বাঘজানের মর্মান্তিক অগ্নিকান্ড প্রাকৃতিক সম্পদ লুট ও সরকারের চূড়ান্ত উদাসীনতার পরিণতি
bag

[গত ১০ এবং ১১ জুন, ২০২০ তারিখে সিপিআই(এমএল)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বলিন্দ্র শইকীয়ার নেতৃত্বে পার্টির ডিব্রুগড় জেলা কমিটির সম্পাদক বিতোপন বকলীয়াল, আইসার লোপামুদ্রা তামুলী, বিশাল কল, সুরজ মাহালী, নৈহৃত গগৈ, ঊর্নিষা স্বর্গিয়ারী এবং তেজপুর চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রী অনিশা গগৈকে নিয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের ডিব্রুশৈখোয়ার বাঘজান তৈলখাদের বিস্ফোরন স্থান ও আশ্রয় শিবিরগুলি পরিদর্শন করে। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা ও আক্রান্ত মানুষ, অঞ্চলটির সচেতন নাগরিকদের সাথে যে বার্তালাপ হয়েছে তার ভিত্তিতে নিম্নোক্ত প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হলো।]

৯ জুন তিনসুকিয়া জেলার বাঘজান তৈলখাদে আগুন লেগেছে। ১০ জুন আমরা ঘটনাস্থল অভিমুখে মোটর সাইকেলে রাজগড় থেকে যাত্রা করলাম। গুইজান পুলিশ ফাঁড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি .... মোটর সাইকেলে থাকা সত্ত্বেও বড়ো বড়ো লোহার পাইপ ফেলার শব্দ শুনতে পেলাম। আমরা প্রথমে ধরতেই পারিনি, শব্দটা কিসের! ধীরে ধীরে বেশ বড়ো আগুনের কুন্ডলী দৃষ্টিগোচর হলো। শব্দ আরো বেশি তীব্র। আমরা আরো কাছে যাচ্ছি। যতো কাছে, ততো তীব্র! নতুন গাঁও-এর কাছে মাগুরি মটাপুং বিলের ওপরের পাকা সেতু পার হয়ে আমরা দেখেছি বিজেপি সরকারের দূষণ মুক্ত আসাম কী তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছে! সেই তীব্রতা আগুনের শব্দ আর উত্তাপের থেকেও বেশি। আমরা যখন অগ্নিকুন্ডের প্রায় ২০০ মিটারের কাছাকাছি গিয়েছিলাম অঞ্চলটির তাপমান স্বাভাবিক ছিলো না। সেখানে বেশিক্ষণ থাকাটা সম্ভব নয়। আগের দিন কিরকম অবস্থা হয়েছিলো যার ফলে দুর্লভ গগৈ ও তিখেশ্বর গোহাঁইকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো! এঁরা ছিলেন অয়েল ইণ্ডিয়ার শ্রমিক। ওঁদের কেন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হবে না?

বাঘজান তৈলখাদে আপনাকে ডুমডুমা হয়ে যেতে হবে। অয়েল ইণ্ডিয়া নিজের সুবিধার জন্যে মাগুরি বিলের কাছে নতুন গাঁও থেকে বিলের ওপর দিয়ে সেতু বানিয়ে একটা পাকা রাস্তা নির্মাণ করে নিয়েছে। আমরা বাঘজান খাদের একটি ছোটো অংশই এই দিক থেকে দেখতে পাই। ২৭ মে ২০২০ তারিখ বাঘজানের খাদ থেকে গ্যাস নির্গমন শুরু হয়েছিলো। নতুন গাঁও-এর মানুষেরা আন্দোলন শুরু করলো ডিব্রুশৈখোয়া রক্ষা ও খাদ বন্ধের দাবিতে। একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যানের সীমানার খুব কাছে যেকোনো ধরনের খননকার্য বেআইনি। উল্লেখযোগ্য যে, এর আগে কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির পক্ষ থেকে সেসিমিক সার্ভের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয়েছিলো।

গ্যাস নির্গমনের সপ্তম দিনে নতুন গাঁওয়ের আন্দোলনকারীদের স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে দূরে গিয়ে থাকতে বলা হলো কারণ গ্যাস নির্গমনের ফলে মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট, বমি, মাথা ব্যথা ইত্যাদি হচ্ছে। কিন্তু দূরে যেতে হবে নিজেদের উদ্যোগে। তার সাথে এটাও বলা হলো যে প্রশাসনের তরফ থেকে রেশনের ব্যবস্থা করা হবে ও তিনসুকিয়া জেলার ডেপুটি কমিশনারের সাথে দাবি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ির ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েরা আজও আত্মীয়দের বাড়িতে আছে। অন্যান্য মানুষেরা বেশির ভাগ নিজেদের বানানো শিবির থেকে ১৪ দিন পরে আর গন্ধ না থাকায় ফিরে এসেছে। ১৪ দিনের মধ্যে একদিনের জন্যেও সরকার বা প্রশাসন রেশনের ব্যবস্থা করেনি। প্রশাসন যেদিন আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো সেইদিন আগুন লাগার ফলে আলোচনাও হলো না। প্রশাসনের তরফ থেকে লোকজনদের মাত্র একটি করে সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছিলো। পোষ্য জীবজন্তুর ক্ষেত্রেও একই ব্যবহার। এখন আগুন লাগার পরের দিন অর্থাৎ ১০ জুন সরকার থেকে ১৪ কেজি করে “চাপর” (জন্তুর খাদ্য) দেওয়া হয়। নিতুমনি চুতিয়া, দীপাঞ্জলী ঘরফলীয়া, হরেন গগৈ দের কাছ থেকে কথাগুলো শুনে অবাক হলাম।

caee

 

আমরা খাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। সবুজ ডিব্রুশৈখোয়ার সুন্দর ঘাস জ্বলে গেছে। খাদের আশেপাশের ৫০০ মিটারের বেশি অঞ্চলের বন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রায় ২ কিলোমিটার দূরের গাছের পাতা লাল হয়ে গেছে। আমরা যখন খাদের কাছে গেলাম, কোনো সুরক্ষা কর্মী ছিলো না। জন এনার্জি বা অয়েলেরও কোনো লোককে দেখতে পেলাম না। ঘুরে আসার সময় তিনজন পুলিশ কনস্টেবলের সাথে দেখা হলো। বললো ওঁদের আইসি কাল কোনোভাবে বেঁচে ফিরেছে। গত ২৭ মে থেকে ওঁরা ওখানে সুরক্ষার জন্য নিয়োজিত আছেন। গ্যাসের দুর্গন্ধ কিন্তু মাস্ক অথবা আগুন নেভানোর আধুনিক সরঞ্জাম কোনো কিছুই নেই। বাঘজানে মোট ২০টি খাদ আছে। ডিব্ৰুগড় লেপেটকাটার বিসিপিএল ও আপার আসামের প্রত্যেকটি উদ্যোগ মূলত চা ফ্যাক্টরিকে বাঘজান থেকেই গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। অয়েলের নিজস্ব প্রতিবেদন অনুযায়ী বাঘজান বন্ধ হয়ে গেলে বিসিপিএল বন্ধ হয়ে যাবে।

নিরন্ত গোহাঁয়ের সাথে দেখা করলাম। ঘটনাটা ঘটার সময় থেকে তিনি দিন রাত সেতুর ওপরেই আছেন। তিনি বললেন অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, ডলফিন শেষ হয়ে যাবে। যে ডলফিনকে আগে নাকি বিরিনা পাতার তীর দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ডলফিন এতটাই স্পর্শকাতর যে একফোঁটা তেল গায়ে পড়লেও মৃত্যু হতে পারে। মাগুরী বিলে অজগর, কচ্ছপ, বহু প্রজাতির মাছ, বিশাল হাওর আছে। তাঁর মতে এই ঘটনার ফলে ব্রহ্মপুত্রের নীচের অংশে ব্যাপক ক্ষতি হবে। নতুন গাঁও-এর ৪ জন লোকের এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন এই মৃত্যুর পিছনে গ্যাস নির্গমনের প্রভাব আছে। গোঁহাই একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন, এতদিন অয়েল এখানে কাজ করছে কিন্তু দুর্যোগ আসলে লোকজনেরা কী করবে কী করবে না ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে তাদের সচেতন করার জন্য গত ১৮ বছরে কিছুই করেনি। তিনি বলেন আমাদের গ্রামের বেশির ভাগ লোকের জমির পাট্টা নেই, অন্য রাজ্য থেকে আসা লোকেদের যে যুদ্ধকালীন তৎপরতার সাথে পাট্টা দেওয়া হয়, স্থানীয় লোকের ক্ষেত্রে তার ঠিক উল্টোটা। ডিব্রুশৈখোয়া রক্ষা করার জন্য গোহাঁইরা প্রচুর আবেদন নিবেদন করেছিলেন কিন্তু সমস্ত আবেদন নস্যাৎ করে দিয়ে গুজরাটের জন এনার্জি, যার কি পারদর্শিতা আছে কেউই জানে না (লোকের মুখ থেকে শোনা গেছে যে, তারা হয় লোহার বা কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিল) সেই ধরনের একটা কোম্পানিকে খননের ঠিকা দেওয়া হলো। বাঘজানের অগ্নিকাণ্ডের সমগ্র ঘটনা সম্পর্কে তিনি (গোহাঁই) ইতিমধ্যেই গৌহাটি হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ জনিত আবেদন দাখিল করেছেন। তিনি বলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই যে অয়েল এবং সরকার সময়মতো যদি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতো তাহলে এই ধরনের ঘটনা সংঘটিত হতো না। চূড়ান্ত গাফিলতি ও উদাসীন মনোভাবের ফলেই আজ মানুষ ও প্রকৃতি তথা অবলা জীব জন্তুকে তার মূল্য দিতে হলো। নিরন্ত গোহাঁই এবং বৃদ্ধ হরেন গগৈ ও অন্যান্যদের সাথে কথা বলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আগুন তখনও জ্বলছে। সমগ্র অঞ্চল লাল। হ্যাঁ ... এই আগুন জ্বলছে সবার মনে প্রাণে। এই আগুনই নতুনের সংবাদ বয়ে আনবে। আমরা সবাই সেই আশাতেই নতুন গাঁও থেকে বিদায় নিলাম।

১১ জুন রাতে আমরা শহীদ গঙ্গারাম কোলের বাড়িতে থেকে সকালেই ডুমডুমা হয়ে বাঘজানের দিকে রওনা হলাম। সকাল থেকেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই আমরা বাঘজান পৌঁছালাম। জাতীয় বিদ্যালয়ে বাঘজান মিলন জ্যোতি সংঘের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা হলো। আমাদের আগেই লোপামুদ্রা সেখানে হাজির। প্রবীন বরা, প্রাঞ্জল গগৈ, জিন্টু হাজরিকা, মনোজ হাজরিকা ও হেমন্ত মরান সহ অনেকে প্রথম থেকেই খননের বিরোধিতা করছিলেন যুব সংঘের ব্যানার সামনে রেখে। ওঁরা বললেন : ২০০২ সাল থেকে খননের কাজ শুরু হয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করলাম। বহু মানুষের জেল হলো। ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চলল পুলিশ সেনার নির্যাতন। যে কোনো সময়েই থানা থেকে ডেকে পাঠায়। রাত ১টা ২টোর সময় সেনাবাহিনী এসে স্থানীয় ক্যাম্পে উঠিয়ে নিয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা আলফার সাথে জড়িত আছে এই অভিযোগে নানান নির্যাতন চালিয়েছিলো। মনোজ হাজরিকা জানালেন যে তাঁর বাবা সরকারী গাঁওবুড়া ছিলেন। ছেলে আন্দোলন করছিলো বলে ওঁকে একবছর সাসপেন্ড করা হয়েছিলো। তিনি বললেন ভয়, হুমকি এবং লোভ সমস্ত প্রয়োগ করে খনন কাজ চলল। এবং খননের ১০ বছর পরে ২০১২ সালে প্রথম গণ হিয়ারিং বাঘজান বাগানের খেলার মাঠে হয়েছিলো। ওঁরা তখনও প্রতিবাদ করেছিলেন, কিন্তু কথা শুনলো না। যুব সংঘের অন্যান্যদের মতে এই ঘটনার জন্য মূলত দায়ী জন এনার্জি। তাড়াহুড়ো করে সিমেন্টিং করার ফলে এই রকম ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। গত ৬ বছরে এই অঞ্চলে বিষাক্ত কীটপতঙ্গ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৬ বছরের বেশি হয়ে গেলো গ্রামে গাছের পোকামাকড় খেতে আগের মতো পাখিরা আর আসে না, প্রচন্ড শব্দের জন্য। অঞ্চলটির ৮০% লোক মাছ ধরে সংসার চালায়। তাঁরা বললেন এখন মাছের ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোনোর সময়েই এই ঘটনা ঘটলো। তাঁরা এর ক্ষতিপূরণ দাবি করার সাথে সাথে মাগুরি বিলের জল পরিস্কার করারও দাবি জানায়। বাঘজানের ব্রহ্মপুত্রের কাছের গ্রামটিতে বর্ষার জল যাতে ঢুকতে না পারে তার জন্য একটি ৫০ মিটারের বাঁধ আছে। ভরা বর্ষাতেও বাঁধের ৮ ফুট জলের ওপরে থাকে। এখন প্রতিদিন ভাইব্রেশন হওয়ার ফলে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে। আর যদি এই রকম হয়, তাহলে বাঘজান জলের নীচে তলিয়ে যাবে। তাঁদের মতে ১০০ বছর ওঁরা পিছিয়ে গেলেন। ওখানকার লোকেরা নিজেদের বাড়িতে সুপুরি, চা, গোলমরিচ এবং আরো বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে খুব সুন্দর বাগান তৈরি করেছিলেন। আমরা কথা বলে জানতে পারলাম যে ৫০টা বাড়ি ও বাগান জ্বলে ছাই হয়ে গেছে। অনুমান করা যায় এক একটা পরিবারের প্রায় ২০ লাখ টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে। পুড়ে যাওয়া জমিতে এখন কিছুই হবে না। সুতরাং ওঁরা মাটির বদলে মাটি ও ১০০ বছরের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। ২৭ তারিখ গ্যাস বেরোনোর দিনেই প্রায় ২০০০ এরও বেশি মানুষকে স্থানীয় বাঘজান দীঘল তরং এম ই স্কুলে রাখা হয়েছিল। গ্যাস বেরোনো খাদটির ৫০০ মিটার ভেতরে যাদের বাড়ি তাদের নিজের ঘর বাড়ি, পোষ্য জীবজন্তু দেখাশোনা করতে যাওয়ার সময় সই করে যেতে হয়েছিল। যদি কিছু ঘটে তার জন্য তিনি নিজে দায়ী থাকবেন। আগুন লাগার দিন এদের আশ্রয় শিবির থেকে করদৈগুড়ি আশ্রয় শিবিরে নিয়ে যাওয়া হলো। যুব সংঘের সদস্যরা জানান নতুন করে ৭টা খাদ খননের যে অনুমতি লকডাউনের সময় বিজেপি সরকার দিয়েছে, সেই সম্পর্কে ১২ মার্চ ২০২০ তারিখে বাঘজান বাগানের খেলার মাঠে গণ হিয়ারিং হয়েছিল। তখনও প্রতিবাদ করা হয়েছিলো, কিন্তু ওরা কোনো কথারই গুরত্ব দিলো না।

gad

 

আমরা যুব সংঘের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আশ্রয় শিবিরগুলোতে গেলাম। যাওয়ার পথে দেখলাম দৈত্যাকার পাইপ গুলো রাস্তার ধারে পরে আছে গ্যাস নেওয়ার জন্য। বাঘজানের মোট ২০ টা খাদ গ্রামের মধ্যে আছে। আগুন লাগার দিন বাঘজানের সাথে দীঘল দলং ও কলিয়াপানী অঞ্চলটির মোট ৭ হাজার লোককে করদৈগুড়ি, বান্দরখাটি, জকাইচুক ও দিয়ামুলী আশ্রয় শিবিরে রাখা হয়েছে। বান্দরখাটি আশ্রয় শিবিরের লোকেরা জানালেন যে বাড়ি থেকে ওনাদের নিজেদের আসতে হয়েছে। কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থাই করে দেয়নি। করদৈগুড়ি আশ্রয় শিবিরে মূলত যে ৫০টা বাড়ি পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো তাদের সাথে গ্রামের অন্যান্য লোকেরাও আশ্রয় নিয়েছে।

বর্ণালী মরানের সাথে দেখা করলাম। খাদের কাছের প্রথম ঘরটাই ওঁদের। হাতে দেখলাম লাল লাল ফোঁড়ার মতো বেরিয়েছে। ৯ তারিখ থেকে শিবিরে মশারি ছাড়াই আছে মশার কামড় খেয়ে। মরানের ঘরের সাথে বাঁশ, সুপারি, চা, পোষা জীব জন্তু সমস্ত শেষ। ২০১২ সালেও ওঁরা পাইপ লাইন বসানোর বিরোধিতা করেছিলেন। তখনও আগের মতোই চলেছিলো পুলিশের নির্যাতন। তিন জনের জেল হয়েছিলো। আশ্রয় শিবিরে সাক্ষাৎ হওয়া যুব সংঘের একজন সদস্য বললেন উদ্যোগমন্ত্রী চন্দ্রমোহন পাটোয়ারীর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। কাল আমরা অনেক প্রশ্ন করলাম কিন্তু উত্তর দিলেন না। উল্লেখযোগ্য যে চন্দ্রমোহন পাটোয়ারী কাল করদৈগুড়ি শিবিরে মানুষের ক্ষোভ থেকে কোনোরকমে বেঁচে গেছে। শিবির পরিদর্শনে গিয়ে চন্দ্রমোহন বাবু বলেছিলেন রাশিয়া, ইরান, ত্রিপুরায় বাঘজানের থেকে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। জনগন একথার প্রতিবাদ করে বলে, “রাশিয়ার কথা না বলে বাঘজানের কথা বলুন। আপনি রাশিয়ার মন্ত্রী না আসামের? আমাদের তো সব শেষ হয়ে গেলো, তার ক্ষতিপূরণের কী হবে?” এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারলেন না আর কোনো ঘোষণাও করতে পারলেন না। অয়েল যা বলেছিলো সেগুলোই বললেন, আসাম সরকার কোনো সাহায্য, ক্ষতিপূরনের প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারেনি। ঠিক এই ভাবেই মন্ত্রী যোগেন মোহনও অয়েলের গ্যাসের জন্য মাগুরি মটাপুং বিলের নদী ডলফিন, মাছ, কচ্ছপ মরেনি ইত্যাদি হালকা কথা বলে অয়েলকে রক্ষণাবেক্ষণ দিয়েছিল। মানুষ তখনও প্রতিবাদ করেছিল। জানা যায় দুর্লভ গগৈ এর পরিবারকে ‍১ কোটি ও তিখেশ্বর গগৈ এর পরিবারকে ৬০ লাখ টাকা দেওয়ার কথাটাও মিথ্যা প্রচার। এটা নিহত দুই ব্যক্তির অয়েলে চাকরি করা কালীন প্রাপ্য টাকা (নিহত হয়েছে বলে অবসরের সময় পর্যন্ত মাইনে পাবে) ছাড়া অন্য কিছু নয়।

cer

 

অপরদিকে, খুবই দুঃখজনক যে, মহিলাদের স্নানের কোনো ব্যাবস্থা আশ্রয় শিবিরগুলিতে নেই। কোনো কোনো শিবিরে মশারির ব্যাবস্থা আছে, কোনো কোনো শিবিরে নেই। ভেতরের অবস্থা বাসযোগ্য নয়। বোঁটকা গন্ধ। দিয়ামুলী শিবিরে দেখলাম ওখানকার লোকেরা চন্দ্রমোহন পাটোয়ারীর প্রতিকৃতি পোড়ানোর প্রোগ্রাম নিয়েছে। আমাদের সঙ্গে মানস তামুলী ছিলেন। উনি জানালেন CSR-এর নামে লাভের ২% খরচ করার কথা কিন্তু ২০১২-১৩ বর্ষে অয়েল খরচ করেছে ১.৪১%। অয়েল এই টাকা রাস্তা তৈরির খরচের মধ্যে দেখায়। কিন্তু সেই রাস্তা গুলোর বেশির ভাগ তাদের খাদের রাস্তা। একফোঁটা তেলও উৎপাদন করে না যে দিল্লীর করপোরেট অফিস, তাদের দেওয়া হয় ৫ কোটির থেকেও বেশি টাকা।

২০০২ ও ২০২০ দুটো সময়েই কেন্দ্রে বিজেপি সরকার। প্রথম অবস্থায় সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, মাফিয়া কায়দায় খনন করা হলো। আর এখনও দুর্যোগের বলি হওয়ার জন্য মানুষকে শুধুমাত্র বাধ্য করাই নয় মৃত্যু মুখে ঠেলে দেওয়া হলো।

আমরা দাবি জানাই

  • ১. দুটি সরকারের দিনে সংঘটিত এই ঘটনার এক উচিত তদন্ত করা হোক।
  • ২. বাঘজানকে অন্য এক কংগো হতে দেওয়া চলবে না।
  • ৩. আশ্রয় শিবিরে মানুষদের লকডাউনের সময়ে এই ভাবে রাখাটা কতটা সঠিক? অয়েলকে নিজের সমস্ত গেষ্ট হাউস বা হোটেলে এই মানুষদের রাখার ব্যাবস্থা করতে হবে ও প্রতিদিন মাথাপিছু ৫০০ টাকা করে দিতে হবে।
  • ৪. অগ্নিকাণ্ডের সব ঘটনার প্রকৃত তদন্ত তাৎক্ষণিকভাবে সরকারকে ঘোষণা করতে হবে।
  • ৫. ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত লোককে এককালিন ২০ লাখ করে টাকা দিতে হবে।
  • ৬. সমস্ত ক্ষয় ক্ষতির সার্ভে করে প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে।
  • ৭. সরকারী সম্পদের ব্যক্তিগতকরণ বন্ধ করতে হবে।
  • ৮. বহনক্ষম উন্নয়নের নীতি কঠোরভাবে পালন করতে হবে।
  • ৯. পরিবেশতন্ত্র রক্ষা করতে হবে।

গত ১৮ বছর ধরে বাঘজানের বুক থকে যে সম্পদ আমাদের সরকার আহরণ করে লাভ করেছে তার তুলনায় এই দাবিগুলি আর্থিক দিক দিয়ে নগণ্য। আশ্চর্যজনক ভাবে বাঘজানের গ্যাস নির্গমন হওয়ার সময়ে রাজ্যের বিজেপি সরকারের বহু মন্ত্রী, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়, উপর আসামের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করছিল। কিন্তু বাঘজানের কাকুতি মিনতি একবারও শোনার সময় ওঁদের হলো না।

আশ্রয় শিবিরগুলো পরিদর্শন করে ফেরার সময় কালো মেঘ চিড়ে সূর্য বেরোলো ... পরিস্কার আকাশ ... দূরের পাহাড়গুলো সূর্যের আলোয় ঝলমল করে উঠেছিলো। আমাদের চোখে বারবার ভেসে আসছিলো ক্ষোভ বেদনায় লাল হয়ে যাওয়া আক্রান্ত মানুষের মুখগুলো। ভাবলাম বাঘজানের মানুষগুলোর মন প্রস্ফুটিত ও ঝলমলে করে তোলার জন্য আমাদের সরকার সত্যিকারের কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা। যদি না নেয় বাঘজানের মানুষের বুকে জ্বলা আগুন সরকারকেও রেহাই দেবে না। আজ সমগ্র দেশকে বাঘজানের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।

- বলিন্দ্র শইকীয়া, সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিআই(এমএল) 
(অসমীয়া থেকে বাংলায় অনুবাদ: মৈত্রেয়ী বাগচী) 

খণ্ড-27