১৯ জুন ‘সর্বদলীয় বৈঠকে’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য চীন-ভারত এলএসি সংঘাত প্রসঙ্গে স্পষ্টতা প্রদানের বদলে আরও একগুচ্ছ প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছে। চীনা বাহিনীর সাথে হাতাহাতি সংঘর্ষে এক কর্নেল সহ কুড়ি জন ভারতীয় সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে – অবিসংবাদিত এই একটি মাত্র দুঃখজনক সত্যই তিনি মেনে নিয়েছেন। চারজন অফিসার সহ দশ জন সৈনিককে শেষ পর্যন্ত চীন মুক্তি দিয়েছে, কিন্তু মোদি সরকার একবারের জন্যও স্বীকার করেনি যে, কোনও সৈনিক নিখোঁজ অথবা চীনের হাতে বন্দী।
প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতের দিকে চীনের অনুপ্রবেশ ও কাঠামো নির্মাণ প্রসঙ্গে বিদেশ মন্ত্রক যে বিবৃতি জারি করেছিল তাকেও কার্যত বিরোধিতা করলেন মোদি। তিনি যে তত্ত্ব দিলেন – ‘কেউ ঢোকেনি, ঢুকে থেকে যায়নি, কোনও সেনা চৌকি দখল করেনি’ – তা সকলকেই অবাক করে: তাহলে ডি-এস্কালেশন ও ডিসএনগেজমেন্ট বিষয়ে এত কথাবার্তা চলছিল কোত্থেকে! এত দীর্ঘ কাল ধরে ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা গালোয়ান উপত্যকায় চীন যখন নিজের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করছে, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী চীনের বিরুদ্ধে অনধিকার অনুপ্রবেশের সবরকম অভিযোগকেই নাকচ করে দিচ্ছেন। তাহলে মোদি সরকার কি চীনের দাবিই মেনে নিচ্ছে? যদি কেউই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন না করে থাকে তাহলে কীভাবে ও কেন আমাদের সৈনিকদের মরতে হল?
লাদাখ অঞ্চলের এলএসি বরাবর ভারত-চীন মুখোমুখি বিরোধের এই সমগ্র পর্ব জুড়ে দেশকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এবং কুড়ি জন জওয়ানের আত্মত্যাগ, অনেক সংখ্যকের আহত হওয়া ও অনেক কষ্টসাধ্য বোঝাপড়ার শেষে চীন থেকে দশ জওয়ানের মুক্তি সম্ভব হওয়া – এত সবের পরও ‘সব কিছু ঠিক আছে’ বলে দাবি করে মোদি সরকার আমাদের বৈদেশিক নীতিকে স্পষ্টতই এক গভীর সংকটের আবর্তে ঠেলে দিচ্ছে। আর তাও এমন একটা সময়ে যখন সারা দেশ একদিকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ও অন্যদিকে লকডাউনে বৃদ্ধি পাওয়া অর্থনৈতিক অবনতি ও অস্থিরতা যুগপৎ ধাক্কার মুখে রয়েছে।
সরকারের ভাবগতি থেকে যত স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে সামরিক-কূটনৈতিক-রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে সরকার চীনের অবস্থানকেই নীরবে মেনে নিচ্ছে, সংঘ-বিজেপি শিবির তা আড়াল করতে তত জোরে গলা ফুলিয়ে বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে পাগলের মতো অবান্তর সব অভিযোগ তুলছে আর চীনকে বয়কট করার নামে ভারতীয় জনসাধারণকে চীনা পণ্য কেনাবেচার অভিযোগে গালাগাল দিচ্ছে। এরকম অভিযান ভারতের লক্ষ লক্ষ খুচরো ব্যবসায়ীকেই কেবল ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
তথ্য বলছে মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সবিশেষ বৃদ্ধি পেয়েছে যার ফলে বর্তমানে চীন ভারতের সব চেয়ে বড় বাণিজ্যিক সহযোগী। এমনকি প্যাটেলের মূর্তিটিও তো ‘মেড ইন চায়না’ এবং সীমান্তে দুদেশ মুখোমুখী সংঘাতে দাঁড়িয়ে পড়ার পরও চীনা কোম্পানিগুলিকে বিভিন্ন বরাত পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভারতের বৃহৎ টিভি-চ্যানেলগুলি চীনা কোম্পানিদের বিপুল বিজ্ঞাপণের অর্থবলে বলীয়ান, আর চীনা কোম্পানি ও চীনা পুঁজির সঙ্গে ভারতের বড় বড় কর্পোরেট ঘরানার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার কথাও নতুন করে বলার কিছু নাই।
লজ্জার কথা হল প্রধানমন্ত্রী মোদি এই সীমান্ত সংঘাত ও ভারতীয় সৈনিকদের মৃত্যুকে বিহারের বিশেষ গর্ব হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেছেন, যেহেতু ঐ জওয়ানেরা ছিলেন ‘বিহার রেজিমেন্টের ১৬নং ব্যাটেলিয়ন’-এর অন্তর্ভুক্ত। বিহারে আর মাত্র কয়েক মাস বাদেই নির্বাচন। অমিত শাহের ডিজিটাল সভার মধ্যে দিয়ে ইতিমধ্যেই বিজেপি তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন মোদি এখন ইণ্ডিয়ান আর্মিকে আঞ্চলিক লাইনে প্রজেক্ট করতে শুরু করেছেন। কর্নেল সন্তোষ বাবু তেলেঙ্গানার মানুষ, অন্যান্য নিহত জওয়ানেরাও বিহার সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা। বিহারের মানুষেরা আঞ্চলিক পরিচিতি বা কে কোন রেজিমেন্টে ছিল সে হিসাব না করে সমস্ত নিহত সৈনিকের প্রতিই সমান শ্রদ্ধার আবেগ বোধ করবেন।
লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘাতের প্রকৃত সত্য তথা ভারতের চীন-নীতি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন গোটা দেশকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আমরা ভারতের জনসাধারণের কাছে আবেদন জানাব সরকারের কাছ থেকে এইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর ও প্রকৃত তথ্য দাবি করতে। দেশের ভূখণ্ডগত প্রশ্নে দেশের জনতাকে অন্ধকারে না রাখার দাবি জানাব আমরা সরকারের কাছে। যে সরকার সবসময় সীমান্তে মোতায়েন সৈনিকদের দোহাই দিয়ে দেশের অভ্যন্তরের সংগ্রামকে দমন করতে চেয়েছে সেই সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে কীভাবে ভারতীয় সৈনিকদের অস্ত্রহীন অবস্থায় সীমান্ত-সংঘাতে ঠেলে দেওয়া হল এবং এতগুলো প্রাণ অকালে ঝরে গেল।
- সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি