দ্বিতীয় দফায়, ১৭ই জুন ২০২০, আমফান ঝড়ে বিধস্থ উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হাসনাবাদ ব্লকের চক পাটলি খানপুর পঞ্চায়েতের বেলিয়াডাঙ্গা, টিয়ামারী ও জয়গ্রামের বিপন্ন মানুষের পাশে আমরা হাজির হয়েছিলাম ত্রাণসামগ্রী নিয়ে। এবারের ত্রাণ কাজে আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন ছাত্র নেতা রুদ্রর নেতৃত্বে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা, ছিলেন আইসার রাজ্য সম্পাদক স্বর্ণেন্দু এবং রুমেলা, অন্বেষা, নাতাশা, অনন্যা, বর্ষা সহ ১৭ জন ছাত্র-ছাত্রী, ছিলেন এআইসিসিটিইউ, আয়ারলা, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ ও এআইপিএফ-এর নেতৃবৃন্দও। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং বিভিন্ন গণসংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় “নাগরিক উদ্যোগ”-এর মাধ্যমে এই ত্রাণ কার্য পরিচালনা করা হয়। প্রথম দিনের মতই এদিনের এই কর্মসূচীর ব্যবস্থাপনায় ছিল বসিরহাটের পশ্চিমবঙ্গ গণ সংষ্কৃতি পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ‘নির্মাণ সাংস্কৃতিক সংস্থা’। নাগরিক উদ্যোগের এই কাজে সহযোগিতা করতে পাশে ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা নেতৃত্বও।
চিঁড়ে, ছাতু, বিস্কুট, বাতাসা, ওআরএস, সাবান, রিচার্জেবল টর্চ, খাতা-পেন সহ দুই গাড়ি ত্রাণ সামগ্রী গ্রামগুলোর ৫০০ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রচন্ড বৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করেই ত্রাণ সামগ্রী বিলি করার পাশাপাশি ছাত্র ছাত্রীরা গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলেন এবং অনুসন্ধানমূলক কাজও চালান। বহু মানুষ আসেন জল পেরিয়ে, তাঁদের হাতে একে একে তুলে দেওয়া হয় ত্রাণসামগ্রী। ডাঁসা নদীর বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত এই অঞ্চলে জল কিছুটা কমলেও এখনো অনেক মানুষ ঘর ছাড়া, অনেকের ঘর ভেঙ্গেও গেছে। এখনো ধান ক্ষেতগুলোতে লোনা জলে পরিপূর্ণ, তারই মাঝে জেগে উঠেছে পায়ে চলা আল পথ। সেই পথ ধরে প্রায় এক দেড় কিমি পায়ে হেঁটে বা কোথাও জল ডিঙিয়ে টিয়ামারী গ্রামের লোকজন এসেছেন ত্রাণ সংগ্ৰহ করতে।বেলিয়াডাঙ্গা গ্রামের মুদিখানা দোকান চালান ওমপ্রকাশ দাস জানালেন, “তৃষা ভাটার কাছে যে বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল তা স্থানীয় ঠিকাদারের মাধ্যমে জোড়াতাপ্পি দিয়ে কোনোমতে মেরামত করা হয়েছে বটে তবে আবার কবে ভরা কোটালের জলের ধাক্কায় ভেঙে পড়বে তা কেউ বলতে পারে না।” এদিকে জলমগ্নতার দরুন তার দোকান বন্ধ, রুজিরোজগার নেই, তাই দুঃখ করে বললেন,’ ৫ জনের সংসার চালানোই এখন দায়। বাড়িতে রান্নাবান্না হচ্ছে না, ওই নানা সংস্থার লোকেরা দুপুরে একটা রান্না করা ভাত ডাল দেয়, সেটাই খাই, শুকনো খাবার দিয়ে গিয়েছিল আপনাদের মতোই দাদারা, সেই দিয়েই চলে যায় কোনোরকমে। ব্যবসার পুঁজিও শেষ। কীভাবে যে চলবো?” জানালেন, সরকারী কুড়ি হাজার টাকার সাহায্য পাননি, দরখাস্তই জমা নিচ্ছে না তৃণমূলের মেম্বার সুদীপ দাস। ওপর দিকে সেই চেনা ছবি ফুটে উঠেছে, সরকারী ত্রাণ বিলিবন্টন নিয়ে পঞ্চায়েতের মেম্বার থেকে তৃণমূলের প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে। অভিযোগ ঝড়ে পড়লো আরিপাড়া খালের পাড়ের খাদিজা বিবির গলায়। পেশায় তার স্বামী একজন ভ্যান চালক, কাজ বন্ধ, তিনি নিজেও বিড়ি বাঁধার কাজের সাথে যুক্ত, তিনি জানালেন, “আমাদের বড্ড কষ্ট, ঠিক মতো খেতেও পাই না, কোলের ছেলেটার মুখে যে দুমুঠো দেবো, তারও উপায় নেই! ভরসা বলতে এই আপনাদের মতো লোকজন, প্রধান একবারের জন্য গ্রামে আসেনি। রেশনের চাল পেয়েছি, কিন্তু রান্নাবান্না করার সব সরঞ্জাম ভেসে গেছে।চারিদিকে জল, দু-একজনের বাড়িতে গ্যাস আছে, তাদের রান্না হয়, আমরা শুকনো মুড়িটুরি খেয়ে কোনো রকমে টিকে আছি আমরা!”
ত্রাণের কাজের পাশাপাশি AISA-র বন্ধুরা মানুষের সাথে কথা বলেছেন, কিছু অভিজ্ঞতার কথা জানালো অন্বেষা, “আর সামান্য কৃষিকাজই ভরসা, গ্রামগুলোর বেশিরভাগ মানুষই কাজ করেন ভেরিতে, ইট ভাটায়, বিড়ি বাঁধার কাজ অথবা তামিলনাড়ু এবং অন্যান্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে। লকডাউনের কারনে দীর্ঘদিন ধরে তাদের কাছে উপার্জন বন্ধ, আয়ের অন্য কোনো মাধ্যমও নেই। আর এই আমফানের জন্য সেই দুর্ভোগ চরম সীমায় পৌঁছেছে। রাজ্য সরকার এনাদের জন্য শুধু কিছু চিঁড়ে-গুড়ের বন্দোবস্ত করেই হাত তুলে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে গ্রামবাসীদের ব্যাংক একাউন্টে যে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছিল তা কিছু লোকের একাউন্টে ঢুকেছে, কারো ঢোকেনি। স্থানীয় এক মহিলা বললেন “এতে কি হবে? কিছুই হবে না।” ঝড়ের সময় যখন গভীর রাতে জল ভীষণ স্রোতে ঢুকতে শুরু করলো গ্রামে তখন সবাই এলোপাথারি ছুটছে। “পালাও পালাও! নাহলে সব কিছু চলে যাবে” — এবং সব কিছুই চলেও গেছে, শুধু মানুষগুলো রয়ে গেছে। গবাদি পশু, দরকারি নথি-পত্র সব নিয়ে গেছে নদী। কোনরকমে তারা শুধু নিজেদেরকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন ঘর থেকে। তাঁদের দিন চলছে এই বিভিন্ন ত্রাণের উদ্যোগের ভরসায়। মহিলারা বললেন যে অনেকের রান্নাঘর হয় ভেঙে গেছে নয় পুরো কাদায় ভর্তি। রান্না করা তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না। জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম যে সরকারের পক্ষ থেকে ছোটো শিশুদের জন্য দুধ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। নাই নাই অবস্থায় কুড়িয়ে কাচিয়ে দিন কাটছে।
গ্রামের মানুষেরা আরো অভিযোগ করে বললেন যে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশ্নেও সরকার সেভাবে কোনোরকম উদ্যোগ নেয়নি, সেক্ষেত্রেও ভরসা সেই বিভিন্ন ত্রাণের উদ্যোগ।
এলাকার ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার বই ঝড়জলে নষ্ট হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে। নতুন বই কেনা এখন অনেকের ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য ব্যাপার।
ত্রাণ বন্টনের কাজ শেষ করে স্থানীয় পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করা থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্লিপ পৌঁছে দেওয়ার কাজ গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে করেছিলেন যারা, তারা কয়েকজন ও অন্যন্য কিছু গ্রামবাসীকে যুক্ত করে নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গাড়ি করে হাসনাবাদ স্টেশনের কাছে বিডিও অফিসে যাওয়া হয়। হাসনাবাদের বেলিয়াডাঙ্গার, টিয়ামারী গ্রামের মানুষের জীবন জীবিকার জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে একটি দাবিপত্রসহ মিছিল সহযোগে হাসনাবাদের বিডিওকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ডেপুটেশন টিমে উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ-র কম: দেবব্রত বিশ্বাস, এআইপিএফ-এর নেতা কমরেড নির্মল ঘোষ ও হাসনাবাদের গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে কমরেড মোকসেদ মিস্ত্রি। ডেপুটেশন চলাকালীন বিডিও অফিস চত্বরের বাইরে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক কমরেড সুব্রত সেনগুপ্ত, জেলা নেতা কম: শিবশঙ্কর গুহরায় ও ছাত্র নেতা সৌমেন্দু। জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত তার বক্তব্যে বলেন, “এভাবে ত্রাণ দিয়ে দিয়ে আর কত দিন চলবে? এই অঞ্চলের মানুষদের বাঁচানোর জন্য, সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্য সরকারকে উপযুক্ত পরিকল্পনা নিতে হবে, নদীবাঁধগুলো রক্ষণাবেক্ষণের সুষ্ঠ ব্যবস্থা, প্রয়োজনে কংক্রিটের বাঁধ দিতে হবে, বার বার বাঁধ ভেঙে মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়বে, এটা বেশি দিন চলতে পারে না, এর জন্য চাই স্থায়ি সমাধান।” প্রতিবাদ সভায় স্বভাবসিদ্ধ উদাত্ত গলায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন গণশিল্পী কমরেড বাবুনী মজুমদার। বিডিওর কাছে ডেপুটেশন দিয়ে ফিরে এসে সমবেত জনতার সামনে বক্তব্য তুলে ধরেন প্রতিনিধিদলের পক্ষে কমরেড নির্মল ঘোষ, তিনি বলেন, “বিডিও জানিয়েছেন অবিলম্বে গ্রামগুলোতে জলের জন্য ১০০টি ডিপ টিউবয়েলের ব্যবস্থা করা হবে এবং তার জন্য বিডিও ওপরতলায় চিঠিও পাঠিয়েছেন বলে প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করেন। আবার এমন কথাও শুনিয়েছেন, ‘আপনারা জায়গা ঠিক করেদিন, রেসকিউ সেন্টার গড়ে দেবো।’
বিডিওর কাছে গ্রামের মানুষের নিম্নলিখিত জ্বলন্ত দাবিগুলো পেশ করা হয় –
আগামী ২৭ জুন ঐ গ্রামগুলোতে ওষুধপত্র সহ একটি মেডিক্যাল টিম নিয়ে যাওয়া হবে বলে নাগরিক উদ্যোগের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আইসার পক্ষ থেকেও ঐ অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য যোগাযোগও প্রস্তুতি চালানো হচ্ছে।
ফিরে আসার সময় একজনের কথা কানে খুব বাজছিল, “শুনেছি সরকার থেকে নাকি ২৪ লক্ষ টাকা এসেছিল বাঁধ বানানোর জন্য। আমরা তো একদম নীচের লেভেল, আমাদের কাছে কিন্তু কিছুই পৌঁছায় না। তার আগেই সব উপরে উপরে কাজ হয়ে যায়”। এই হলো তাঁদের জীবন ও যন্ত্রণার জলছবি।
(হাসনাবাদ থেকে ফিরে — দেবল, বারাসাত)