কাট ওয়ান: আইআইএসসি বেঙ্গালুরু-র ডিরেক্টর অধ্যাপক অনুরাগ কুমার এই বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ একটি ইমেল পাঠান সমস্ত সহকর্মীদের উদ্দেশে। তাতে এই করোনা পরিস্থিতির জন্য কিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি একটি বার্তা তিনি দেন, তা হলো : যেহেতু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্রেফ মেধার ভিত্তিতে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী ও গবেষকরা আসেন, স্বাভাবিক কারণেই তাদের সমাজ-অর্থনৈতিক পরিবেশও একরকম নয়। ফলত সবার পক্ষে বাড়িতে অনলাইন পড়াশোনা করার মতো 'ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল সেটাপ' বানানো সম্ভব নয় — তাই এখানে অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে কোনো জোর দেওয়া হবে না, বাকিটা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাধীনতা। সামান্য ভিন্ন যুক্তিতে এই একই পদক্ষেপ নেয় দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেও বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির বিবেচনার উপর।
কাট টু : পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তর রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে (যেগুলির অধীনে কলেজ আছে) প্রায় একই সময়ে একটি নির্দেশ দেয় অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পাঠদানের প্রক্রিয়াটি যেন স্তব্ধ না হয়, সে বিষয়ে নজর রাখতে। কলেজ পরিদর্শকরাও সেভাবেই কলেজগুলিতে নির্দেশ পাঠান — কোনোভাবে পঠনপাঠন চালু রাখার বিষয়টির দিকে যেন লক্ষ রাখা যায়, কোন মাধ্যমে বা কি উপায়ে বিষয়টি চালাতে হবে — তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো নির্দেশিকা কিন্তু জারি করা হয়নি। আর এই ‘সুযোগ’টিকে কাজে লাগিয়ে ‘অনলাইন ক্লাস’ নামক বিষয়টিকে নিয়ে উম্পুনের থেকেও ঝোড়োগতিতে এবং তার আসার আগে থেকেই যা ঘটতে লাগলো, হয়তো তার পূর্বসূত্র হিসাবেই বাঙালির চির রসিক দাদাঠাকুর (শরৎচন্দ্র পণ্ডিত) বহুকাল আগে গেয়েছিলেন : “তৈলাধার পাত্র, নাকি পাত্রাধার তৈল – এই তর্কেই শিক্ষা কাবার বাকি কী আর রইলো?”
২০১৫-পরবর্তী সময়ে জাতীয় শিক্ষানীতির নানাস্তরে বিভিন্ন কৌশলে স্পষ্ট করে দেওয়া এবং হয়েছে ‘নলেজ’ আর ‘ইনফর্মেশন’এর পার্থক্য, এবং এটাও বলা হচ্ছে এই তথাকথিত ডিজিটাল বিপ্লবের যুগে যেহেতু সবাই ‘ডিজিটালি কম্পিটেন্ট’(!) এবং ‘ডিজিটালি অ্যাক্টিভ’(!), তাই শিক্ষকের কাজ শুধুমাত্র ‘ইনফর্মেশন শেয়ার’ করেই ফুরিয়ে যাচ্ছে না, কেননা চাহিদার থেকেও কয়েকগুণ বেশি ইনফর্মেশন তারা পেয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেট থেকে — তাঁর কাজ এই ‘ইনফর্মেশন’কে ‘নলেজ’-এর পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীকে সবরকমের সাহায্য করা।
কিন্তু অনলাইনের বাজারে অতকিছু তলিয়ে ভাবার সময় থাকলে তো! গুগল ক্লাসরুম, অনলাইন টিএলএম, স্কাইপ প্রেজেন্টেশন, জুম অ্যাপ ... এইজাতীয় নতুনতর শব্দবন্ধের চাপে অধিকাংশ শিক্ষার্থী যখন দিশাহারা, তখন তাদের পাখিপড়ার মতো মোবাইল ব্যবহার করে পাঠগ্রহণে বাধ্য করা হলো! সেই যে একটি বাচ্চা ছেলেকে তার বাবা শিখিয়েছিলেন, “বাবু, কেউ কিছু চাইলে ‘নেই’ বলতে নেই, বলতে হয় ‘বাড়ন্ত’" ... শিক্ষার ফল ফললো হাতেনাতে! বাবা বাড়িতে নেই – এই তথ্য জানাতে শিশুটি সটান জানিয়ে দেয় — “বাবা বাড়ন্ত”! এখানেও অবস্থা দাঁড়ায় কতকটা সেইরকম। হাতে টাকা থাকলে স্মার্টফোন কেনা যায়, তার জন্য খুব স্মার্ট হওয়ার দরকার নেই; ইন্টারনেটের ব্যবহারকৌশলও আয়ত্ত করা যায় সহজে — কিন্তু যা সহজে আয়ত্ত করা যায় না, তা হলো কাণ্ডজ্ঞান। আমরা ভুলে গেলাম যে মাটিতে ধান ফলে, সে মাটিতে চা ফলে না (বা উল্টোটা)। আমরা ভুলে গেলাম, সেমেস্টারের ধান তিনমাসে কাটা গেলেও ইয়ার্লির আখ বছরশেষেই কাটতে হয়...ভুলে গেলাম, শুধু দাঁতে দাঁত চেপে জেটগতিতে ইনফর্মেশন শেয়ার করে গেলেই হবে না, তাকে ‘নলেজ’এ রূপান্তরিত করার সময়টুকুও দিতে হবে তাদের! কাদের? পশ্চিমবঙ্গের সেই ৭২% শিক্ষার্থীদের, যাদের সিংহভাগই আসে গ্রামীণ পরিমণ্ডল থেকে, যে পরিবেশ করোনার “আলোহীনতায় ডুবে নিস্তেজ নিস্তেল” ... এই আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে তারা দিশেহারা। ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ছবির সেই কালজয়ী সংলাপের মতো তারা মহামারী দেখলো, মড়ক দেখলো — হয়তো মন্বন্তরও দেখবে। আর আমরা তাদের মুখ জোর করে ঘুরিয়ে দিলাম মোবাইল ও ল্যাপটপের পর্দার দিকে ... তার হাত শুধু কিবোর্ডের উপর সচল থাকলো, কারোর দিকে সাহায্যর হাত বাড়ানোর জন্য এগিয়ে গেল না! তার দুচোখ এই বিপর্যয় দেখেও যেন দেখলো না ... সে শুধু দেখে গেল, মেপে গেল অনলাইন টেস্টে তার প্রাপ্ত নম্বরের গ্রাফ কীভাবে ওঠাপড়া করছে! তার মন বাইরের জগতের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে পড়ে রইলো দিনের কোন সময়ে কোন স্যর বা ম্যাডাম অনলাইন ক্লাসে কি বলবেন, সেই দিকে বা কোন হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে কোন কমেন্ট লিখে স্যর/ম্যাডামের থেকে ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্টে বেশি নম্বর ছিনিয়ে নেওয়া যায়, তার কৌশলী হিসাব কষতে! অনেক ‘ইনফর্মেশন’ সে পেলো, কিন্তু তাকে ‘নলেজ’-এ পরিণত করার অবকাশ বা শিক্ষা -- কোনোটাই সে কিন্তু পেল না।
আর আমরা শিক্ষকরাও কোমর বেঁধে নেমে গেলাম অনলাইনের দাসত্ব করতে! এই দেড় দু’মাসে আমি পুলিশ বা ডাক্তারের মতো সামনাসামনি লড়াই করতে পারলাম না, যোগ্যতার অভাবে কৃষকের কাজও করতে পারলাম না, ব্যবসায়ীদের মতো মাথায় হাত দিয়ে বসতে পারলাম না — ইন্টারনেট শাসিত ভার্চুয়াল জগৎ ছাড়া আমার অস্তিত্বই তো সংকটের মুখোমুখি! ফলে চুলোয় গেল কপিরাইট ইনফ্রিঞ্জমেন্ট ... গাদা গাদা বইয়ের পাতা স্ক্যান করে তাতে ‘আমার স্টাডি মেটেরিয়াল’ বলে ছাপ্পা মেরে গুগল ক্লাসরুমের খুপরিতে তাদেরকে চেপেচুপে ঢুকিয়ে দিলাম! যে আমি রোলকলের ছুতোয় ক্লাসের প্রথম আধঘন্টা কাটিয়ে দিই, সেই আমিই নিজের পড়ানোর ‘সিনেমা’ বানিয়ে ইউটিউবে ছাড়লাম! একটিবার ভাবলামও না, ইন্টারনেটের দৌলতে কী সহজে আমি সকলের কাছে হাসির খোরাক হয়ে উঠলাম — বন্ধ দরজার আড়ালের দৃশ্যকে এনে ফেললাম বেআব্রু রোদেলা উঠোনে! রোপা ২০১৯-এর হিসাবের ফাঁকে, ছেলের আবৃত্তি, মেয়ের নাচ আর গিন্নির ডালগোনা কফি বানানোর দৃশ্যের পাশাপাশি আমার ফেসবুক সেজে উঠলো আমার অনলাইন ক্লাস নেওয়ার ক্রমিক ধারাবিবরণীতে ... আমার ইনবক্স ভরে উঠলো সেই ছাত্রছাত্রীর কমেন্টে, যারা চিরকাল ইনফরমেশনকে ‘নলেজ’ ভেবে ভুল করে যাবে।
আর এভাবেই আমরা, যারা স্রেফ একটা চাকরির সুযোগে সমস্ত সামাজিক সুবিধার প্রত্যাশা করি ও না পেলে রেগে যাই, তারা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার মতো বাঁদিকের বুকপকেটটা সামলাতে সামলাতে টেরই পেলাম না সেই বুকপকেটের একটু নীচে নামলেই পাওয়া যেত আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ ... হৃদয় — অনলাইন সক্রিয়তাকে অতিসক্রিয়তার পথে নিয়ে যেতে এই হারিয়ে যাওয়াটাই আমাদের স্থায়ী সঙ্গী হয়ে রইলো।
__ অধ্যাপক ঋষি ঘোষ