মাস খানেক আগে সুইডেনের গোঠেনবারগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের প্রকাশ করা বিশ্বে গণতন্ত্রের হালচাল সম্পর্কিত রিপোর্টে ভারতকে রাখা হয়েছে “স্বৈরতন্ত্রমুখী দেশসমূহের” বর্গতে। ওই অভিমতের কারণস্বরূপ বলা হয়েছে “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের অধীনে সংবাদ মাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং বিরোধী পক্ষের পরিসর তীব্র মাত্রায় সংকুচিত হয়ে যাওয়া।” প্যারিস ভিত্তিক রিপোর্টারস উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্স-এর ২০২০-র এপ্রিলের রিপোর্টে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার তালিকায় ভারতের স্থান ১৮০টা দেশের মধ্যে হয়েছে ১৪২ নম্বরে, যা ২০১৯-এর অবস্থানের দু-ধাপ নীচে। এত নীচে অবস্থানের কারণ হিসাবে রিপোর্টে সাংবাদিক-বিরোধী হিংসা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষয়, মিডিয়ার কণ্ঠরোধ বেড়ে চলা, মিডিয়ার ওপর সরকার ও রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা, ইত্যাদির উল্লেখ করা হয়েছে।
ওপরে যে দুই বিদেশী সংস্থার মূল্যায়নকে তুলে ধরা হল, তার সঙ্গে আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হুবহু মিলে যায়। সাধারণভাবে মিডিয়ার টিকে থাকার জন্য তাদের সরকারী ও কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এরপর সরকার অনুগত হওয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে ছাপা ও বৈদ্যুতিন উভয় সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীন কার্যকলাপে বিপর্যয় না এসে পারে না। হুমকি ও ভীতির পরিমণ্ডলকে উপেক্ষা করে যে সমস্ত সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিক নিজেদের বিকিয়ে না দিয়ে, সরকারী প্রসাদের প্রলোভনকে তুচ্ছ করে নিজেদের পেশার নৈতিকতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেন, সরকারী রোষ তাদের শিক্ষা দিতে উদ্যত হয়। অনেকেরই ঠাঁই হয় জেলে, এফ আই আর-এর মুখে পড়তে হয় বহু সংখ্যককে, কাউকে-কাউকে আবার দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়। গীতা সেসু ও ঊর্বশী সরকার তাঁদের “খুন করেও পার পেয়ে যাওয়া” শীর্ষক গবেষণামূলক রিপোর্টে জানিয়েছেন, ২০১৪ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে সাংবাদিকদের ওপর অন্ততপক্ষে ১৯৮টা গুরুতর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এগুলোতে ৪০ জন সাংবাদিক নিহত হন যার মধ্যে কম করে ২১টার যোগ খুঁজে পাওয়া যায় সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের মধ্যে। দিল্লীর রাইটস অ্যান্ড রিস্ক এনালিসিস গোষ্ঠীর সমীক্ষাও জানিয়েছে — এ বছরের ২৫ মার্চ (যে দিন মোদী লকডাউন নামান) থেকে ৩১ মে-র মধ্যে মহামারী সংক্রান্ত রিপোর্ট করার কারণে রাষ্ট্রের ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাতে অন্ততপক্ষে ৫৫ জন সাংবাদিকের ওপর নিপীড়নের খাঁড়া নেমে এসেছে। গ্ৰেপ্তার হওয়া ও এফআইআর-এর মুখে পড়া ছাড়াও অনেকের ওপর দৈহিক আক্রমণ নেমেছে, তাদের ভয়ানক পরিণতির হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং এমনকি কিছু সম্পত্তিও নষ্ট করা হয়েছে। লকডাউন পর্বে মহামারী নিয়ন্ত্রণে সরকারী ব্যর্থতার সমালোচনা করার জন্যই যে রাষ্ট্রশক্তির ওই চোখ রাঙানি তা না বললেও চলবে। তবে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারই নয়, বিজেপি ও অ-বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্য সরকারও সাংবাদিক পীড়নে এগিয়ে আসতে দ্বিধা করেনি। রাইটস এন্ড রিস্ক-এর ডাইরেক্টর সুহাস চাকমা বলেছেন, “বিশ্বের মধ্যে ভারতই সাংবাদিকদের কাছে সবচেয় বিপজ্জনক স্থান হয়ে উঠেছে। মহামারী শুরু হওয়ার সময় থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড-১৯ সম্পর্কে ইচ্ছাকৃত বা অযথার্থ রিপোর্টের যুক্তিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে দমন করতে উদ্যত হয়েছে।”