ভারতবর্ষ ছিল আমার কাছে একটা স্বপ্নের মতো। যখন প্লেন ভারতের মাটি ছুঁল, আমার শরীর রোমাঞ্চিত হয়েছিল। মনে হয়েছিল, মহাত্মা গান্ধীর পুণ্যভূমিতে পা রাখলাম।
একুশ বছরের আমি সুদূর নাইজিরিয়া থেকে দিল্লিতে মাইক্রোবায়োলজি পড়তে এসেছিলাম দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে। তখন, ছোট একটা ছেলের মতো ভেবেছি ক্লাসে কত নতুন বন্ধু হবে! তাদের কাছ থকে আস্বাদ পাব ভারতভূমির সমৃদ্ধ ইতিহাসের, নানা ভাষার, বিভিন্ন খাবারের, অপার বৈচিত্রের, অপূর্ব সংস্কৃতির। কিন্তু এখানে আসার পর থেকে আমার জীবনের প্রতিটা দিন যে এভাবে বদলে যাবে ভাবিনি।
এসেই প্রথম যে হিন্দি কথাটা শিখে ফেললাম, সেটা হল ‘কাল্লু’। ক্লাসে, রাস্তায়, বাজারে, পাড়ায় একটাই পরিচয় আমার – ‘কাল্লু’। আমার দিকে প্রতিটা মুহূর্ত লোকে অন্যভাবে তাকিয়ে আছে, সর্বক্ষণ আমায় বিচার করছে, কারো চোখে ঘৃণা, কারো চোখে ভয়। কারণ একটাই – আমার গায়ের রং! আর আমি একা নই, প্রতিটি আফ্রিকানকে ভারতে এই একই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
সর্বক্ষণ আমায় মনে রাখতে হয় আমি এখানে অপর, ভিন্ন। কেউ ডাকে ‘নরখাদক’ বলে, কেউ ভাবে বেশ্যার দালাল। পুলিশ প্রায়ই কড়া নাড়ে দরজায়, আমি ড্রাগ বেচি কিনা জানতে। আমি এতটাই ‘অপর’ এখানে, কোনো ভারতীয় মেয়ের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যের হাসিটুকু হাসতেও আতঙ্কিত হই। হ্যাঁ, ঘর ভাড়া পেয়েছি, কিন্তু ভারতীয়দের তুলনায় অনেক বেশি ভাড়া দিয়ে। আমার বাড়িওলা দরজার বাইরে থেকে প্রতিমাসে কোনোক্রমে টাকাটা গুণে নিয়েই দরজা বন্ধ করে দেয়। আজ পর্যন্ত, কখনো একটিবারও বলেনি, ‘ভেতরে এস, একটু চা খেয়ে যাও’। এই কি তবে সেই ভারতের সুমহান আতিথ্যের নমুনা?
খালি এতেই শেষ ভাবলে ভুল। প্রতি মুহূর্তে রাস্তায় বেরোলে ভাবি, আজ আমার ওপর নিশ্চয়ই কেউ হামলা করবে, এমন কী মেরেও ফেলতে পারে! যেমন মেরে ফেলা হয়েছিল কঙ্গোর একজনকে গত বছর। ক্রমাগত নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কেন একজন সাধারণ মানুষের মতো ভারতে বাঁচতে পারি না? একই জানা আর বীভৎস উত্তর প্রতিধ্বনিত হয় আমার ছোট্ট ঘরটায়, তুমি কালো বলে।
এখানকার সরকার আমাদের নিরাশ করেছে। কঙ্গোর ছাত্রটির হত্যার প্রতিবাদে আমরা আফ্রিকান ছাত্রছাত্রীরা ভেবেছিলাম যন্তর-মন্তরে ধর্ণা দেব। কিন্তু ভারতের বিদেশমন্ত্রক থেকে আমাদের আবেদন করা হল, ধর্ণার বদলে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মিটিয়ে নিতে। আমরা রাজি হলাম। অনুরোধ করলাম, আমাদের নিয়ে যেসব ভ্রান্ত ধারণা, তার বিরুদ্ধে সরকারকে প্রচার চালাতে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা বিলবোর্ডও দেখলাম না, যেখানে লেখা ‘আফ্রিকানরা আমাদের ভাই’, টিভিতে কোনো বিজ্ঞাপন দেখলাম না, যেখানে বলা হচ্ছে, আফ্রিকানরা নরখাদক নয়। বহু শিক্ষিত অভিজাত ভারতীয় জানেই না, যে আফ্রিকা একটা মহাদেশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ভারতীয়দের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে বারণ করা হয়। অন্য ভারতীয় ছাত্ররা আমাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসে, নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করে, কাল্লু বলে উত্যক্ত করে, আফ্রিকান মেয়েদের উদ্দেশ্যে তাদের ‘রেট’ কত জানতে চায়। আমাদের কান্না উঠে আসে, ক্রোধ-ক্ষোভ দলা পাকায়, কিন্তু আমরা নীরবে সহ্য করি।আজ পর্যন্ত কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভারতীয় ছাত্রেদের বলল না, যে ‘কাল্লু’ বলা উচিত নয়।
ভারতের আফ্রিকান ছাত্র সমিতির আহ্বায়ক হিসেবে, সারাদিনই ফোন আসতে থাকে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আফ্রিকান ছাত্রছাত্রীদের। তাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শুনে শুনে বুঝি, কালোকে ঘেন্না করার সংস্কৃতির শেকড় ভারতে অনেক গভীরে প্রোথিত। আমি নিজেকে বোঝাই, কয়েকটা ঘটনা দিয়ে পুরো ভারতকে বিচার করা উচিত নয়। কিন্তু দিনের শেষে আমি দেখতে পাই, আমার কোনো বন্ধু নেই। ছেলেরা আমায় টিটকিরি দেয়, মেয়েরা ভয় পায়। আমি সন্ন্যাসীর মতন নিভৃতে জীবন কাটাই। বাইরে যাই না, যাতে লোকে আমায় দেখে বিরক্ত না হয়। তাদের বিরক্ত না হওয়াই আমার সুরক্ষার একমাত্র উপায়। যখনই শুনি, কোথাও কোনো আফ্রিকানের ওপর হামলা হয়েছে, ভাবি ‘কাল বোধহয় আমার পালা’। আমি ভারতীয় পোশাক পরে ঘুরি, সবাইকে বোঝাতে যে আমি ভারতীয় সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছি। কিন্তু সে পোশাকের বাইরেও আমার গায়ের কালো রঙটাই তাদের চোখে ফুটে ওঠে। আমার কাল্লুর বেশি আর কিছু হয়ে ওঠা হয়না।
দাঁতে দাঁত চেপে কোনক্রমে কোর্সটা শেষটা করে দেশে ফিরতে চাই। না হলে রোজকার এই নারকীয় যন্ত্রণার থেকে মুক্তি নেই! ভারত বলতে আমার স্মৃতিতে এটুকুই থাকবে আর যে স্মৃতি আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব ভবিষ্যতে মুছে ফেলতে।
– ভারতীয় সমাজের গভীরে প্রোথিত বৈষ্যম্য ও বিদ্বেষের বিষয়টিতে আলোকপাত করতে হিন্দুস্থান টাইমসের #LetsTalkAboutRacism-র প্রচারের অঙ্গ হিসেবে Ezeugo Nnamdi Lawrence-র লেখা। লেখক অ্যাসোসিয়েশান অফ আফ্রিকান স্টুডেন্টস ইন ইন্ডিয়ার আহ্বায়ক।
সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ - নির্মাল্য দাশগুপ্ত