রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর করা তিনটি অধ্যাদেশ : মূল মূল পয়েন্ট
ordinance

গত ৫ জুন একই দিনে রাষ্ট্রপতি তিন তিনটি অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেছেন।

অধ্যাদেশগুলির প্রথমটির নাম : দি ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড এন্ড কমার্স (প্রোমোশন এন্ড ফেসিলিটেসন = উৎসাহ ও সহায়তা প্রদান) অর্ডিনান্স ২০২০। দ্বিতীয় অধ্যাদেশটির নাম : দি ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট এন্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসিওরেন্স এন্ড ফার্ম সার্ভিসেস অর্ডিন্যান্স ২০২০। তৃতীয় অধ্যাদেশটির নাম : দি এসেনসিয়াল কমোডিটিস (অ্যামেন্ডমেন্ট অর্ডিন্যান্স ২০২০।

প্রথম অধ্যাদেশটির ঘোষিত উদ্দেশ্য : কৃষকের ফসলের ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যাতে কৃষক পছন্দমতো লেনদেনের স্বাধীনতা পান – যার ফলে ব্যবসায় প্রতিযোগিতামূলক বিকল্প পথ খুলে গিয়ে লাভজনক দাম পাওয়ার সুবিধা বৃদ্ধি হয়। কৃষিপণ্যের আন্তঃরাজ্য ব্যবসা অবাধ হতে পারে, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের নির্ধারিত কৃষিপণ্য বাজারের বাইরেও ক্রয় বিক্রয় সম্ভব হয় এবং অনলাইনে বাণিজ্যের কাঠামো গড়ে তোলা সহজতর হয়।

অধ্যাদেশটিতে ৪টি পরিচ্ছেদ (চ্যাপটার) আছে। প্রথম পরিচ্ছেদে (১) ‘কৃষকের উৎপাদিত ফসল’, (২) ‘বৈদ্যুতিন বাণিজ্য ও লেনদেনের মঞ্চ’, (৩) ‘কৃষক’, (৪) ‘কৃষক উৎপাদক সংগঠন’, (৪) ‘বাণিজ্যিক (ট্রেড) এলাকা’ ইত্যাদি শব্দ বা শব্দবন্ধের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

padd

 

কৃষকের উৎপাদিত ফসলের মধ্যে চাল, গম থেকে শুরু করেডাল, তৈলবীজ, তেল, সব্জি, ফল, বাদাম, মশলা, আখ এত্যাদি ছাড়াও হাঁস, মুরগী, শুয়োর, ছাগল, মাছ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য ধরা হয়েছে। গো-খাদ্য, খোল, তুলোর বীজ, তুলো ও পাটকেও ধরা হয়েছে। ‘কৃষক (ফার্মার) উৎপাদক সংগঠন’ বলতে চাষিদের অ্যাসোশিয়েসন অথবা চাষিদের গোষ্ঠীকে (গ্রুপ) বোঝানো হয়েছে। ‘ব্যক্ত’ বলতে কোনো একজন, অংশীদারী প্রতিষ্ঠান, সমবায় সমিতি, সোসাইটি এবং কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের চালু কোনো প্রকল্পের আওতায় ‘গ্রুপ’ বলে স্বীকৃত যে কোনো সমিতি বা কিছু লোককে নিয়ে গঠিত সংস্থা (Body of persons)-কে বোঝানো হয়েছে। বাণিজ্যিক এলাকা বলতে, খামারের ফটক, কারখানা চত্বর, মাল গুদাম, গোলা তথা ভূগর্ভস্থ ভান্ডার, হিমঘর ও যে কোনো কাঠামো বা জায়গাকে বোঝানো হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রিত বাজারের (এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি = এপিএমসি) অভ্যন্তর, প্রাইভেট বাজার, রাজ্যগুলিতে এপিএমসির অধীন গুদাম, হিমঘর ইত্যাদিকে বাদ দেওয়া হয়েছে।      

দ্বিতীয় পরিচছেদের শিরোনাম হল : কৃষকের ফসলের ব্যবসা বাণিজ্যে উৎসাহ ও সহায়তা প্রদান।  একরাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চাষি ও ব্যবসাদারদের বাধাহীনভাবে ব্যবসার অধিকারের কথা এখানে ঘোষিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার মনে করলে ট্রেডারের নাম অনলাইনে নথিভুক্তকরণ, লেনদেনের পদ্ধতির স্বরূপ (মোডালিটি) ও ফসলের দাম মেটানোর পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশিকা জারি করতে পারে। বৈদ্যুতিন পদ্ধতিতে আন্তঃরাজ্য ব্যবসা ও আর্থিক লেনদেন (ফসলের দাম মেটানো) বিষয়ে প্রযুক্তিগত ও বিধিনিয়মের বেশ কিছু কথা বলা হয়েছে।

একটি জায়গায় (ধারা ৬) বলা হয়েছে,রাজ্যের এপিএমসি আইন বা রাজ্যের কোনো আইনবলে কোনো কৃষক বা ব্যবসায়ীর থেকে (যারা অধ্যাদেশ অনুযায়ী ব্যবসা করার জন্য নাম নথিভুক্ত করিয়েছে) ফী, সেস বা লেভি আদায় করা যাবে না।

hol

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদে বিরোধ নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে। কৃষক ও ব্যবসাদারের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে তারা সাব ডিভিসনাল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সালিশী মীমাংসার জন্য আবেদন করতে পারবে। এসডিএম তাঁর দ্বারা নিযুক্ত সালিশী বোর্ডের কাছে বিষয়টি প্রেরণ করবেন।   

চতুর্থ পরিচ্ছেদে জরিমানা সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। ধারা ১৪টি দুর্বোধ্য। এটি হুবহু উদ্ধৃত করা হল : The provisions of this Ordinance shall have effect, notwithstanding anything inconsistent therewith contained in any state APMC Act or any other law for time being in force or in any instrument having effect by virtue of any law for the time being in force. অধ্যাদেশে বিজ্ঞাপিত কর্তৃপক্ষের (সালিশী সংক্রান্ত) রায়কে কোনো দেওয়ানি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না (ধারা ১৫)। অধ্যাদেশের কোনো কিছুই সিকিউরিটি কনট্রাক্টস (নিয়ন্ত্রণ) আইনস্থ স্টক এক্সচেঞ্জ ও ক্লিয়ারিং কর্পোরেশনের জন্য প্রযোজ্য হবে না (ধারা ১৬)। (এই ধারাটি দুরভিসন্ধিমূলক। বিদ্বজ্জনেরা এ বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেন)  বিরোধ মীমাংসার রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে, চুক্তি লঙ্ঘনের আভিযোগ প্রমাণ হলে এসডিএম অর্থ আদায়ের আদেশ দেবেন। পেনাল্টি ধার্য করবেন। বিতর্কিত ব্যবসায়ীকে ব্যবসা বন্ধের নির্দেশ দিতে পারেন। এসডিএমএর রায় পছন্দ না হলে অ্যাপেলেট অথরিটির হিসেবে জেলা কালেক্টর বা অ্যাডিশনাল কালেক্টরের কাছে আবেদন করা যাবে। তাঁর রায়ও পছন্দ না হলে কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের আমলার (যাকে এই উদ্দেশ্যে কেন্দ্র ভার দেবে) দ্বারস্থ হওয়া যাবে।

দ্বিতীয় আধ্যাদেশটিতেও ৫টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। অধ্যদেশটির ঘোষিত লক্ষ : কৃষি বাণিজ্য সংস্থা, প্রসেসর, হোলসেলার, এক্সপোর্টার, লার্জ রিটেলার ইত্যাদির সঙ্গে ফার্ম সারইসের জন্য ও উৎপন্ন ফসল পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে ন্যায্যমূল্য পাওয়ার স্বার্থে চাষিদের সুরক্ষা পাওয়া। সাথে সাথে চাষিদের ক্ষমতায়ন ঘটানোর জন্য একটা জাতীয় কাঠামো (ফ্রেমওয়ার্ক) গড়ে তোলা।

vill

 

প্রথম অধ্যাদেশটির মতো এই অধ্যাদেশেও কৃষি ফসলের (ফার্মিং প্রোডিউস) একই রকম লম্বা ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে। ফার্ম সার্ভিসেস বলতে, বীজ, গো-খাদ্য, কৃষি রাসায়ণিক, যন্ত্রপাতিসহ সমস্ত ইনপুটকে বোঝানো হয়েছে। ফার্মিং এগ্রিমেন্ট বলতে, চাষি ও স্পনসরের মধ্যে; চাষি, স্পনসর ও তৃতীয় পক্ষের মধ্যে নির্ধারিত গুণমান সম্পন্ন ফসল নির্ধারিত দামে কেনার লিখিত চুক্তিকে বোঝানো হয়েছে। এরই সাথে যুক্ত হয়েছে ‘ট্রেড এন্ড কমার্স এগ্রিমেন্ট’ যেখানে বলা হয়েচে, উৎপাদনের সময়কালীন পণ্যের মালিক কৃষক এবং সে চুক্তি অনুযায়ী মাল ডেলিভারি দিলেই দাম পেয়ে যাবে। আরও রয়েছে ‘প্রোডাকসন এগ্রিমেন্ট’ – যেখানে বলা হয়েছে, স্পনসরকে পূর্ণ কিম্বা আংশিকাবে ফার্ম সারইস দিতে হবে এবং উৎপন্ন ফসলের (আউটপুট) ঝুঁকি নিতে হবে। কৃষক নিজেই যদি ফার্ম সার্ভিস দেয় তার দাম কিন্তু স্পনসরকে মেটাতে হবে। চুক্তিতে Force majeure বা বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিগত কারণে (অভাবিত প্রাকৃতিক বা এক্সটার্নাল ঘটনা – যেমন যুদ্ধ) চিক্তি বাতিল হওয়ার সংস্থান আছে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে যেখানে ফার্মিং এগ্রিমেন্ট সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা আছে সেখানে এক জায়গায় বলা হয়েছে, “এই দরনের পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত প্রয়োজনের দায় মেটানোর ভার থাকবে স্পনসর বা সার্ভিস প্রোভাইডারের হাতে।” ভালমানুষির একটা ভানও একটি ধারায় আছে। যেমন বলা হয়েছে, “ভাগচাষির অধিকার ক্ষুন্ন করে কৃষক কোনো চুক্তি করতে পারবে না।” (২য় পরিচ্ছেদ, ধারা ২)

chal

 

চুক্তির মেয়াদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, একটা ফসল ওঠার মরশুম (ক্রপ সিজন)। যেখানে উৎপন্ন ফসল সংগ্রহের উপযোগী হতে সময় লাগে – এমন ক্ষেত্রে সর্বাধিক ৫ বছর পর্যন্ত চুক্তিটি বলবত থাকতে পারে। ফসলের গুণমানে নজরদারি ও সংশাপত্র দেওয়ার জন্য তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যোগ্যতাসম্পন্ন পরীক্ষাকারী (assayer) নিযুক্ত হতে পারে। বীজ চাষ ছাড়া অন্য ফসলের ক্ষেত্রে, ফসল ডেলিভারি দেওয়ামাত্র (৪৮ ঘণ্টার মধ্যে) দাম মেটাতে হবে। বীজের ক্ষেত্রে, দিনের দিন দুই তৃতীয়াংশের দাম মেটাতে হবে, বাকিটা সংশাপত্র পাওয়ার পর (ডেলিভারির ৩০ দিনের মধ্যে) মেটাতে হবে।

তিনটি অধ্যাদেশের মধ্যে তৃতীয়টি অর্থাৎ দি এসেনসিয়াল কমোডিটিস (আ্যামেন্ডমমেন্ট) অর্ডিন্যান্সটি মনে হয় সবচেয়ে মারাত্মক।   

অধ্যাদেশের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল : কৃষিক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করার স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উদারিকরণ ঘটানো – একই সাথে উপভোক্তাদের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখা।

como

 

১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের ধারা-৩ এর উপধারা ১(এ)-তে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, দানা শস্য, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্য তৈলবীজ, তেল এর সরবরাহ – যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অস্বাআবিক মূল্যবৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। পণ্য মজুতের সীমা সম্পর্কে তখনই ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে যখন ফল-মূলের (হর্টিকালচার) দামের ১০০% বৃদ্ধি ঘটবে। খাদ্য শস্যের খুচরো দামের ৫০% বৃদ্ধি ঘটলে (এক বছর আগের তুলনায় অথবা গত ৫ বছরের গড় দামের তুলনায়) ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সাথে সাথেই বলা হয়েছে, মজুতের সীমা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত এইরূপ আদেশনামা কৃষিপণ্যের কোনো প্রসেসর বা ভ্যালু চেইন* পার্টিসিপান্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না – যদি না এই জাতীয় ব্যক্তির প্রসেসিং করার যে ধার্য ক্ষমতা (ইনস্টলড ক্যাপাসিটি) তার উর্ধসীমা লঙ্ঘিত হয় অথবা যদি তা কোনো রপ্তানিকারীর রপ্তানির প্রয়োজনে হয়ে থাকে। তবে এ কথাও বলা হয়েছে, উপধারা ১(এ)-র কোনো কিছু গণবণ্টন ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারী আদেশনামার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তবে আমার মনে হয় এটি সান্তনা পুরস্কার মাত্র।

*ভ্যালু চেইন পার্টিসিপান্ট বলতে পণ্য তৈরির সমগ্র প্রক্রিয়ায় (চেইন) যারাই যুক্ত তা সে প্যাকেজিং-এর কাজ হোক, গুদামজাত করার কাজ, পরিবহনের কাজ যাবতীয় সবকিছুকেই বোঝায়)।

-- মুকুল কুমার  

খণ্ড-27