আমফান ঝড় কবলিত উত্তর ২৪ পরগণার হাসনাবাদ ১নং পঞ্চায়েত এর অন্তর্গত বিভিন্ন গ্রামের মানুষ আজও এক কোমর জলেরতলায়, চারিদিকে জল, শুধুই জল, এক জল থৈ থৈ অবস্থা, আছে শুধুই কালো বাদামি রঙের দুর্গন্ধ যুক্ত জল! চারিদিকে এতো জল অথচ নেই কোনো পানীয় জলের সুসংস্থান; আদতে সবটাই তো লোনা জল,মানুষের পানের জন্য মিষ্টি জল কোথায়? এখনো চলছে পানীয় জলের জন্য হাহাকার! প্রচুর মানুষ এখনো জলবন্দী অবস্থায় দিন রাত এক করে সুদিনের প্রত্যাশায়!
এই জলবন্দী মানুষগুলোর নেই মাথার উপর কোনো ছাউনি, ঝড়ো হওয়ার দাপটে ভেঙে পড়েছে অজস্র মাটির তৈরি বাড়ি, উড়ে গেছে কারো বাড়ির টিনের চাল, ভেসে গেছে মেছো ভেরী, চাষের জমিতে ঢুকে পড়েছে লোনা জল, স্থানীয় পুকুরের জল, ভেরিগুলো আজ ভরে গেছে নদীর লোনা জলে, বিষাক্ত জলে মরা মাছগুলো ভেসে উঠেছে,গাছের পাতা, ডালপালা জলে পড়ে পচে এক দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, অজস্র ছোট বড় গাছপালা উপরে পড়েছে; বিদ্যুতের খুঁটি গুলো বেঁকে গেছে, নয়তো ভেঙে পড়েছে কারো বাড়ির চালে বা কোনো গাছের গায়ে। অজস্র বিদ্যুৎবাহি তার কুণ্ডুলী পাকিয়ে পড়ে আছে, রাস্তায় সাপের মতো যেন সব শুয়ে শুয়ে আছে! আর এরকম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে গ্রামের মানুষজন, স্ত্রী পুত্র কন্যা, ছোট বাচ্চাদের নিয়ে দিনাতিপাত করছেন! বিরাজ করছে চারদিকে এক ধ্বংসলীলার জলছবি, চারদিকে জলের মধ্যে দ্বীপের মতো গ্রাম গুলো জেগে আছে, যা তৈরি করছে অতীব করুণ এক অসহনীয় দৃশ্যপট। এতদ অঞ্চলে এক বীভৎস হিংস্র তান্ডবলীলা চালিয়েছে প্রকৃতি। যেন এক দামাল মদমত্ত হাতি সবকিছুকে দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করে দিয়েছে।
হাসনাবাদ এর ইছামতি নদীর ব্রিজ পেড়িয়ে কালীবাড়ি হয়ে বরুনহাট, লেবুখালী, ভান্ডারখালি , টিয়ামারি, চকখাঁপুর, পুঁটিমারি সহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমফানে একেবারে বিপর্যস্ত-বিধস্ত। ভেঙে গেছে ইছামতী নদীর টিয়ামারীতে মাটির তৈরি নদীবাঁধ! ফলত হাসনাবাদের মূল ভুখন্ড থেকে ওখসনকার মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এই টিয়ামারীর উল্টো দিকেই বেলেডাঙ্গা গ্রাম, প্রায় ৩৫০ পরিবারের বাস, ইছামতী নদীর জলের তোরে প্লাবিত চারিদিকের গ্রামগুলো সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক জনজীবন থেকে আজ দশ বারো দিন ধরে বিচ্ছিন্ন, যেন দ্বীপরাজ্যে অবস্থান করছে এক একটা গ্রাম। বহু মানুষ নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে শুধুমাত্র প্রানের দায়ে আশ্রয় নিয়েছেন পাকাবাড়ি বা স্কুলবাড়িতে। বহু জায়গায় গবাদি পশুকে নিয়ে রাস্তার উপর মানুষ খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছেন এক গভীর অনিশ্চয়তায়। বেঁচে যাওয়া গবাদি পশু গুলোও একটু মিষ্টি জল, খাবারের অভাবে যেন ধুঁকছে। এখানের মানুষের জীবিকা মূলত কৃষিকাজ, আর মেছো ভেরীর কাজের সাথে যুক্ত আর অল্পবিস্তর ছোটখাটো ব্যবসা, কিছু মানুষের জীবিকা হলো ম্যাজিক গাড়ি, ডিজেল অটো, ইঞ্জিন ভ্যান বা ভ্যানো আর টোটো চালনা, অবশ্য কিছু লোকের শহরে দিনমজুরি, বা ছোটখাটো কাজ, উপার্জন বলতে তো এইই। এই নিয়েই তাঁদের জীবনের বারোমাস্য চলে জল ঝড়কে সঙ্গী করেই। এখন কার মানুষ আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মোকাবিলা করেছে ফনি-কেও, কিন্তু এবারের আমফন ঝড় তাঁদের জীবনের সব হিসাবকে একেবারে উল্টে পাল্টে দিয়েছে। একে তো করোনার জন্য লকডাউনের ফলে গৃহবন্দী ছিলেন তাঁরা, তার উপর মড়ার ঘাড়ে খাঁড়ার কোপ হলো এই আমফান ঝড়। ফলে এখানকার মানুষের প্রতিদিনকার যাপন আজ নানাভাবেই ব্যাহত। ফলত এখন স্থানীয় মানুষের হাতে নেই কোনো ধরনের কাজ, নেই একশো দিনের কাজও, তাঁদের চাষের জমিতে জল ঢুকে চাষ আবাদ পুরোপুরিভাবে বন্ধ! আমফনের তাণ্ডবে তাদের ঘরবাড়ি লণ্ডভণ্ড। হাড়হাভাতে মানুষগুলো এখন একটু ত্রাণের আশায় রাস্তার দিকে সব সময় তাকিয়ে আছেন, কখন একটা ত্রাণের গাড়ি আসে, আসলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ত্রাণ-গাড়ির ওপর, আর অসহায় মুখগুলো, আবাল বৃদ্ধ বনিতা প্রতি মুহূর্তে এক গভীর হতাশায় বিষোদগার করছেন স্থানীয় চতুর রাজনৈতিক নেতাদের নামে, এই দুর্বিপকের সময়ে দেখা নেই অনেক তথাকথিত জনদরদী নেতারাও, তাই সরকারী ত্রাণের ছিটেফোঁটা, কিছু কালো প্লাস্টিক ,কিছু চাল মিললেও বেসরকারী ত্রাণ-এর উপর যেন স্থানীয় মানুষের ভরসা বেশি।
এইসব অসহায়, ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত গ্রামীণ মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর মানবিক দায়, তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির পুনর্নির্মাণ, তাঁদেরকে সামাজিকভাবে পুনর্গঠনের জন্য আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো আজ তাই সময়ের ডাক। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আজ হাসনাবাদ-এর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ কার্যের জন্য ৭ জনের একটি টিম হাজির হয় যেখানে বাঁধ ভেঙেছে সেই টিয়ামারীর ঠিক উল্টোদিকেই বেলেডাঙ্গা গ্রামে, যেখান থেকে দেখা যাচ্ছে ভেঙে পড়া মাটির তৈরি বাঁধটা, ওই টিম এর লোকজন শোনেন স্থানীয় মানুষের গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার কথা, শোনেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা, তাঁদের নানান অভাব অভিযোগের কথা। স্থানীয় মানুষের কথায় জানা গেলো, তাঁরা রেশনে চাল আটা পেলেও রান্না করে খাওয়ার উপায় নেই, কারণ চতুর্দিক জলমগ্ন। বসিরহাট ও হাসনাবাদ ও বারাসাত-এর কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন-এর পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার ভাত ডাল তরকারি পৌঁছে দিলেও প্রয়োজনের তুলনাতে তা সত্যিই অপ্রতুল। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এখানেও চলছে ত্রাণ নিয়ে দলবাজি, দুর্নীতি, স্বজন পোষন, এমনকি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারী অনুদান নিয়ে আবেদন পত্র জমা নিচ্ছে না স্থানীয় পঞ্চায়েত। অপরদিকে দূরবর্তী গ্রাম গুলিতে এখনো ঠিক ভাবে পৌঁছাতে পারছেন না অনেকেই, ফলত বহু মানুষ জলবন্দী হয়ে এক চরম দুর্দশাতেই আছেন। তাই তারা আশা করেন তাঁদের জন্য শুকনো খাবার, বাচ্চাদের জন্য বেবিফুড দরকার, দরকার তাঁদের জন্য সাবান, মাথায় মাখার তেল, আর জামাকাপড় কাচার জন্য সাবান। এই গ্রামবাদীদের সাথে আলাপ আলোচনার পরে স্থানীয় কিছু যুবককে নিয়ে একটা আপদকালীন ত্রাণ পরিচালনাকারী টিম তৈরি করে দেওয়া হয় যাদের সাহায্য ও সহযোগিতায় আগামী ৫ জুন হাসনাবাদ ১নং পঞ্চায়েতের বালিয়াডাঙ্গা গ্রাম ও খাঁপুর গ্রামের প্রায় ৫২০টি পরিবারের মানুষদের হাতে প্রচলিত স্বাস্থ্য বিধি বজায় রেখেই ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হবে এক নাগরিক উদ্যোগ এর মাধ্যমে। পরবর্তীতে ওখানকার মানুষদের জন্য একটি অস্থায়ী চিকিৎসা শিবির অনুষ্ঠিত করার গ্রামের মানুষ আবেদন করেন, কারণ এর পরই শুরু হবে জলবাহিত রোগের প্রকোপ।
অসহায় এই মানুষদের সাথে একটু প্রাথমিক কথাবার্তা, যোগাযোগ ও ত্রাণ বিলিবণ্টনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি দল ২ জুন ২০২০ বারাসাত থেকে খুব ভোরে রওনা দেয় হাসনাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এই দলে ছিলেন জয়শ্রী দাস, (মিড ডে মিল রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদিকা), অজয় বসাক, জেলা সম্পাদক ক্ষেত ও গ্রামীণ মজদুর সংগঠন, ছিলেন এআইপিএফ-এর নেতা নির্মল ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ গণ সংস্কৃতি পরিষদের পক্ষে রবীন দাস, পশ্চিমবঙ্গ নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা দেবব্রত (বাবু) বিশ্বাস, ছিলেন সুব্রত সেনগুপ্ত, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক, বসিরহাট-এর ‘চেতনায় বিজ্ঞান’ সংগঠন ও পশ্চিমবঙ্গ সাংস্কৃতিক পরিষদের অন্তর্ভুক্ত “নির্মাণ সাংস্কৃতিক সংস্থা”র মলয় মন্ডল।
আমফান ঝড়ে দুর্গত মানুষদের জন্য যেকোনো ব্যক্তি, যেকোনো ধরনের উদ্যোগ, গণসংগঠন, ক্লাবের সদস্য সমর্থকদের কাছে আবেদন, এই দুঃসময়ে আসুন অসহায় ক্ষুধার্ত দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াই, এই আর্ত মানুষের জন্য আপনার সাহায্যের হাতটা আবার একবার বাড়িয়ে দিন, অতীতেও যেমন দিয়েছিলেন, এবারও আমরা চাই আপনার / আপনাদের হাত ধরেই অসময় থেকে সুসময়ে পৌঁছে যেতে।