আচমকা বেড়ে যাবে দূষণমাত্রা
env

ওরা প্রাণপণ যুঝে ছিল সন্ধ্যে থেকে মধ্যরাত। ভয়াবহ গর্জনের মধ্যে রোগা শরীরগুলো লুটোপুটি খাচ্ছিল। নিষ্প্রদীপ রাতের নিকষ আঁধারে ওরা একা একা যুঝে যাচ্ছিল। রাতশেষে স্তব্ধ তছনছ ভোরের আলো সাক্ষী রইল সেই দৃশ্যের – পরাহত বিধ্বস্ত অনেকেই গোড়া উপড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে নোংরা জলে, কাদা মাখামাখি হয়ে। তীব্র অপরাধ বোধে ভোগা দুটো দিন পার করে অবশেষে সেই নিষ্ঠুর অনিবার্যতাকে মেনে নিতে হল। কুড়ুলের এলোপাথাড়ি কোপে আধ ঘণ্টায়, তখনও সজীব সেই প্রাণ, কয়েক টুকরো কাঠের গুঁড়িতে পরিণত হয়ে গেল। নেমে এসেছে কেমন একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা। পাখিদের দিনভর জলসা নেই। কাঠবেড়ালিদের অনন্ত ছুটোছুটি আর কিচির মিচির নেই। বেজীপরিবারকেও দেখা যাচ্ছে না। শুধু কাকেদের কর্কশ ডাকের বাস্তবতা যেন শূন্যতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ তো গেল শহরতলির গেরস্থের আঙিনার কথা।

সুপার সাইক্লোন আমফান গোটা দক্ষিণ বঙ্গকেই তছনছ করে দিয়ে গেছে। অসংখ্য নদী বাঁধ ভেঙে গেছে।ক্ষেতের ফসল জলের তলায়। বিঘের পর বিঘে সবজি চাষ নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েক লক্ষ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন ত্রাণ শিবিরে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে হাজার হাজার ঘর বাড়ি। সরকারি হিসেবেই এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৮৬ জন। বালক বালিকাও আছে তাদের মধ্যে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সবুজের। ঝড়বিধ্বস্ত জেলাগুলোতে অসংখ্য গাছ পড়ে গেছে।

gard

 

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বিপন্ন, দিঘার ঝাউবীথির সৌন্দর্যও কেড়ে নিয়েছে আমফান। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেনের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে।সেখানে ৪.৬৭ একর জুড়ে থাকা, ২৭০ বছরের পুরোনো পৃথিবীর বৃহত্তম বটগাছটিও ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপড়ে গেছে অন্যান্য দুর্লভ বহু গাছ। যশোর রোডের যেসব শতাব্দী-প্রাচীন গাছ বাঁচানোর জন্যে পরিবেশ কর্মীরা দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, এমনকি আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছেন, রেহাই পায়নি তারাও ঝড়ের তাণ্ডব থেকে।

কলকাতার ২%-এরও কম অঞ্চল সবুজ আবৃত। সেই বৃহত্তর কলকাতায় সিএমসি’র হিসেব অনুযায়ী ৫০০০ (পরিবেশবিদদের মতে ১০০০০)-এরও বেশি গাছ উপড়ে গেছে। মহানগরের গলি থেকে রাজপথে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার ছিন্নমূল গাছ। এইসব গাছের অনেকগুলিই প্রাচীন-পঞ্চাশেরও বেশি বয়েস তাদের। আর এরা রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়ার মতো নরম গাছও নয়। পথের দু'ধারের তরুবীথির প্রায় এক তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর নেচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট জানিয়েছে, একটি পঞ্চাশ বছরের পুরোনো বটগাছ বছরে পরিবেশে যে অবদান রাখে তার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডের মত বিষাক্ত গ্যাস থেকে বাতাসকে মুক্ত করা, অক্সিজেনের যোগান দেওয়া, পশু পাখিদের আশ্রয় দিয়ে জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করা, ভূমিক্ষয় রোধ করা -- এসব কিছুই সেই অবদানের মধ্যে পড়ে। পরিবেশবিদরা বলছেন, একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছের ক্ষতিপূরণ করতে অন্তত দশটি গাছ বসাতে হবে।কলকাতার হারানো সবুজ ফিরে পেতে তবুও দশ থেকে পনেরো বছর লেগে যারে।

bir

 

কাল হোক, পরশু হোক--লকডাউন উঠবে। মহানগরের রাস্তায় ছুটবে প্রায় আট লাখ গাড়ি। কিন্তু দূষণরোধী বন্ধুরা আর তখন থাকবে না সবুজ ছায়া বিস্তার করে। তাই আচমকাই অনিবার্য ভাবে বেড়ে যাবে বাতাসের দূষণমাত্রা। এই অশনি সংকেত কি আমাদের হুঁশ ফেরাবে?

-- জয়ন্তী দাশগুপ্ত 

খণ্ড-27