কমেও কমল না তেলের দাম
oil

তেলের দামের সঙ্গে জিনিসপত্রের দামের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে – তেলের দাম বাড়লে পরিবহণ ব্যয়ের বৃদ্ধি ঘটে, ফলে পণ্যসমূহের দামও বেড়ে চলে। আর দাম বাড়লে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সেটা একটা আন্দোলনের ইস্যুও হয় – এমনকি ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর কাছেও। তবে দাম বাড়াটা সাধারণ জনগণের কাছে যতই কষ্টের ও ক্ষোভের কারণই হোক, তোলের দাম বাড়াটা কী কেন্দ্র, কী রাজ্য – সমস্ত রাজ্য সরকারগুলোর কাছে একটা আশীর্বাদ হয়েও দেখা দেয়। তেলের বেশি দাম মানে সরকারগুলোর ভাঁড়ারে আরও বেশি রাজস্ব – সরকারগুলো তখন নিশ্চয় একটু মুচকি হাসিও হাসে। বিপরীতে, তেলের দাম কমার মধ্যে জনগণের খুশি হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে – তেলের দাম কমে পরিবহণ ব্যয় হ্রাস পেলে মূল্যস্ফীতির হ্রাসও সম্ভাব্য হতে পারে। তখন কিন্তু সরকারের কপালে ভাঁজ পডে – তার রাজস্ব কমে যাবে। সরকার তখন প্যাঁচ কষতে থাকে – আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও, বিদেশ থেকে তেল কেনার জন্য সরকারের ব্যয় হ্রাস পেলেও দেশের বাজারে পাইকারি ও খুচরো বিক্রির দাম যাতে পড়ে না যায় সেই দিকে সরকার তার নজরকে কেন্দ্রীভূত করতে থাকে। আর এই ব্যাপারে তাদের সহায়ক হয় শুল্ক ও করের হার – কেন্দ্রীয় সরকার উৎপাদন শুল্ক এবং রাজ্যগুলো বিক্রয়ের ওপর করের হারকে বাড়িয়ে চলে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুফল জনগণকে না দিয়ে রাজস্বের ঘাটতি পূরণই সরকারগুলোর অভীষ্ট হয়ে ওঠে।

pet

 

এই পরিঘটনাটাকেই আমরা বারবার পুনরাবৃত্ত হতে দেখছি মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। করোনার কারণে দেশে-দেশে লকডাউন চালু হওয়ার ফলে তেলের চাহিদা কমে যাওয়ার জন্যই হোক, আর তেল উৎপাদক দেশগুলো ও রাশিয়ার মধ্যে বনিবনা না হওয়ার ফলেই হোক, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নেমে আসে তলানিতে। এবছরের জানুয়ারী থেকে আড়াই মাসে তেলের দাম নেমে যায় অর্ধেকেরও কমে। যে ব্রেন্ট ক্রুড (সৌদি আরবের বিক্রি করা অপরিশোধিত তেল) জানুয়ারি মাসে বিক্রি হয়েছে ব্যারেল প্রতি ৭২ ডলারে, ৯ মার্চ সেই তেলের দামই কমে হয় ব্যারেল প্রতি ৩৩ ডলার। এবং এই পড়তি প্রবণতা চলতেই থাকে। মোদী সরকার কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার সুফল সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে না দিয়ে উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়ে দেশের বাজারে তেলের দামকে অপরিবর্তিত, অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার আগে যে অবস্থায় ছিল সেই স্তরেই বেঁধে রাখে। সরকার ১৪ মার্চ পেট্রল ও ডিজেলের উৎপাদন শুল্ক ৩ টাকা করে বাড়ায়। এর কিছুদিন পরই চালু হবে লাগাতার লকডাউন, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আরও পড়ে গেলে লকডাউন চালু থাকা অবস্থায় উৎপাদন শুল্ক বাড়ানোর প্রক্রিয়া যাতে প্রতিহত না হয়, সে জন্য সরকার লকডাউন শুরু হওয়ার ঠিক আগে ২৩ মার্চ অর্থ বিলে সংশোধনী এনে পেট্রল ও ডিজেলে উৎপাদন শুল্ক আরও বাড়ানোর রাস্তা করে রাখে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যথারীতি আরও কমে ৫ মে বিক্রি হয় ২৩.৮৬ ডলারে এবং সরকারও একটুও দেরি না করে সেদিন রাতেই পেট্রল ও ডিজেলে উৎপাদন শুল্ক বাড়ায় যথাক্রমে ১০ টাকাও ১৩ টাকা এবং তাদের ঘোষিত লক্ষ্য হয় তেল থেকে অতিরিক্ত ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব তোলা। দেশের বাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়াকে আটকাতে উৎপাদন শুল্কের বৃদ্ধিকে কিভাবে কাজে লাগানো হয়েছে তার একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ভারতের এক মহানগরে ২০১৪-র মে মাসে এবং ২০২০-র মার্চ মাসে পেট্রলের খুচরো বিক্রির লিটার প্রতি দাম ছিল যথাক্রমে ৭১.৪১ ও ৭১.৭১ টাকা। অর্থাৎ, উভয় ক্ষেত্রেই বিক্রির দাম প্রায় সমান, কিন্তু উৎপাদন শুল্ক ও রাজ্যের বিক্রয় কর বসার আগে তেলের মূল দামে ফারাক ছিল অনেক – যথাক্রমে ৪৭.১২ ও ৩২.৯৩ টাকা। ২০১৪-র তুলনায় ২০২০-র মূল দাম ১৪ টাকার বেশি কম থাকলেও খুচরো বিক্রির দাম যে কমেনি তার কারণ ২০২০তে উৎপাদন শুল্ক ও রাজ্যের বিক্রয় কর দুইই বেড়েছে – ২০১৪-র ২২.২৯ টাকা থেকে (১০.৩৯ + ১১.৯০) বেড়ে ২০২০-তে হয় ৩৫.২৩ টাকা(১৯.৯৮ + ১৫.২৫)। শুল্কের ভারে জনগণের ঘাড় এইভাবে ভারাক্রান্ত হয়েই চলে। গত ৫ মে উৎপাদন শুল্ক আর এক দফা বাড়ার পর পেট্রল ও ডিজেলে সেগুলোর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে যথেষ্টই বেশি, যথাক্রমে ৩২.৯৮ ও ৩১.৮৩ টাকা।

তেলের দামের বিনিয়ন্ত্রণ ঘটানোর সময় যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে – ভর্তুকি দিয়ে তেলের দামকে আর কমিয়ে রাখা হবে না, তেল কোম্পানিগুলোকে আর ক্ষতির শিকার হতে দেওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে উপভোক্তাদের তার সুবিধা দেওয়া হবে, আর দাম বাড়লে তাদের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে। কিন্তু তেল সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস হওয়ায় সরকারের নিজের কাছেই এই নীতি আর শিরোধার্য বলে মনে হচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে বলা হয়েছিল তিনি দেশের জন্য সৌভাগ্য নিয়ে এসেছেন, যদিও দাম কমার সুবিধা সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেননি। তথ্য বলছে, কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপি সরকার নয়নয় করে ১২ থেকে ১৪ বার তেলের ওপর উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়েছে। তেলের খুচরো বিক্রির দাম বাড়েনি ঠিকই, কিন্তু কমার সুযোগ থাকলেও কমানো হয়নি। সংকটের বোঝা জনগণের ঘাড়ে পাচার করতেই যে সরকার অভ্যস্ত, সে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমা জনিত সুরাহা জনগণের হাতে তুলে দেবে, এর চেয়ে দুরাশা আর কিছু হতে পারে না। যে সরকারের প্রতিটি মজ্জায় অসংবেদিতার প্রবল উপস্থিতি, সে জনগণকে দুর্ভোগই দিতে পারে।

-- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-27