বেকারির ভিড় ডেকে আনছে আরও অশেষ দুর্গতি
db

কোবিড পরিস্থিতিতে এক জরুরি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে বেকারির ভয়াল বৃদ্ধির প্রশ্ন। বিশ্ব অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব সংকট। ভারতীয় অর্থনীতির দশাও চলছে একই খাতে। বৃদ্ধি ক্রমাগত নিম্নগামী, ঠেকেছে ১১ বছরের রেকর্ড ভাঙা তলাানিতে। জনমানুষের আর্থিক দুর্গতি দাঁড়িয়েছে ততোধিক। কাজ হারানো, কাজ না পাওয়া, দারিদ্র সীমার নীচে থাকা ও ক্রমাগত নামতে থাকা জনগণের কাছে ন্যূনতম ১০ হাজার করে টাকা দেওয়ার দাবি উঠেছে কেন্দ্রের মোদী সরকারের কাছে। কিন্তু আজও তার সুরাহা মেলেনি। তা পাওয়া বোঝাই যাচ্ছে সহজে হওয়ার নয়। দেশব্যাপী এই অসহনীয় অবস্থায় নাছোড় থাকতে হবে বেঁচে থাকার অধিকার সঞ্জাত অর্থকড়ি অনুদান আদায়ের লড়াইয়ে। পাশাপাশি বেকারি অবসানের অধিকার সম্বলিত লড়াইও শুরু করতে হবে নতুন করে। তার কারণ মোদী সরকারের দ্বিতীয় পর্বের প্রথম বছরের মধ্যেই বেকারি বেড়ে পৌঁছেছে ১১ বছরের রেকর্ড ছাপিয়ে যাওয়া অবস্থায়। আর করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতে নিশ্চিতভাবেই কাজ উধাও হয়ে গেছে আরও ব্যাপক হারে। সেটা কত মারাত্মক বিচিত্র আকার ধারণ করেছে আর তা নিয়ে বিভিন্ন মূল্যায়ন কেমন চলছে সেইসব বিষয় পরখ করে নেওয়া যাক একনজরে।

ttt

 

গত মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে লক ডাউনের ঠিক আগের অবস্থায় বেকারির চিত্র ছিল ৮.১৪ শতাংশ। এপ্রিলে তা দাঁড়ায় প্রায় তিনগুণ বেশি, ২৩.৫২ শতাংশ। আর, মে মাসের প্রথমার্ধের মধ্যে বেকারি পৌঁছে যায় ২৭.০৬ শতাংশে। এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে সিএমআইই। পরবর্তী হিসাব এখনও অপ্রকাশিত। বলাবাহুল্য, জুনের প্রথম সপ্তাহের আগে পর্যন্ত কর্মক্ষেত্র ছিল পুরো লকডাউনে, ফলে বেকারির ধারা ছিল একই। এই দীর্ঘ সময়ে কাজ লোপাট সংক্রান্ত কোনও আলোচনার ধার-কাছ মাড়ায়নি মোদী সরকার। কোনও অভয়ও দেয়নি কোথাও কোনো কাজ ছেঁটে দিতে দেওয়া হবে না। দেশবাসীকে প্রধানমন্ত্রী বারকয়েক ভাষণে মোহিত করার চেষ্টার কার্পণ্য রাখেননি। কিন্তু একটিবারের জন্যও তাঁকে কাজ চলে যাওয়ার চালচিত্র বিষয়ে কিছু বলতে শোনা যায়নি। মে মাসের একেবারে শেষে শোনা গেল কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রক নাকি শ্রমমন্ত্রককে নোটিশ করেছে, সমগ্র ইনফর্মাল সেক্টরে কাজ ছুটে যাওয়ার রিপোর্ট তৈরি করতে। বলাবাহুল্য, সরকারী ক্ষেত্র ক্রমেই বেচে দেওয়া হচ্ছে। যে সরকার লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের সর্বস্বান্ত দিশেহারা নিরন্ন পথে-ঘাটে বাঁচা-মরা অবস্থা দেখেও তার দায় দায়িত্ব পালন এড়াতে ইতর রাজনীতি করতেই ব্যগ্র থেকেছে, তাকে বেকারি বৃদ্ধির ক্রমাগত চাপের সামনে অগত্যা সবশেষে কিঞ্চিৎ মুখ খুলতে শোনা গেল। এরপর কর্মহীনতার হাল-হকিকৎ স্বীকার করার রিপোর্ট তৈরিতে শ্রমমন্ত্রক কত মাস লাগায় সেটা সময়েই পরিষ্কার হয়ে যাবে। কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে; মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বেই অভিযোগ উঠেছিল বেকারি বৃদ্ধি সংক্রান্ত এনএসও-র সর্বশেষ সমীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ থাকা তথ্য পরিসংখ্যান চাপা দেওয়ার। যে সরকার তৈরি করা রিপোর্ট ধামাচাপা দেয়, সে কেমন রিপোর্ট তৈরি করবে তা নিয়ে ষোলো আনা সংশয় থেকেই যায়।

gram

 

বেকারি বাড়ছে গ্রাম, নগর, শহর, শিল্পাঞ্চলে সর্বত্র। সিএমআইই রিপোর্ট আরও উল্লেখ করেছে, প্রতি ৪ জন পিছু কাজ চলে গেছে ১ জনের। মোট কর্মরত ৪০০ মিলিয়নের মধ্যে মে মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কাজ হারানোর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪ মিলিয়ন। ভারতে বেকারি বৃদ্ধির এই চেহারার মধ্যে পর্যবেক্ষরা অনুভব করছেন গত শতকের তিরিশের দশকের মহামন্দার অশনি সংকেত। ১৯৩৩-এর মহামন্দার বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমেরিকায় বেকারি ছিল ২৫ শতাংশ। আর আজকের কোবিড সংক্রমণময় বিশ্ব পরিস্থিতির অন্তর্গত ভারতে বেকারি অতিক্রম করে গেছে ২৭ শতাংশ। এ এমনই মন্দা যেখানে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের অভাব নেই, কিন্তু লোকের কেনার ক্ষমতা নেই, হাতে কাজ নেই। কাজ উধাও হওয়ার প্রবণতা চলছিল, করোনা পরিস্থিতিতে আরও যাচ্ছে।

pack

 

মোদী সরকার এই কঠিন বাস্তব পরিস্থিতিতে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করল। কিন্তু তার মাত্র ৪০ হাজার কোটি টাকা হল নগদে সরকারি বিনিয়োগ বাবদ, বাকি সব কেবল ঋণ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ। ৪০ হাজার কোটি টাকার নগদ বরাদ্দটা গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত বাবদ। আর সেটা গ্রামীণ পরিযায়ী শ্রমিকদের ইতিমধ্যে গ্রামে ফিরে আসার ঢল দেখে। ২০২০-২১-এর কেন্দ্রীয় বাজেটে এই প্রকল্পে বরাদ্দ ধরা আছে ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৪০ হাজার কোটি যোগ করলে মোট ধার্য বরাদ্দের পরিমাণ ১ লক্ষ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তবে গোড়াতেই গত বছরের বকেয়া মজুরি মেটাতে খরচ হবে ১১ হাজার কোটি টাকা। তারপর বিজ্ঞাপন ও সরঞ্জাম বাবদ বড় অঙ্কের ব্যয়বৃদ্ধির বোঝা চাপবে। সেসব কেটেকুটে এই প্রকল্পে জব কার্ড থাকা আর না থাকা অংশের মজুরদের এবং ফিরে আসা গ্রামীণ পরিযায়ীদের যোগফলে কর্মসংস্থান কতটা হবে? প্রশ্নটা ঝুলেই থাকছে। কেন্দ্র প্রচার করছে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি কর্মদিবস সৃষ্টি হবে। সুতরাং ঘরে ফেরা পরিযায়ীরা কাজ পাবেন। অন্যদিকে এই প্রকল্পে কাজের ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা হয়ে আছে বছরে ১০০ দিন মাত্র। আর এযাবৎ জব কার্ড পাওয়া মজুর সংখ্যা ১৪ কোটি। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে পরিবার পিছু কর্মসংস্থান হয়েছে বছরে গড়ে ২৫ দিন মাত্র। কেন্দ্র বলতে চায়, জব কার্ড পাওয়া সংখ্যা যত, চাহিদা কেবল ততটাই। বিপরীতে দাবি রয়েছে জোরদার, বছরে কাজ চাই ২০০ দিনের এবং মজুরি তিনগুণ বাড়ানোর। কিন্তু আসলে বাজেট বরাদ্দ অনুযায়ী কার্ডের কোটা স্থির হয়, মজুরি বাড়ে নামে মাত্র, কাজ ও মজুরি দেওয়া নিয়ে দুর্নীতি-দলবাজি সবই হয়। বর্ষার সময় কৃষি কাজে ক্ষেতমজুরির অভাব ঠেকাতে এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকে। এবারের বর্ষায় সরকার বলছে কাজ চালু থাকবে এবং সেই কাজ পাবে ফিরে আসা সেই শ্রমিকরা যাদের কৃষির ওপর নির্ভরশীল জনস্ফীতির চাপের কারণে গ্রামীণ কাজের অভাবে হতে হয়েছিল পরিযায়ী। কেন্দ্র জানাচ্ছে ২০১৯-এর মে মাসের তুলনায় ২০২০-র মে মাসে এই প্রকল্পে কাজের আবেদন বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। যাই হোক, কেন্দ্রের প্রকল্পকে হাতিয়ার করে কাজের অধিকার কার্যকরী করতে নামতে হবে নতুন লড়াইয়ে।

unemp

 

শহর-নগর-বন্দরে-শিল্পাঞ্চলে বেকারির চিত্র আরও ভয়াবহ। আইএলও-র সমীক্ষায় ভারতে শ্রমজীবী মানুষের ৯০ শতাংশ কর্মরত ইনফর্মাল সেক্টরে। ২০২০-র দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে দারিদ্রের কবলে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৪০০ মিলিয়ন শ্রমজীবী জনতার, আর কাজ হারাতে পারেন ১৯৫ মিলিয়ন মানুষ। এই বিপদ সবচেয়ে বেশি তীব্র ও ব্যাপক হবে নির্মাণ, পরিবহণ ও উৎপাদনশীল ছোট-মাঝারি কলকারখানায়। যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় থাকেন অস্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিকেরা। এমনকি বেতন পাওয়া চাকরিজীবীদেরও নিশ্চিন্ত থাকার উপায় নেই। কারণ বহুক্ষেত্রেই না থাকে নিয়োগের বৈধ চুক্তিপত্র, না মেলে সবেতন ছুটি, না রয়েছে সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ-সুবিধা। কোবিড জর্জরিত পরিস্থিতিতে রুজি-রোজগারের নিরাপত্তা আরও হরণ হওয়ার বিপদ বেশি। আবার অনেকক্ষেত্রে সৃষ্টি হতে পারে পরিযায়ীদের কর্মস্থলে ফিরতে চাওয়া না-চাওয়াকে কেন্দ্র করে মজুরের চাহিদা ও যোগান ও মজুরির মান নির্ধারণজনিত জট-জটিলতা বৃদ্ধির সমস্যা। তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও ক্ষেত্রেও রয়েছে কোবিড উত্তর পরিস্থিতির শিকার হওয়া নতুন বেকারি বৃদ্ধির বিপদ। কারণ ভারতে কর্মসংস্থানের এই ক্ষেত্রটি চলছে মূলত পরনির্ভরতায়। এর বরাত সংযোগের ৬০ শতাংশ রয়েছে আমেরিকায়, ৩০ শতাংশ ইউরোপের দেশগুলোতে, ভারতের অভ্যন্তরে ১০ শতাংশ মাত্র।

বেকারি বৃদ্ধির এই প্রবণতাকে কার্যকরী নিরসনমুখী করাতে  হলে ঋণ ঝোলা দেখানোয় কোনও কাজের কাজ হবে না। বাড়ানো চাই প্রধানত সরাসরি সরকারী বিনিয়োগ। সেই সাথে বিলগ্নীকরণ ও বেসরকারীকরণের সর্বনাশা পন্থা প্রত্যাহার করে কর্মসংস্থানের দায়িত্ব নিতে হবে সরকারপক্ষকে। নাহলে ত্বরান্বিত হবে আরও অশেষ দুর্গতি এবং তার অনিবার্য পরিণাম হিসাবে বিস্ফোরক পরিস্থিতি।

খণ্ড-27