করোনা অতিমারীতে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা লাটে উঠেছে
coro

করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একজন সামনের সারির যোদ্ধা সিনিয়ার নার্স কবিতা দত্ত মজুমদারের মৃত্যু আমাদের বিচলিত করেছে। বিনা চিকিৎসায় একজন সিনিয়ার নার্সের মৃত্যু হল। এরকম আরও কত অজানা ঘটনা আছে যা হয়তো কোনদিন প্রকাশ্যে আসবে না। তাঁদের স্বজন হারানোর কষ্ট কেউ জানতেও পারবে না।

কোভিড-১৯ আমাদের সমগ্র সমাজ ব্যবস্থা সহ চিকিৎসা জগতকে পুরোপুরি উন্মোচিত করে দিয়েছে। মানুষ অতিমারীতে আক্রান্ত হচ্ছেন। সুস্থরা গৃহবন্দি। সবার কপালে ভাঁজ পড়েছে। তাঁদের প্রিয় জনের কিছু হলে কোথায় চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যাবেন? রাজ্যে প্রায় ২০০০ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে আছে কর্পোরেট হাসপাতাল ও কিছু নার্সিংহোম কাম হাসপাতাল। অতিমারির সময় বেশিরভাগ বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান আংশিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু রেখেছে।

২০১৭ সালে বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে ভূরিভূরি অভিযোগ আসতে থাকল। রোগীর পরিজনদের সাথে বেসরকারী হাসপাতলের সঙ্গে ঝামেলা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। হাসপাতাল গুলিতে মারপিট, দাঙ্গা হাঙ্গামা বাড়তে থাকে। রাজ্য সরকার বাধ্য হয়ে নয়া হাসপাতাল বিল ২০১৭ বিধানসভায় পেশ করে।

বামফ্রন্ট সরকার ২০১০ সালে অনুরূপ বিল পেশ করেছিল। যদিও সেই সময় বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস আইনটির বিরোধিতা করেছিল৷ বিধানসভার সিলেক্ট কমিটির কাছে ‘‌নোট অফ ডিসেন্ট’ দিয়ে, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় আইনের দাবি করেছিল৷ প্রায় অনুরূপ একটা বিল ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিধানসভায় আনলো।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজেই পেশ করলেন ‘‌দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্টস (‌রেজিস্ট্রেশন, রেগুলেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি)‌ বিল, ২০১৭’৷ এই বিলে চিকিৎসার গাফিলতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক জরিমানার ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রাখা হলো৷ এক নজরে নিয়মগুলি যা দাঁড়ালো — চরম গাফিলতির ক্ষেত্রে ন্যূনতম জরিমানা ১০ লক্ষ টাকা৷ বড় ক্ষতির ক্ষেত্রে ৫ লক্ষ এবং তুলনায় কম ক্ষতির ক্ষেত্রে ৩ লক্ষ টাকা জরিমানা৷ এই ক্ষতিপূরণ বিপত্তি ঘটার এক মাসের মধ্যে আংশিক এবং ছয় মাসের মধ্যে পুরোপুরি মিটিয়ে দিতে হবে৷ এছাড়া বলা হলো, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আর্থিক সঙ্গতি না দেখে, সবার আগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে৷ অ্যাসিড হামলা এবং ধর্ষণের শিকার হবেন যাঁরা, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম৷ বলা হয়েছে, এমার্জেন্সি বিভাগ থেকে রোগী প্রত্যাখ্যান করা যাবে না৷ বিল মেটাতে না পারলে মৃতদেহ আটকে রাখাও যাবে না৷ নতুন বিলে খুব স্পষ্ট করে দেওয়া আছে যে, যে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এইসব নিয়ম মানবে না, তাদের লাইসেন্স বাতিল হবে৷ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান দেওয়া আছে বিলে৷

hel

 

কিন্তু বাস্তবটা বড় কঠিন। করোনা অতিমারী শুরু হতেই, বেসরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় উঠেই গেল। বেসরকারী হাসপাতালগুলো করোনার জন্য কয়েকটি বেডের ব্যবস্থা করে নিজেদের দায় মুক্ত করে নিল। করোনা ছাড়া অন্য কোনো রোগ নিয়ে বেসরকারী হাসপাতালে গেলে, আগে করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট দেখাতে হবে। তারপর চিকিৎসা পাবেন। এমন কি যে সব ডাক্তারবাবুরা ব্যাক্তিগত চেম্বার করতেন তারাও উধাও হয়ে গেলেন। করোনা ছাড়াও হাজারো রোগ আছে, কেউ কেউ দীর্ঘদিন কোনো জটিল বা মারণ রোগে আক্রান্ত, কেউবা বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে আছেন চিকিৎসক খুঁজে পাচ্ছেন না। এ এক করুণ দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি আম জনতা। আর বেসরকারী হাসপাতাল, নার্সিংহোম, চিকিৎসক সবাই করোনা দেখিয়ে আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন। অসহায় মানুষ চিকিৎসার জন্য ছটফট করছেন। এখন মেডিক্লেমের গল্পগাছা শুনতে পাবেন না। বীমা কোম্পানিগুলোর গল্পও শেষ। মানুষ রোগমুক্তির জন্যে ছুটছেন ভেঙে পড়া সরকারী হাসপাতালে।

যখন ‘চাচা নিজের প্রাণ বাঁচা’ বলে বেশিরভাগ বেসরকারী হাসপাতাল, নার্সিংহোম, চিকিৎসা কেন্দ্র বা চেম্বারে বসা মোটা ভিজিটের ডাক্তারবাবুরা সবাই হাত তুলে দিয়েছেন, তখন অগতির গতি সরকারী হাসপাতাল। রোগী উপচে পড়ছে। সামাজিক, অসামাজিক কোন দূরত্বের বালাই নেই। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদেরও করোনার সংক্রমণে মৃত্যু হচ্ছে। তারাও অবহেলার শিকার হচ্ছেন। সিনিয়ার নার্স কবিতা দত্ত মজুমদার এই অব্যবস্থার শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। মৃতা কবিতা দত্ত মজুমদারের মেয়ে করোনায় সংক্রমিত হয়ে বেলেঘাটা আইডি-তে ভর্তি আছেন।

এরকমই এক হতভম্ব হয়ে যাওয়া মর্মন্তুদ কাহিনী সাগরদত্ত হাসপাতালের। ২১ মে সালাউদ্দিন সাগর দত্ত হাসপাতালে বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তী হন। ২২ মে মারা যান। মৃত্যুর ১২ দিন পর মৃত সালাউদ্দিনের দেহ ও ডেথ সার্টিফিকেট পরিজনরা পেলেন। এই বারোদিন পরিজনেরা একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে গেছেন, ফিরে এসেছেন। বাড়ির লোকেরা অসহায়ভাবে ঘুরে বেরিয়েছেন, এক সময় আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। এরপর সুপারের সাথে যোগাযোগ হয়, তিনি আবার নতুন করে উদ্যোগী হলেন।

২ জুন সুপারের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেল তিনি এই ঘটনায় ওয়াকিবহাল আছেন। তিনি জানান সালাউদ্দিন ২১ মে ভর্তি হয়েছন এবং ২২ মে মারা যান। তিনি আরও বলেন খুব দুঃখের ঘটনা, আমার পরিবারের এরকম হলে, আমিও খুব কষ্ট পেতাম। অভিযোগ করা হল পরের রিপোর্ট আগে আসছে এবং আগের রিপোর্ট পরে আসার জন্য, ক্রমানুসার ঠিক থাকছে না। সুপার জানান এই তথ্য ঠিক না। আসল কারণ নাইসেড এতো চাপ সামলাতে পারছে না। মৃতের পরিবার ১২ দিন সাধারণ জীবন যাপন করছেন। যদি মৃতের রিপোর্ট পজিটিভ হয়? তাহলে মৃতের পরিবারের মাধ্যমে সমাজে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকছে। হ্যাঁ। দুশ্চিন্তা থাকছে। চেষ্টা করছি যাতে রিপোর্ট তাড়াতাড়ি আসে।

৩ জুন সকালে হাসপাতাল থেকে মৃতের বাড়িতে ফোন যায়, ‘মৃতদেহ নিয়ে যান’। মৃতের পরিবার উৎকন্ঠা মুক্ত হলেন। সৌভাগ্যবশত মৃতের কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। সমাজও সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়। রিপোর্ট যদি পজিটিভ হোত তাহলে মৃতের পরিবার ও সমাজ দিনের পর দিন উৎকন্ঠায় থাকতো। আর এই পরিবারটিও অসংবেদনশীলতার শিকার হতেন। সাম্প্রদায়িক দলের প্রতিনিধিরা, ঘৃণা ও বিভজনের জন্যে সলতে পাকানো শুরু করে দিত। আমাদের চোখের আড়ালে এরকম আরও কত যে অমানবিক কাহিনী ছড়িয়ে আছে? তা হয়তো জানাও যাবে না।

hos

 

কোভিড-১৯ আমাদের জীবন ও সরকারী প্রতিষ্ঠানে বহু পরিবর্তন হয়ে চলেছে। খবরে প্রকাশিত রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল, নার্সিংহোম এবং হোটেলকে করোনা হাসপাতাল বানিয়েছে। রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর কামারহাটি কলেজ অব মেডিসিন এন্ড সাগরদত্ত হাসপাতালকে করোনা হাসপাতালে পরিণত করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। যখন করোনার প্রাদুর্ভাব হচ্ছে তখন বেশ কিছু করোনা হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে, এতে নীতিগত কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু সরকারের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে চট জলদি যে কোনো সিদ্ধান্ত ‘হিতে বিপরীত’ ফল দিতে পারে। আগেই আলোচনা করেছি, অতিমারীর সময় প্রায় সব বেসরকারী চিকিৎসা বন্ধ। বর্তমানে নৈহাটি থেকে বেলঘরিয়া, মধ্যমগ্রাম, দমদম, নিমতা, বরানগর এমন কী গঙ্গার ওপারে বালি, উত্তরপড়া, হিন্দ মোটর, কোন্নগর থেকেও বহু রোগী চিকিৎসার জন্য সাগর দত্ত হাসপাতালে আসছেন। এখন সব চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ, তখন সরকার বাহাদুর কী ভাবছেন? এই অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ রোগীরা কোথায় যাবেন চিকিৎসা করাতে!?

শতাব্দী প্রাচীন সাগর দত্ত চেরিটেবল ডিসপেনসারিকে ১৯৩৭ সালে রেকগনাইজড মেডিকেল সেক্রেটারি ডাঃ অ্যান্ডারসন মান্যতা দেন। ২০০৭ সালে প্রস্তাব আসে বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান অ্যাপোলো গ্লেনিগেলসের সাথে পিপিপি (পাবলিক, প্রাইভাট, পার্টনারশিপ) মডেলে সুপার স্পেশালিষ্ট হাসপাতাল তৈরি করা হবে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ ‘সাগর দত্ত হাসপাতাল বাঁচাও মঞ্চ’ গড়ে তুলে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করেন। অ্যাপোলো ও রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর পিছু হটে। স্বাস্থ্য দপ্তর ২০১০ সরকারী মেডিকেল কলেজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ৩০ জুন ২০১১ সালে ‘কলেজ অব মেডিসিন অ্যান্ড সাগরদত্ত হাসপাতাল’ গড়ে ওঠে। তারপর খুব ভালো না হলেও যে ভাবে সব কিছু আমাদের দেশে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে সাগর দত্ত হাসপাতালও চলছিল। এখন সব বন্ধ। আউট ডোর, জরুরি পরিষেবা, অন্য রোগের চিকিৎসা সব বন্ধ। সবাই হতাশ, আতঙ্কগ্রস্ত অসুস্থ হলে তারা কোথায় যাবেন, ন্যূনতম চিকিৎসার জন্যে? আশার কোনো আলো নেই, চারিদিকে শুধু অন্ধকার, আর অন্ধকার।

-- নবেন্দু দাশগুপ্ত 

খণ্ড-27