কেন? কোন অপরাধে? সে অপরাধ কি মাতৃগর্ভের ভ্রূণকে ত্রিশূলে খুঁচিয়ে হত্যা করার, জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারার, বাইশবার ধর্ষিতা বিলকিস বানোর চোখের সামনে তিন বছরের সন্তানকে আছড়ে মারার থেকেও ঘৃণ্য? অপরিকল্পিত লকডাউনের হঠাৎ ঘোষণায় কয়েক কোটি মানুষের রুটি-রুজি কেড়ে রোদে-জলে খিদে-তেষ্টাকে সঙ্গী করে হাজার মাইল হাঁটতে বাধ্য করা, শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে তীব্র দাবদাহে জল খাবার ছাড়া গাদাগাদি করে তুলে দিয়ে কার্যত অনাহারে তেষ্টায় মেরে ফেলার থেকেও জঘন্য? দেশের মানুষের তিল তিল রক্ত-ঘামে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রের সম্পদকে, নদী পাহাড় খনি জঙ্গলকে দেশি বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার থেকেও গুরুতর? শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে ধ্বংস করে, শিশুদের অপুষ্টি-মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে জাতীয় সম্পদকে মন্দির মূর্তি গড়তে ব্যয় করার থেকেও অমানবিক? করোনা প্রতিষেধকের নামে গোমূত্র গোময়ে তৈরি ‘ওষুধ’ সরকারী হাসপাতালে ‘হিউম্যান ট্রায়াল’ দেওয়ার ষড়যন্ত্রের থেকেও ভয়াবহ?
হ্যাঁ, মোদী অমিত শাহ-র সরকার তেমনটাই মনে করে। এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী আন্দোলনে, প্রতিবাদী ধর্ণা অবস্থানে সামিল হওয়াটা নাকি দেশদ্রোহ! গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য প্রতিবাদ করাটা নাকি রাষ্ট্রদ্রোহ! শ্রমিক কৃষক সংখ্যালঘু দলিত আদিবাসী সাধারণ মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করাটা ‘অপরাধ’! কী ভাবছেন? দেশদ্রোহ রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে? গেছে তো! ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস মোদী অমিত যোগীর রাজত্বে সংবিধান পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাই সংবিধান-বিরোধী সিএএ-এর বিরোধিতা তাদের চোখে এত ভয়ঙ্কর যে একটি মামলায় জামিন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি মনগড়া, মিথ্যা, ভিত্তিহীন অভিযোগে গ্রেপ্তার করে আবার নতুন মামলায় জড়ানো হয়!
তা, এই ‘অপরাধী’টি কে? ২৯ বছরের তরুণী দেবাঙ্গনা কলিতা, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। তাকে এবং জেএনইউ-এর আরেক গবেষক নাতাশা নারওয়ালকে গত ২৩ মে গ্রেফতার করা হয় জাফরাবাদে সিএএ-বিরোধী ধর্ণা অবস্থানে সামিল থাকার জন্য। দু'জনেই ‘পিঞ্জরা তোড়’ নারী আন্দোলনের কর্মী। পরের দিন জামিনে ছাড়া পাওয়া মাত্রই আবার গ্রেফতার করা হয়। উত্তর পূর্ব দিল্লির দাঙ্গায় হত্যা, হত্যার চেষ্টা, দাঙ্গা ও অপরাধ মূলক ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে, দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের আরেকটি ইউনিট। ১৪ দিনের বিচারবিভাগীয় হেফাজতে থাকার সময়েই প্রথমে নাতাশাকে ইউএপিএ-তে গ্রেপ্তার করে স্পেশাল সেল। গত ২৮ মে দেবাঙ্গনাকে আবার গ্রেফতার করা হয় ২০১৯-এর ডিসেম্বর দরিয়াগঞ্জে অবৈধ সমাবেশ ও দাঙ্গা হাঙ্গামায় জড়িত থাকার অভিযোগে। এই মামলায় মঙ্গলবার জামিন পেলেও তাকে অন্য একটি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতেই রাখা হয়েছে। শুধু দেবাঙ্গনা বা নাতাশা নয়, গত দু’মাস ধরে লকডাউনের মধ্যে দিল্লি পুলিশ জামিয়া মিলিয়া বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাফুরা জারগার (চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা) মিরান হায়দার, আসিফ ইকবাল, তান্থা, রাজনৈতিক কর্মী ইশরত জাহান, খালিদ সাইফার, গুলফিশা ফতিমা, সারজিল ইমাম সহ প্রায় শ’খানেক সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্যদের সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে থাকার জন্য গ্রেফতার করেছে। অনেককে ইউএপিএ-এর অধীনে। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ সম্প্রতি আলিয়া মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারহান ফুবেরি, রাভীশ আলি খানকে গ্রেপ্তার করেছে, সিএএ বিরোধিতার জন্য । ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় বিনা বিচারে আটক রয়েছেন অশীতিপর ভারভারা রাও সহ আটজন বিশিষ্ট মানুষ। কিন্তু দিল্লি দাঙ্গায় ইন্ধন সৃষ্টিকারী কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, পরভেশ বর্মাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করা দূরে থাক, জিজ্ঞাসাবাদও করেনি।
প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য দানবীয় আইনকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এই ভয়ানক ফ্যাসিবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানিয়ে সমস্ত রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে আজ ৩ জুন দেশ জুড়ে এক বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হয়েছে।