৩০ জুন হুল দিবস। ১৮৫৫ সালের এই আদিবাসী কৃষক জাগরণ ব্রিটিশ শাসনের জমিদারীতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। এর দুবছর পর ১৮৫৭-তে আরও ব্যাপক বিস্তারে দেশজুড়ে ঘটা মহাবিদ্রোহের প্রথম স্ফুলিঙ্গ ছিল হুল। মহাবিদ্রোহ পরবর্তী ব্রিটিশ শাসন পর্বে প্রথম তীব্র গণবিদ্রোহ ছিল বিরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে উলগুলান। পরবর্তীতে, স্বাধীন ভারতেও, জমির ওপর আদিবাসী ও কৃষকের অধিকারের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে প্রান্তিক জনতার অভ্যুত্থান ঘটে নকশালবাড়িতে, যেখানে দুজন শিশু সহ ১১ জন আদিবাসী মহিলা প্রথম দিনে শহীদ হন। ১৮৫৫-র হুলের নেতৃবৃন্দ— মুর্মু পরিবারের চার ভাই ও দুই বোন সহ পনের হাজারের ওপর মানুষ শহীদ হন।
এবছর ৩০ জুন যখন হুল দিবস পালিত হবে ঠিক তখনই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার একটি নতুন বিধি পাশ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। গত ১২ মার্চ এই বিধির খসড়া প্রস্তাব সামনে এনেছিল সরকার। সে বিষয়ে জনমত নেওয়ার শেষ দিন হিসেবে ৩০ জুনকেই নির্ধারিত করেছে। এই বিধি ভারতে ‘এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ ব্যবস্থা তুলে দেবে। এর অর্থ হল, পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে তার কোনোরকম বাছবিচার ছাড়াই কর্পোরেট কোম্পানিগুলি তাদের বিভিন্ন প্রকল্প চালাতে পারবে। অর্থাৎ জমি নেবে, অরণ্য ধ্বংস করবে, নদী বেঁধে দেবে, যেখানে খুশি শিল্পজাত বর্জ্য ডাম্প করবে - পরিবেশ প্রকৃতির কথা ভাবতে হবে না। মোদি সরকার ইতিমধ্যেই একচল্লিশটি কয়লা ভাণ্ডার নিলাম করছে যা আবার বহু অরণ্যগ্রামের জনজীবন ধ্বংস করবে। বিভিন্ন সরকারী বিজ্ঞপ্তি জারি করে আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার আইনও বহুলাংশে খর্ব করে দিয়েছে। সংরক্ষণ ব্যবস্থার সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার তোড়জোর চালাচ্ছে। জমি-অরণ্য-জল-বাতাস সবকিছু ছিনিয়ে নিতে চলেছে মোদি সরকার। পরিবেশের প্রশ্ন নাকচ হয়ে যাবে কি না সে বিষয়ে মতামত দেওয়ার শেষ দিন আপাতত ৩০ জুন! ওইদিন মোদি সরকার আমাদের শ্বাস নেওয়ার অধিকারটাও কেড়ে নিতে চলেছে।
সিদো কানু চাঁদ ভৈর ফুলো ও ঝানো সহ হাজারো শহীদের হুল থেকে শুরু করে অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামীর প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে যে অধিকার সাধারণ মানুষের জন্য লিপিবদ্ধ হয়েছিল, আজ বিজেপির শাসনে তা দ্রুত অকার্যকর করে দেওয়া হচ্ছে। হুল ও উলগুলানের মাধ্যমে অর্জিত এসপিটিএ ও সিএনটিএ’র রক্ষাকবচও ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার নাকচ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। সাম্প্রতিক সময়ে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে সংবিধান রক্ষার আন্দোলন দেখেছি আমরা। তার ঠিক আগে আমাদের আদিবাসী সমাজের মধ্যে থেকে এক অভিনব আন্দোলন উঠে আসে। ঝাড়খণ্ডে শত শত গ্রামে তা ছড়িয়ে পড়ে। সংবিধানে বর্ণিত অধিকারগুলি বড় বড় পাথরে খোদাই করে গ্রামে গ্রামে স্থাপন করার এই আন্দোলন পাথালগাঢ়ি আন্দোলন নামে পরিচিত হয়। ঝাড়খণ্ডের তৎকালীন বিজেপি সরকার পাথালগাঢ়ি আন্দোলনের ২১ হাজার নেতাকর্মীর ওপর ইউএপিএ ধারায় মামলা দায়ের করে। রাজ্যের ক্ষমতা থেকে বিজেপি অপসারিত হওয়ার পরই একমাত্র এই মামলাগুলি প্রত্যাহৃত হয়।
আদিবাসী জনতা নিজেদের জীবনযাত্রা রক্ষায় সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ করলেই এই রাষ্ট্র তাদের ‘মাওবাদী/নকশাল জঙ্গী’ তকমা দিয়ে জেলে পোরে, সিআরপিএফ নামিয়ে চরম অত্যাচার চালায়। গণতান্ত্রিক ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মীরা আদিবাসীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে তাঁদের ‘আর্বান নকশাল’ তকমা দিয়ে জেলে পোরা হয়। লকডাউন পর্বেও পুলিশী নৃশংসতার সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে আদিবাসীরা। ভারতের তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় উদ্বাস্তু হয়ে শহরের আসপাশে ছিন্নমূল জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছিলেন যারা, সেই আদিবাসীরা এই দীর্ঘ লকডাউনে আরও একবার সর্বাধিক বিপর্যস্ত। বাড়ি ফেরার পথে পুলিশের নির্মম প্রহারে প্রাণ হারানো ৬৫ বছরের বৃদ্ধ টিবু মেড়া বা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছে পৌঁছেও তৃষ্ণায় ক্লান্তিতে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়া ১২ বছর বয়সী কিশোরী জামালো মাড়কম এরকম দুটি নাম।
হুল দিবস পালন তাই নতুনতর তাৎপর্য নিয়ে ফিরে ফিরে আসে। আমাদের ভূমি জমি জল অরণ্য বাতাস প্রকৃতি রক্ষার লড়াই হোক বা অধিকার ও সংবিধান বাঁচানোর লড়াই-প্রতিরোধের সামনের সারিতে বিছনের মতো ছড়িয়ে আছে হুল মাহা। ছত্তিশগড় ঝাড়খণ্ডের বৃহৎ ক্ষেত্রগুলি থেকে শুরু করে রায়গঞ্জের বিদ্রোহ বা হুগলির ‘আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ’ পরিচালিত ছোটো পরিসরের ধারাবাহিক সংগ্রামেও আমরা তা দেখতে পাই।
হুল মাহার আশু আহ্বান
- হুল জোহার, সিপিআই(এমএল) রাজ্য কমিটি