মহম্মদ ইউনুস যখন বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে থাকা অর্থনীতিতে পু্ঁজিবাদী উন্নয়নের এক বিকল্প ধারা রূপে মাইক্রো ফাইন্যান্স এর ধারণা সামনে আনেন ও প্রয়োগ ঘটান, তখন পুঁজিবাদীদের মক্কা আমেরিকাও ধন্য ধন্য করে। ইউনুস নোবেল পান। উন্নয়নের তকমার আড়ালে পুঁজির গঠন ও শোষণ একেবারে কুঁড়েঘর পর্যন্ত বিস্তৃত করার জন্যই এই নোবেল প্রাপ্তি। বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রথম দিকে ধীরে ধীরে, পরবর্তীতে অত্যন্ত দ্রুততায় ভারতের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে মাইক্রো ফাইন্যান্স এর জাল। এই ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহীতা মহিলারা। গ্রামের দরিদ্র মানুষের ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়ার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। মাইক্রো ফাইন্যান্স এ বিভিন্ন ঋণদাতা কোম্পানি এই দরিদ্র মানুষদের ঋণ দেয়, সম্পত্তি বন্ধক না রেখেই। আন্দোলনের ময়দানে ঘুরতে ঘুরতে বোঝা গেল, মেয়েরা এই ঋণ নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তুলে দেন বাড়ির পুরুষদের হাতে, ব্যবসা বা চাষের কাজে, ঘরবাড়ি তৈরি বা অন্য কোনো প্রয়োজনে। এই দরিদ্র পরিবারগুলিকে অন্য কেউ ঋণ দেবেনা, যা মাইক্রো ফাইন্যান্স দেয়। কিন্তু দেয় কিসের ভরসায়! ঋণ ফেরতের গ্যারান্টি আছে এই জাতীয় ঋণের ব্যবস্থাপনার মধ্যেই। এটি গোষ্ঠী ঋণ। গোষ্ঠীর একজনের ঋণ শোধের দায়িত্ব নেন গোষ্ঠীর অন্যরা। একজন ঋণ শোধ করতে ব্যর্থতা দেখালে ওই দলের অন্যরা তাকে চেপে ধরেন। একদম গোষ্ঠীর মধ্যে থেকেই উঠে আসা ঋণ শোধের এই চাপ কতটা তীব্র, একজন ভুক্তভোগীই বোঝেন। ফলে ঋণ সুদসহ ফেরতের গ্যারান্টি বেশ।
এইভাবেই বেশ চলছিল। মানুষ ঋণ নিচ্ছিলেন নানা ব্যবসার কাজে, চাষের জন্য। এছাড়া অন্য একটি গুরুতর কাজেও মানুষ ঋণ নিয়েছে। দরিদ্র মানুষদের অধিকাংশই প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা থেকে বঞ্চিত। ঝড়, বৃষ্টিতে একটা পাকা ঘরের নিরাপত্তার প্রয়োজন সকলের। অথচ ঘর তৈরির জন্য লাগে এককালীন অনেকটা টাকা। এমন অসংখ্য মানুষ আছেন, যারা মাইক্রো ফাইন্যান্স থেকে ঋণ নিয়ে তৈরি করেছেন মাথার উপর একটুকরো ছাদ। যদিও হাতে গোনা, তবু এমন উদাহরণও আছে, যেখানে এককালীন টাকার মোহে ঋণ নিয়ে মানুষ টাকা রেখেছেন ব্যাঙ্কে আর খেটে শোধ করছেন কিস্তি! বলছিলেন ফতেমা বেগম, তাঁর পর্যবেক্ষণের কথা, “বিশ বিঘা জমির মালিকরা মাইক্রো ফাইন্যান্স এর ঋণ নেয় না। এই ঋণ গরিবদের জন্য। চড়া সুদ-১৮/২০/২২/২৪ শতাংশ। তবুও এই সুদে ঋণ নেয় গরিবেরা-আদিবাসী, ভাগচাষি, গরিব কৃষক, ছোট ব্যবসাদার, মেহনতিরা। কারণ ব্যাঙ্ক এদের ঋণ দেয় না। ব্যাঙ্ক ঋণ দেয় বড় লোকদের।”
ফতেমা নিজেও গরিব, এবং চটপটে ও উদ্যোগী। চিকনের কাজ নিয়ে নাবার্ড থেকে সবলা বিভিন্ন সরকারী উদ্যোগে চিকনের ষ্টল দেন। থাকা খাওয়ার খরচ সরকার বহন করে। ষ্টল থেকে যে বিক্রিবাটা, তার লভ্যাংশ ফতেমার। কিন্তু ষ্টলে চিকনের বস্ত্র নিয়ে বসতে গেলে কমপক্ষে ৪/৫ লাখ টাকা লাগে। ফতেমা তাই দেড় লাখ টাকা নিয়েছেন বন্ধন থেকে চড়া সুদে। মহাজনরা কিছু ধার দেয়। এছাড়াও আছে স্ব-নিযুক্তির ঋণ। এক্ষেত্রে সুদ সাড়ে ১২ শতাংশ। সময়ে ঋণ শোধ করলে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের নাকি সুদের একাংশ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ফতিমারা এই সুযোগ কোনদিন পাননি! তবুও চলছিল একরকম। কিন্তু লকডাউনে সরকারী মেলা বন্ধ, ব্যবসাও বন্ধ; সুদ কিন্তু বেড়েই চলেছে। উদ্যোগী হয়েও দিশেহারা। ফতিমারা তাই আজ ঋণমুক্তির আন্দোলনে। বলছিলেন ফতিমা, আমার যদি এই অবস্থা হয়, আমার আশেপাশের গ্রামের মেয়েরা যারা বাড়ি থেকে বের হয় না, ৪/৫টা ঋণ নিয়েছে, তারা বুকফাটা যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরছে!
কৃষিতে ভাগ চাষের কথা আমরা জানি। পুরো ব্যবস্থাটা এখানে দাঁড়িয়ে থাকে ভাগচাষির পারিবারিক শ্রমের নির্মম শোষণের উপর, মজুরি শোষণের সামন্তিপথ। এই আদিবাসী, মেহনতি, গরিব কৃষক পরিবারগুলি যখন আবার জানা, উজ্জীবন, গ্রামশক্তি, বন্ধন, আশীর্বাদ মারফৎ চাষাবাদ থেকে সংসারের এককালীন টাকার প্রয়োজনে ঋণ নিচ্ছেন; এরপর চড়া সুদের সাপ্তাহিক কিস্তি মেটাতে সারা সপ্তাহ গাধার মতো খাটছেন, একটা মিটিয়ে সাথে সাথেই মাথার উপর মস্ত ভার নিয়ে পরবর্তী কিস্তি মেটানোর লক্ষ্যে ছুটছেন, তা আধুনিক পুঁজিবাদী শোষণের নবতম যাঁতাকল। মার্কস নতুন করে ক্যাপিটাল লিখলে পুঁজির এই আধুনিকতম দৌরাত্ম্য নিয়ে নিশ্চিত কলম ধরতেন!
কেমন ঋণ, কেমন তার কিস্তি, দেখা যাক। দাদপুরের আসমা বেগম, বন্ধন থেকে নিয়েছেন দেড় বছর মেয়াদী ৪০ হাজার টাকার ঋণ। ইনি কিস্তি দেন মাসে ৩০২৪ টাকা। অর্থাৎ ১৮ মাসে দেবেন ৫৪ হাজার ৪৩২টাকা। এর সাথে আছে শুরুতেই হাজার আড়াই এর লাইফ ইন্স্যুরেন্স! বার্ষিক সুদ মোটামুটি ২৪ শতাংশ! সাথে আবার বাসন কিংবা চড়া দামে উনুন কেনার বায়নাক্কা!
গোয়ালজোড়ের রেহানা সুলতানা বন্ধন থেকে নিয়েছেন ১ লক্ষ টাকা। এখন ১১৫০ টাকা সপ্তাহে সপ্তাহে ২ বছর দিয়ে ঋণমুক্ত হবেন। আখনার টুম্পা পাত্র উজ্জীবন থেকে নিয়েছেন ৩০ হাজার, সমস্তা থেকে ৩০ হাজার, ভিলেজ থেকে ৩৫ হাজার, এসকেএস থেকে ১৮ হাজার, বন্ধন থেকে ৪০ হাজার! সবকটিরই কিস্তি দিতে হয় সপ্তাহে, সপ্তাহে।
এদের কারো স্বামী রাজমিস্ত্রি, কেউ ঋণ নিয়েছেন রাজ্যের বাইরে থাকা ছেলের পাঠানো টাকার ভরসায়, কেউ ভরসায় ছিলেন সব্জি বেচে কিস্তি পরিশোধ করবেন।
এভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। কেউ কেউ এক সাথে আট/দশটা পর্যন্ত ঋণ করেছেন।
এভাবেই তো চলছিল। ঋণ করলে শোধ করতে হয়, এটাই এদেশের মরাল। আর ঋণ শোধ করার তাগিদে অনেকে একটা সংস্থা থেকে নিয়ে অন্য সংস্থায় কিস্তি মিটিয়েছেন! অনেকটা শিব্রামের হর্ষবর্ধনের ঋণ শোধের বিখ্যাত গল্পের মতো।
কিন্তু লকডাউন দরিদ্র ঋণগ্রহিতাদের এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যে কিস্তি পরিশোধের নিয়মিত ব্যবস্থাপণাই ভেঙ্গে পড়েছে। মাইক্রো ফাইন্যান্স সহ ঋণের জাল এখন এ্যতোটাই বিস্তৃত যে ব্যবস্হাকে রক্ষা করার স্বার্থেই লকডাউনের শুরুতে সুপ্রিম কোর্ট তড়িঘড়ি রায় দেয় যে তিন মাস কিস্তি নেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু এর জন্য ঋণগ্রহিতাকে ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন করতে হবে। মরাটোরিয়ামের এই খবরটুকুও পৌঁছায়নি গ্রামের দরিদ্র মানুষের কাছে। উল্টে, লকডাউনের মধ্যেও কিস্তির তাগাদা চালাতে থাকে কোম্পানিগুলোর এজেন্টরা। পরন্তু তিনমাস কিস্তি আদায় করা হয়নি (যা সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল) সময় বৃদ্ধির এই অজুহাতে ব্যাঙ্ক বাড়তি সুদ দাবি করে। যা পুনরায় কোর্টে তিরস্কৃত হয়। কোর্ট এই প্রশ্ন তোলে, এনপিএ-তে হাজার, হাজার কোটি টাকা ছাড়, আর মরাটোরিয়াম পিরিয়ডে কয়েক মাসের সুদ ছাড় দেওয়া যাচ্ছে না! কোর্ট বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকার ও রিজার্ভ ব্যাংককে বিবেচনা করতে বলেছে, যদিও কোর্টের ভর্ৎসনার আগে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি বলে, এমন ছাড় দিলে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে!
মানুষ যে ঋণের জালে জড়িয়ে পরছে, বোঝা যাচ্ছিল অনেক দিন থেকেই কারণ একটার পর একটা সংস্থায় ঋণ তার বেড়েই চলছিল। মাইক্রো ফাইন্যান্স-এও ঢুকে পরছিল নিত্যনতুন কোম্পানি। এখান থেকেই মুনাফার পাহাড় তৈরি করেছে বন্ধন। পরিণত হয়েছে ব্যাঙ্ক-এ। আশীর্বাদ, জানা, গ্রামশক্তি, সমস্তা, উজ্জীবন, এসকেএস, আরোহণ অজস্র কোম্পানির রমরমা ব্যবসা এখন। সুদের ব্যবসা। কুসিদজীবী এরা। আধুনিক কোম্পানির ঝকঝকে মোড়কে পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা!
লকডাউনের শুরু থেকে ত্রাণ ও রেশন সংক্রান্ত আন্দোলন যতই প্রসারিত হচ্ছিল, ততই স্পষ্ট হচ্ছিল বিপন্ন মানুষের আর্তনাদ। ঘরে খাবার নেই, সরকার বড়জোর দিচ্ছে সামান্য চাল, আটা। নেই তেল, নেই ডাল, নেই জ্বালানি, নেই ওষুধ! কিন্তু মহাজনের আনাগোনা বন্ধ হয়না। কি হবে! দিশেহারা মানুষ।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের ঋণমুক্তির ডাক, বিদ্যুৎ চমকের মতো ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে। পোলবা-দাদপুরের বুকে বিডিও-তে পরপর দুটি ধর্ণা-ডেপুটেশনেই জড়ো হন বিপুল সংখ্যক ঋণগ্রস্ত মানুষ- ঋণমুক্তির প্রত্যাশায়।
আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে যে যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে --
মানুষকে সমাবেশিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ঋণ মুক্তি কমিটি’। এটি হুগলিতে আয়ারলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করছে। গ্রামে গ্রামে একটার পর একটা বৈঠক সংগঠিত করার কাজ চলছে।
ঋণগ্রস্তদের সংগঠিত করতে, ঋণের বর্তমান পরিস্থিতি ইত্যাদি জানা ও সরকারকে অবহিত করার লক্ষ্যে প্রথমেই কমিটির করে দেওয়া বয়ানে প্রত্যেক গোষ্ঠীকে ঋণদাতা ব্যাঙ্ক এর নাম, ঋণের পরিমাণ, ঋণগ্রহীতার নাম ইত্যাদি জমা দিতে বলা হয়। ইতিমধ্যে এমন প্রায় ২৫/৩০ হাজার ফর্ম জমা পড়েছে। এগুলো এক্সেল পেপারে টাইপ করে পিডিএফ আকারে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য অর্থ দপ্তর সহ প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর কাজ চলছে। চলছে বিভিন্ন ব্লক দপ্তর মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবিসনদ পাঠানোর কাজ। একই সাথে চলছে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ। প্রতিটি গোষ্ঠী এই মাস পিটিশন পাঠাচ্ছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকে।
ইতিমধ্যে ঋণ মুক্তি চেয়ে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিরা স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাচ্ছেন হাজার হাজার পোষ্টকার্ড। কমিটি নিজেই এখনো পর্যন্ত ছাপিয়ে দিয়েছে ১২/১৪ হাজার পোস্টকার্ড।
শিল্পপতি, বড়লোকদের ঋণ মকুব হয় বারবার, তবে আমরা আমজনতা, আমাদের ঋণ মকুব করতে সরকার কেন পাশে দাঁড়াবে না? – এই মর্মধ্বনি নিয়ে এগিয়ে চলেছে আন্দোলন। দেশের সরকারকেই এখন দেখাতে হবে, তারা কোন পক্ষের প্রতিনিধি। কাদের স্বার্থবাহী?
আন্দোলনকারীদের কাছে এই বার্তা আমরা প্রথম থেকেই ছড়িয়ে দিচ্ছি যে, ঋণমুক্তি কমিটিতে তারাই সংযুক্ত হোন, যাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে। যারা ঋণজালে জড়িয়ে পড়েছেন, নিত্য অপমান, টেনশন নিয়ে না বেঁচে, আসুন সরকারের নীতির প্রশ্নে সোচ্চার হই। জোটবদ্ধ হয়ে সরকারী নীতির অভিমুখ বদলে দেশকে গরিবদেরও বাসযোগ্য করে তুলি।
- সজল অধিকারী