করোনার বিপদ কিন্তু বাড়ছেই
edi

তালাবন্দী দশা জুনের গোড়ায় গড়ালো পঞ্চম পর্বে, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তালা খোলাও শুরু করে দেওয়া হল। ইতিমধ্যে পুরোমাত্রায় গৃহবন্দীকাল কেটেছে চার দফায় মোট দু’মাস দশদিন। যা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে। চূড়ান্ত অপ্রস্তুত অবস্থায় এবং অপরিকল্পিতভাবে। তার দুর্বিষহ জের যে তিলে তিলে কেমন ভোগ করতে হয়েছে তা যারা ভুগেছে তারাই সবচেয়ে বুঝেছে। রাষ্ট্রের দিক থেকে ফোলানো-ফাঁপানো অর্থনৈতিক চিত্র দেখানো পরিস্থিতিতে পরন্তু এক মারণঘাতী সংক্রমণ করোনা হানার অবস্থায় রাষ্ট্রশক্তির নির্মম নিষ্ঠুর নিপীড়ক চরিত্র বর্ণনাতীতভাবে উন্মোচিত হয়ে গেছে। মানুষের সহায় সম্বল হারা অবস্থার প্রতিকার প্রদানের দাবি ক্ষমতাসীন সরকার গ্রাহ্য করেনি, উল্টে শঠতার পরিচয় দিয়েছে এই দাবি করে যে, সরকার ‘যথাসাধ্য’ করেছে। প্রধানমন্ত্রী এই জীবনযন্ত্রণাকে বিবৃত করেছেন দেশবাসীর তথাকথিত ত্যাগ স্বীকারের পরিচয় বলে, উদ্দেশ্য হল ক্ষমাহীন অপরাধসম রাষ্ট্রীয় ভূমিকার উলঙ্গ চেহারাকে আড়াল দেওয়ার অপচেষ্টা। সরকারের দিক থেকে উচিত ছিল এক জরুরি সর্বাঙ্গীণ মানবিক প্যাকেজের ব্যবস্থা গ্রহণ, যার মধ্যে থাকতে হোত একদিকে পর্যাপ্ত সুষ্ঠু সুলভ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, হাসপাতাল ও নিভৃতবাস ব্যবস্থার সম্প্রসারণ মায় সহজবোধ্য বিজ্ঞানসম্মত সামাজিক চেতনার প্রচার-প্রসার; অন্যদিকে মজুরি আদায়, পরিযায়ী শ্রমিকদের সুষ্ঠভাবে রক্ষণাবেক্ষণ অথবা তারা ঘরে ফিরতে চাইলে তাদের ফেরার ব্যবস্থা করা এবং নিঃস্ব, অভাবী বা গরিব মানুষদের হাতে তালাবন্দী থাকাকালীন পর্যায়ের জন্য নগদ অর্থপ্রদান ও খাদ্যশস্য সরবরাহের যোগান। কিন্তু রাষ্ট্রের পরিচালকরা নেয় এক পীড়াদায়ক প্যাকেজ, যা কেবল কিছু মানুষকে কিছু পরিমাণ খাদ্যশস্য, চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা ছাড়া বাকি যা অনুসরণ করেছে তার পুরোটাই অগণতান্ত্রিক অমানবিক; চালিয়েছে বঞ্চনা-প্রতারণা-দীর্ঘসূত্রিতা-দুর্নীতি-উৎপীড়ন-গ্রেপ্তারি, প্রশ্রয় দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতা-অস্পৃস্যতা-কুসংস্কারকে এবং রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কেন্দ্র করে সামাজিক দ্বন্দ্ব-বিরোধকে; রাষ্ট্র জেগে ঘুমিয়েছে মালিকশ্রেণীর দ্বারা মজুরদের আটকে রাখার জন্য মজুরি না দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা মজুরি কাটাই ও কাজ ছাঁটাই সংঘটিত হতে দেখেও। পাশাপাশি তালাবন্দীকালের সুযোগ নিয়ে, যখন আইনসভা-বিচারসভা সব বন্ধ, তখন সেরে ফেলা হল বেসরকারীকরণের বৃত্তপূরণের বাকি কৃতকর্ম সহ শ্রম আইনের শ্রমিক বিরোধী সংশোধন; প্রস্তাব রাখা হল অন্তত বছর তিনেক যাতে রাজনৈতিক আন্দোলন বন্ধের বন্দোবস্ত করা যায়। উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার আওয়াজ তুলেছে শ্রমিক পরিযায়ীকরণের পলিসির ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর। এই সবকিছুই চলছে করোনা সংকট থেকে ‘দেশোদ্ধারে’ র ও দেশকে ‘আত্মনির্ভর’ করে তোলার নামে।

lic

 

এই পটভূমিতে চালু করে দেওয়া হল তালা বন্ধ রাখা আর তালা খুলে দেওয়ার যুগল প্রক্রিয়া পর্ব। বলাবাহুল্য, কেন্দ্র-রাজ্য সহমতের ভিত্তিতে, কেন্দ্রের নির্দেশিকা মেনেই রাজ্যগুলোকে উপরোক্ত পৃথকত্বের অনুশীলনে বাধ্য থাকতে হবে। রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভাগীদার, মোড়ল-মাতব্বর- আমলা-গামলারা নিচ্ছেন তাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু নাগরিক ভারতকে মাপতে হবে ভাবতে হবে। বিশেষত তালা খোলার ব্যবস্থা শুরু করে দেওয়া হচ্ছে ঠিক ঠিক কোন পরিস্থিতিতে!

প্রতিটি দিনের সংক্রমণ ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিগত দিনের রেকর্ড। ভারত সংক্রমিত বিশ্বে দ্বাদশ স্থান থেকে এখন ওপরে উঠেছে সপ্তম স্থানে, অন্য একটি হিসাব মতে সপ্তম নয়, সক্রিয় সংক্রমণে ভারতের অবস্থা এখন পঞ্চম স্থানে -- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ব্রিটেন ও রাশিয়ার ঠিক পরেই। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২ লক্ষ। ৮০ শতাংশ আক্রান্ত দেশের কলকাতা পুরসভা সহ ৩০টি পুরসভা অন্তর্গত এলাকায়। ৯০ শতাংশ নতুন সংক্রমণ লক্ষ্যণীয় পশ্চিমবঙ্গ সহ ১০টি রাজ্যে। তার মধ্যে ৭০ শতাংশ নতুন সংক্রমণ কলকাতা মহানগরী সহ দিল্লী, মুম্বাই তথা দেশের ১০টি বড় বড় শহরে। সংক্রমণ আজকের ভারতে সংক্রমণ যেমন তিনমাস আগের চীনকে ছাপিয়ে গেছে সংখ্যার হিসাবে, তেমনি অনেকবেশি রাজ্যওয়ারি হিসাবেও। একটা মিথ্যা প্রচারেরও সংক্রমণের জোর চেষ্টা চালিয়েছিল ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক স্বার্থান্বেষী মহল। করোনা সংক্রমণ নাকি ছড়িয়েছে এক বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা! বলাবাহুল্য, দিল্লীর তবলিগি জমায়েত থেকে! আর প্রকৃত বাস্তবে কি দেখা গেল? করোনা দেশজুড়ে ছড়িয়ে গেল পরিযায়ী শ্রমিকদের শরীরী মাধ্যমে। মালিকশ্রেণী তাদের জীবন-জীবিকাকে ছিবড়ে করে দেওয়ার পর রাষ্ট্র তাদের এমন হাল করল যে অজান্তে পরিযায়ী শ্রমিকরা পরিণত হল করোনার এক বড় সংখ্যায় বাহকে। দেশজুড়ে ঘরে ফেরাফিরি চলল লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের। কেন্দ্র-রাজ্য কোনও পক্ষই এর দায়িত্ব নিতে চাইছে না। এই সমস্যা সমাজ জীবনে সৃষ্টি করছে এক অচেনা দ্বন্দ্বের, যার সমাধানের জন্য অব্যাহত রাখতে হবে রাষ্ট্রশক্তিকে বাধ্য করার চাপ, একইসাথে খুলতে হবে বহুমুখী নাগরিক উদ্যোগের দ্বার। যদিও সুস্থতার হার সরকারী মতে ৪৮ শতাংশের মতো, তবু দৈনিক যে হারে সংক্রমণ হচ্ছে তাতে জুনের শেষে সম্ভাব্য বিপদ থাকবে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ লক্ষে পৌঁছে যাওয়ার! ইতালির দেশজুড়ে সব তালা খুলে দেওয়া প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছে, ‘হু’ বলেছে কোবিডের ঘাতক ক্ষমতা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। ভারতে তালা খোলা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহল একমত নয়। বিরোধী রাজনৈতিক মহলও সব ঐকমত্যে নেই। পেছনে ফেলে আসা বিপদের দিনগুলোর পর সামনের দিনগুলো দাঁড়াবে কেমন? ঝুঁকি যে বিস্তর থাকছে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়।

খণ্ড-27