এক সপ্তাহ হয়ে গেল ঝড় আমফান বা উমফুন কলকাতা সহ এরাজ্যের দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির উপর দিয়ে বয়ে গেছে। মানতেই হবে জীবিত রাজ্যবাসীর জীবনে এটি সবথেকে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্বিপাক। এর আগে কোনো ঝড়, ভূমিকম্প এমনকি বন্যাও এই পরিমাণ মানুষকে এক রাতে বিপর্যস্ত করেনি। শোনা যাচ্ছে রাজ্যের ৬০% অধিবাসীই নাকি আপফানের আক্রমণে আহত, কমবেশি। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে, ঝড়ে আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে কোটি কোটি নাগরিকের। ক্ষতির পরিমাণ লক্ষ কোটি টাকার উপর, এখনো অপরিমেয়। অবশ্যম্ভাবীভাবেই অধিবাসীদের সমস্ত ক্ষতি পূরণ করা হবে না। নুতন করে প্রায় শূন্য থেকে শুরু করবেন বহু সহনাগরিক। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে। এই ক্ষতিপূরণের দায় কার? ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির না রাষ্ট্রের? যারা মারা গেছেন তাঁদের পরিবারকে দুই ও/বা আড়াই লাখ এবং আহতদের পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওযা যৎকিঞ্চিৎ হলেও তার মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র দুর্যোগের ফলে উদ্ভুত ক্ষতি মেটানোর দায় স্বীকার করে নিয়েছে। সুতরাং, ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের যতদূর সম্ভব পূর্বাবস্থায় পুনর্বাসনের দায়ও রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। যে সমস্ত শহর বা শহর সন্নিকটবর্তী বসবাসকারী সুধীজন নিজগৃহে বিদ্যুৎ ও জলসরবরাহের দীর্ঘকালিন বিঘ্ন ঘটার দরুণ প্রভূত বিচলন দুর্ভোগ ও যাতনার শিকার হয়ে রাস্তা অবরোধ করছেন ও রাজ্য সরকার, পুর কর্তৃপক্ষ এবং বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থাকে দায়ী সাব্যস্ত করছেন, এবং যথার্থ কাজই করছেন, নিজগৃহে প্রায় স্বাভাবিক অবস্থা ফেরার পরে তাঁদের পুনরায় রাস্তায় নামা উচিৎ ওইসব ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত অঞ্চলের নিরাশ্রয়, ফসল ধ্বংসের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত, বিদ্যুৎহীন নাগরিকদের সুষ্ঠু যতদূর সম্ভব পূর্বাবস্থায় পুনর্বাসনের দাবিতে। হয়তো কেউ বলবেন এটি রাজ্য সরকারের দায়িত্ব, তাঁদের মনে করিয়ে দিতে হবে, প্রতিনিয়ত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আমাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হয়, দেশপ্রেম তথা রাষ্ট্রপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হয়, বহুক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহ তথা দেশদ্রোহের দায়ে জেলে যেতে হয়, আর যে ঝড়ের উৎপত্তি ও গতি রাজ্য নিরপেক্ষ তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের পুনর্বাসনের দায় যদি দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের না হয় তাহলে তেমন দেশ থাকার দরকার কী?
ঝড় বিদায় নেওযার এক সপ্তাহ পরেও কলকাতা শহরের বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ইন্টারনেট ও পানীয় জল পরিষেবা স্বাভাবিক হয়নি। প্রথম ৪ দিন তো পুরো শহর জুড়েই হাহাকার চলেছে। সকলেই দায় এড়িয়েছেন কিংবা দায় চাপিয়েছেন একে অন্যের ঘাড়ে। প্রায় সাতদিন আগে থেকে আবহাোযা দফতরের তরফে ঝড়ের পূর্বাভাস ও তদনুযায়ী ঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা সত্বেও কেন যথাবিহিত প্রস্তুতি ছিল না? অবশ্যই শাসক দল, সরকার, পুরসভা ও বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থাকে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যতে না ঘটে তার জন্য বন্দোবস্ত করতে হবে। কিন্তু ঘটনাটি ঘটল কেন, এমন কোনো যথাযথ প্রস্তুতি কি নেওয়া সম্ভব যার দ্বারা ঝড়ে বিদ্যুত বিপর্যয় হবে না বা হলেও অব্যবহিত পরেই পরিবহণ, জলসরবরাহ, টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট প্রভৃতি অনায়াসে সুব্যস্থিত হবে? মনে রাখা দরকার দেশ জুড়ে সমস্ত পরিষেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা সমেত, বানিজ্যিকীকরণ ও বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। যেটুকু বাকি আছে তাও বর্তমান পর্যায়ের ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের ঘোষণা অনুযায়ী তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। বহু মানুষই সরকারী ক্ষেত্রের অদক্ষতা ও বেসরকারী ক্ষেত্রের কর্মদক্ষতা নিয়ে সরব থাকেন। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে বেসরকারী বানিজ্যিক মুনাফার লক্ষ্যে চালিত পরিষেবাগুলি কর্মদক্ষতা দেখাতে অযোগ্য হিসেবেই সাব্যস্ত হয়। কারণ বেসরকারী সংস্থাগুলি মুনাফা সর্বাধিক করতে চায়। ফলে বাধ্য না হলে তারা অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতা রাখতে চায় না। কিন্তু জরুরি পরিষেবাকে বিপর্যয়ের সময়ে বজায় রাখতে গেলে অতিরিক্ত ক্ষমতা বজায় রাখতেই হবে। কলকাতা, হাওড়া ও হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে, যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে তাকে সিইএসসি। মুখ্যমন্ত্রী ও তার সরকার সিইএসসির গাড়ে দায় চাপিয়ে পাপস্খালন করল। ওদিকে দুর্যোগ আক্রান্ত উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায়, যেখানে বিদ্যুত সরবরাহের দায় রাজ্যসরকারের অধীন কর্পোরেট সংস্থা এসইডিসিএল-এর উপরে ন্যস্ত সেইসব স্থানের বহু গ্রাম শহরে যে আগামী কতদিন বিদ্যুৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে সে ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করল না। মনে রাখা দরকার এসইডিসিএল-ও কিন্তু বাণিজ্যিক সংস্থা ও মুনাফাই তার সাফল্যের মাপকাঠি। ব্যাপক বিস্তৃত এই অঞ্চলগুলিতে সুপার সাইক্লোন এলে বিদ্যুৎ সরবরাহকে ঝড় পরবর্তীতে ব্যবস্থিত করতে যে পরিমাণ সাজ সরঞ্জাম ও শ্রমিক বহাল রাখা দরকার তা কখনোই রাখা হয় না কারণ সেক্ষেত্রে মুনাফা কমে যাবে। নিত্য নৈমিত্তিক যে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয় তাকে কিছু সমযের মধ্যে, শহরাঞ্চলে কয়েক ঘণ্টা ও গ্রামাঞ্চলে দু-একদিনের মধ্যে, মেরামত করার জন্যই বন্দোবস্ত থাকে। বিদ্যুৎ যোগাযোগের মেরামত যথেষ্ট ঝুঁকি সম্পন্ন ও অভিজ্ঞ শ্রমিকের প্রয়োজন। ফলে সাত দিনের প্রস্তুতিতে নিয়োগ করা সম্ভব নয়। এছাড়া, এখন চুক্তির ভিত্তিতে কাজের যুগ। সিইএসসি নিজেদের শ্রমিকের বদলে কন্ট্রাক্টরকে দিয়ে কাজ করায়, সস্তায় হয় বলে। লকডাউনে কাজ না থাকায় শ্রমিকদের মজুরি জোটেনি কন্ট্রাক্টরের কাছে। তাঁরা বাড়ি ফিরে গেছেন। ফলে একেই কমজোরি মেরামত ব্যবস্থা আরো দুর্বল হয়েছে। একটি অতি জরুরি পরিষেবাকে কেবল মুনাফার দৃষ্টিতে দেখলে যে অনাছিস্টি হতে পারে তা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে।
কলকাতা পুরসভাও সারা শহরে গাছ কাটার জন্য মাত্র ২২টি বৈদ্যুতিক করাত কিনে রেখেছে। স্বাভাবিক সময়ে হয়তো তাই যথেষ্ট। কিন্তু আমফান পরবর্তী পরিস্থিতিতে যেখানে সাড়ে পাঁচ হাজার গাছ উপড়ে পড়েছে তখন ২২টি করাত দিয়ে দ্রুত গাছ কাটা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রেই ওই ব্যয় সঙ্কোচনের তত্ত্ব কাজ করেছে। হয়তো বা অতিরিক্ত করাত বরাত দিয়ে কিছু পাওয়া যেতে পারত কিন্তু সেটা চালানোর প্রশিক্ষিত কর্মীতো পাওযা যেত না। ফলে, সেই এক অর্থনৈতিক মুনাফা সর্বাধিকীকরণের প্রশ্ন, যদিও পুরসভা বাণিজ্যিক সংস্থা নয়, কিন্তু দেশের সমস্ত পরিষেবাকে যদি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা হতে থাকে, পুরপরিষেবাও সেই দৃষ্টিভঙ্গীতেই পরিচালিত হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ১৯৯১ সালের নয়া অর্থনৈতিক নীতির পর থেকে পুর পরিষেবার বিষয়সমূহকে, যেমন জল, বাণিজ্যকীকরণ করার কথা বলা হয়েছে। এই ধরনের পরিষেবা যত বেশি বানিজ্যকীকরণ হবে ততই, সেখানে বিপর্যয়ের সময়ে কর্মী ও যন্ত্রের অপ্রতুলতা ঘটবে। ফলে বিপর্যয় পরবর্তী কষ্ট বাড়বে।
বিদ্যুৎ পরিষেবার ক্ষেত্রে যদি সমস্ত ব্যবস্থাটি মাটির তলার তার দিয়ে যেত তাহলে ঝড়ের দাপটে পরিষেবার বিঘ্ন কম হত। এমনটা ভাবাই যায়। কিন্তু তা আমাদের আলোচনার মূল ভিত্তিটাকে ব্যর্থ করে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয় কেবল ঝড় নয়, তা ভূমিকম্প, বন্যাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে যে বিপর্যয় ঘটবে তাকে সামাল দিতেও প্রভূত বন্দোবস্ত রাখতে হবে যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অব্যবহৃত থাকবে ও যার জন্য কৃত ব্যয়কে অনাবশ্যক বলে মনে হবে। সেই তথাকথিত অনাবশ্যক ব্যয় কখনোই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিচালিত সংস্থা করবে না।
এটা অবশ্যই সত্য যে, তৃণমূল কংগ্রেস শাসক দল হিসেবে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এই পরিস্থিতির মোকাবিলায়। সেটাই স্বাভাবিক। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল ও তাঁদের নেতা-কর্মীরা সমস্ত দুর্বিপাকের মধ্যে মুনাফার খোঁজ করে। যেমন নরেন্দ্র মোদি- সীতারামণরা কোরোনার দুর্বিপাকে আবিশ্ব জর্জরিত থাকার সময়ে কীভাবে বেসরকারী ক্ষেত্রের কাছে ভারতে অর্থনীতিকে আরো উন্মুক্ত করা যায় তার রাস্তা তৈরি করল, অমিত শাহ গণআন্দোলনের কর্মীদের গ্রেফতারের চক্রান্ত করল, তেমনি তৃণমূলের নেতা কর্মীরা প্রচুর গাছ রাস্তায় উপড়ে পড়াতে সেই গাছ বিক্রির টাকা থেকে কমিশনের স্বপ্ন দেখল। লকডাউনের সময়ে বামপন্থীরা যখন ত্রাণ নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে, তৃণমূলীরা তখন কলকাতা কর্পোরেশনের ১০৫নং ওয়ার্ডে সিপিআইএমএলের স্থানীয় সম্পাদকের উপরে হামলা করছে। একইভাবে ঝড়ের দুর্গতিতে, বামপন্থীরা যেখানে সামান্য হলেও শক্তি ধরেন, সেইসব স্থানে গাচ বা রাস্তা পরিস্কারে হাত লাগান, কিন্তু তৃণমূলীরা ক্ষমতায় থাকা সত্বেও কায়িক শ্রম থেকে বিরত থেকে বিদ্যুৎ কর্মীদের উপরে হামলা করেন, কলকাতা কর্পোরেশনের ৯২নং ওয়ার্ডের বামপন্থী মহিলা কাউন্সিলরের উপরে চড়াও হয়।
তৃণমূল সরকারের এই সার্বিক দুর্নীতি ও অদক্ষতা অবশ্যই পরিস্থিতিকে জটিল করেছে, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়োত্তর পরিস্থিতিকে সামাল দেওযার উপযুক্ত পরিকাঠামোগত বন্দোবস্ত না থাকার কারণ অনেক গভীরে, অর্থনীতির সার্বিক বাণিজ্যিকীকরণের মধ্যে নিহিত আছে।
--- অমিত দাশগুপ্ত