করোনা জর্জরিত ও আমফান বিধ্বস্ত বাংলার পরিস্থিতি দাবি জানাচ্ছে মানুষের জরুরি আর্থ-সামাজিক সুরক্ষা চাই। সেই অধিকার আদায়ে যে সমস্ত সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি আন্তরিক তাদের প্রতি পদে পদে যুঝতে হচ্ছে কেন্দ্র-রাজ্যের দুই সরকারের বিরুদ্ধে। পক্ষান্তরে, বিজেপি তার তৎপরতাকে চরম মাত্রা দিয়ে চলেছে ২০২১-এর বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের নিশানায়। চৌতরফা চাপ বাড়ানোর নেটওয়ার্কে সক্রিয় কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্যপাল ধনখড়, রাজ্য বিজেপি সংগঠন এবং আরএসএস। নেপথ্যে আছে বিজেপির আই টি সেল।
করোনা আসার ঠিক আগের পরিস্থিতিতে বাংলায় বিজেপি সম্মুখীন হচ্ছিল সিএএ-এনপিআর-এনআরসি প্রশ্নে প্রবল প্রতিবাদী ঝড়ঝঞ্ঝার। অতঃপর লকডাউনের পরিবেশ চলল দীর্ঘ সময় ধরে এবং তার অবশেষ থাকতে থাকতে বিজেপি উঠেপড়ে লেগেছে হাওয়াটা সপক্ষে ঘোরাতে। বিক্ষোভ ও প্রচারের লক্ষ্যে সমন্বয় করে তুলছে মূলত চারটি দিকের। রাজ্যের সমস্ত অসন্তোষকে মমতা সরকারের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দেওয়া, পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক নানা অশান্তি ও হাঙ্গামা ছড়ানো; একইসাথে বাংলার অতীত থেকে হিন্দু জাতিয়তাবাদী ‘আইকন’ যে ক’টি মেলে তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মরীয়া হওয়া, এর সাথে প্রধানমন্ত্রীর ‘স্বপ্ন ফেরী’ করা আর অমিত শাহর হুমকি। এই হল বিজেপির বাংলা দখলের সমরাস্ত্র। বলাবাহুল্য, মেরুকরণের ব্রহ্মাস্ত্র।
এরাজ্যে বিজেপি দৌরাত্মের বিপদ বেড়ে যাওয়ার জন্য তৃণমূল জমানার দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করে চলার পলিসি দায়ী। করোনা পরিস্থিতিতেও দেখা গেল বিশেষত স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মানবিক ব্যবস্থা গ্রহণে তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতা, ধরা পড়ে যাওয়া সত্বেও তথ্য চেপে যাওয়ার কৌশল, একটা মিথ্যা ঢাকতে আরেকটা মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া। এইসমস্ত কদর্যতা থেকে ফায়দা লুঠতে অনবরত সক্রিয় হয়েছেন রাজ্যপাল ও রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু কেন্দ্রের কাছে এই সময়ের যে দাবিগুলো উঠেছে সেব্যাপারে কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। শুধু প্রচার করেছেন কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের তরফে লিস্ট ঠিকমতো যাচ্ছে না, তাই কেন্দ্র বহু কিছু করতে পারছে না। খুব বেশি প্রশ্নের মুখে পড়লে বলছে কেন্দ্র পর্যাপ্ত অর্থ দিয়েছে, খাদ্যশস্য পাঠিয়েছে, তৃণমূলের দুর্নীতির কারণে তা মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। মানুষও কমবেশি প্রভাবিত হয়ে পড়ছে এই অর্ধসত্য ও মিথ্যা মেশানো প্রচারে। কারণ, তৃণমূলী দুর্নীতি-দাদাগিরি-তোলাবাজি সবই যে বহু আগে থাকতেই অতি চেনা প্রবণতা।
তৃতীয়ত, বিজেপির যদিও স্বাধীনতা আন্দোলনের দর্পণে দর্প দেখানোর বিশেষ সুযোগ নেই, তবু মরীয়া অল্প কিছু ব্যক্তিত্বকে ‘আইকন’ হিসেবে তুলে ধরতে। যেমন শ্যামাপ্রসাদ, ঋষি বঙ্কিম, ঋষি অরবিন্দ প্রমুখকে, যারা হিন্দু জাতিয়তাবাদী দর্শন-মতাদর্শ-মননের বিশ্বাসী ছিলেন এবং যাদের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতার পরম্পরা রয়ে গেছে বিশেষত শিক্ষিত ও প্রচ্ছন্ন বা সুপ্তভাবে হিন্দু জাতিয়তাবাদে আবিষ্ট বাঙালি মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে। আরএসএস প্রচার করছে, স্বাধীনতা আন্দোলনে তিরিশের দশকের সময় থেকে কমিউনিস্ট ধারা সামনে আসতে শুরু করার আগে পর্যন্ত সামাজিক ধ্যানধারণায় প্রভাব ছিল প্রধানত হিন্দুত্বের। এইসব বিষয়কে প্রচারে খুঁচিয়ে তুলে আরএসএস-বিজেপি চাইছে বাংলায় ব্রাত্য দশা কাটিয়ে উঠতে।
জাতীয় অর্থনীতির আরও একপ্রস্থ কর্পোরেটমুখী বেসরকারীকরণের পদক্ষেপ করার পরপরই মোদী শুরু করে দিলেন বাংলার শিল্পীয় পুনরুজ্জীবনের ‘স্বপ্ন’ ফেরীর বাত শোনাতে। তার প্রচারযন্ত্র হিসেবে বেছে নিলেন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের দুই সর্বভারতীয় সংস্থা সিআইআই ও আইসিসি-র সভামঞ্চকে। বোঝাই যাচ্ছে বাংলায় ক্ষমতা আসার রাস্তা তৈরি করতে কর্পোরেট পুঁজির ওপর ভীষণভাবে ভরসা করছে এবং ক্ষমতায় এলে রাজ্যটাকে কর্পোরেট পুঁজির কাছে বিকিয়ে দেবে। রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতিতে প্রচন্ড খরা, শ্রমশক্তির বেকারির সংকট ব্যাপক।
এই দুরবস্থাকে বিজেপি তার মাথা তোলার স্বার্থে ব্যবহার করছে। ভুললে চলে না, এমনকি করোনা সংক্রমণ ছড়ানোকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্বার্থসর্বস্বতায় ব্যবহার করতে বিজেপি এতটুকু বিরত থাকেনি। এটা করে এসেছে যেমন গঙ্গাপাড়ের শিল্পাঞ্চলে, তেমনি গ্রামবাংলায় পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরা উপলক্ষ্যেও। এই মহড়ার বিপদ তাই বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। সুতরাং বিজেপির মোকাবিলায় কোনো ঢিলা দেওয়া নয়।