর মেয়েমানুষের কপালে যা লেখা আছে তাইতো হবে।
একটু এগোতেই দেখা গেল রাস্তার দু’পাশে মাটিতে মিশে গেছে মেছোভেড়ির আলঘর। মিষ্টি জলের পুকুরে নোনা জল ঢুকে মাছ মরে গেছে। হিঙ্গলগঞ্জের রূপমারী পঞ্চায়েত এলাকায় বাগধারা গ্রামের ছবিটা এখন এমনই। আমপানে ঘর ভেঙেছে। বাঁধ ভেঙে ভাসা নদীর জল ভাসিয়েছে জমিজিরেত। আপাতত বাঁধের উপরে কাটছে দিনরাত। চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে মৃত পশুর দেহ, মরা মাছ। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, এভাবে জমা জলে মরা পশু পড়ে থাকলে যেকোনও সময় সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এই জল পেটে গেলে তো আর রক্ষা নেই। কিন্তু কোনো উপায় নেই। স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, প্রতিটি মানুষের কাছে দ্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিতে হবে। পানের অযোগ্য জল খেয়ে পেটের রোগ ছড়াবে। বাচ্চারা দ্রুত আন্ত্রিক জন্ডিসে আক্রান্ত হতে পারে। রূপমারী গ্রামের বাদল ঘোষ জানান, জমিটা বাঁচাতে পারলাম না। ঝড়ের পর থেকে খাবার নেই। জল নেই। ত্রাণ নিয়ে রাজনীতির পুরোনো খেলা মাথাচাড়া দিচ্ছে ইতিউতি। তা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। তবে সব হারানো মানুষগুলোর হা-হুতাশ ঐ জলে ডুবে যাওয়া ধান আনাজের জমি ঘিরে।
স্থানীয় বাসিন্দারাই হিসাব দিলেন এলাকায় প্রায় এক হাজার বিঘা চাষের জমি জলের তলায় চলে গেছে। ধানের জমি তো বটেই, গাছ ভরা উচ্ছে, ঝিঙে, ঢেড়শ সবই জলের নীচে। বিঘের পর বিঘে জমি জুড়ে ভাসছে পানের বরজ। বিস্তীর্ণ সেই জমির ওপর দিয়ে ঢুকছে জোয়ারের জল। জমি এখন নদীই। জমিতে জোয়ার ভাটা খেলছে। কংক্রিটের বাঁধ ছাড়া এ জমিতে রাখার কোনো উপায় নেই। ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল হকার ভাইদের দলটির সঙ্গে। মুড়ি-ঘুগনির ব্যবসাদার স্বরূপ ঘোষ মুড়ি এনেছেন, মুদিখানার দোকানদার সঞ্জু দেবী শাহ মুদিখানার জিনিসপত্র চাল গাল আলু পিঁয়াজ সয়াবিন এনেছেন, ফাস্টফুডের দোকানদার রাম নস্কর পেটি ভরে ডিম এনেছেন আমপান-ধ্বস্ত স্বজনদের জন্য। তাই নিয়েই ঘুনি শকুন্তলার সোমাইয়া বিবি, ঝর্ণা বৌদি, কিশোরী ঝাঁরা বেশ খুশি। তবে ত্রাণ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে প্রচুর জায়গাতেই। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে পর্যাপ্ত চিঁড়ে গুড় চাল ডাল তেল নুন পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন চাল ডাল যে ফুটিয়ে খাব তার জ্বালানি কোথায়? একটুকরো শুকনো কাঠের টুকরোও তো নেই।
নদী বাঁধ ভাঙার পর থেকেই নেতারা এসেছেন। বাঁধ পরিদর্শন করে ফিরেও গেছেন। দ্রুত বাঁধ মেরামতির আশ্বাস দিয়ে গেছেন। মানুষ বলছেন, খাবারের ব্যবস্থা হয়তো হবে, মাথা গোঁজার একটা ঠাঁইও হয়ে যাবে। কিন্তু নোনা জল ঢোকা চাষের জমিতে চাষ কি আর হবে? এরই মধ্যে কোত্থেকে একটা প্লাস্টিক যোগাড় করে সেটা চাল উড়ে যাওয়া ঘরের একদিকে টাঙানোর চেষ্টা করছিলেন সুধীন মন্ডল। চারপাশে খোলা হাওয়ার সঙ্গে যুঝে যাওয়ার একটা ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। কথায় ঝরে পড়ছিল চূড়ান্ত হতাশা – এই হল আমাদের ভবিতব্য। বারবার ঘর ভাঙবে। আর আমরা জোড়াতালি দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাব।
-- সুতপা চক্রবর্তী
(লেখিকা কালান্তর পত্রিকার সাথে যুক্ত)