কথায় বলে, যা ঘটবার, সেটা ঘটবেই। এই মুহূর্তে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলা মহামারী, সেই আপ্ত বাক্যটিকে বার বার মনে করাচ্ছে। বেড়েই চলেছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রুগীর সংখ্যা। মৃত্যু ইতোমধ্যে দুই লাখ আটান্ন হাজার অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে। সকলের পাখির চোখ, বৃদ্ধির এই “সংখ্যার” উপর। মূলত আমেরিকা, ইতালি, ইংল্যান্ড ও স্পেন হয়ে ভারতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাবে। মিডিয়ার ফোকাসও ঐ দিকে। স্বাভাবিক। কারণ বিশ্বের ধনীতম দেশগুলিতে দ্রুত হারে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের “নেই রাজ্যের” দেশের রথী-মহারথীদের হৃদ কম্পন না ঘটিয়ে পারে? যাঁদের ধ্যান জ্ঞান স্বপ্ন সবই ইউরোপ, আমেরিকাকে ঘিরে আবর্তিত হয়, তাঁরা তো বিচলিত, শঙ্কিত হবেনই। ধনতন্ত্রের স্বর্গ মার্কিন সাম্রাজ্যে মৃত্যুর তীক্ষ্ম ঊর্ধ্বমুখী প্রবনতায় বিশ্ব হতবাক। লকডাউনের ফলে কোটি কোটি মানুষের মর্মন্তুদ জীবন যন্ত্রনায় স্বপ্নাহত সেই মানুষগুলি কিন্তু নির্বাক। ভয়ার্ত পরিসংখ্যানের ঘূর্ণিপাকে আমাদের ভাবার সময় নেই, চীন, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশ, এমনকি ছোট্ট রাজ্য কেরল কি ভাবে রুখে দিল কোবিড-১৯ এর গতি। তাদের থেকে শিক্ষা নিলে “করোনা ভীতি” যে প্রশমিত হয়ে যায়। আসুন, করোনার গতি-প্রকৃতি, আতঙ্ক ও তার প্রতিরোধে কিছু দেশের ব্যর্থতা আর কিছু দেশের সাফল্যকে বুঝে নেই বিজ্ঞানের আলোকে।
জীব ও তার পরিবর্তনশীলতার পথ ধরেই করোনা ভাইরাসের (কোভ) আগমন, প্রবাহ ও আক্রমণ। কোভের সাথে এক ধরনের বাদুড়ের সম্পর্ক প্রায় ৫৫ কোটি বছর (কো-ইভোল্যুশন) ধরে। যেমন, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সাথে মেক্সিকো অঞ্চলের শুকরের সম্পর্ক। নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলের, সুনির্দিষ্ট প্রাণীই ভাইরাসের পোষক। প্রাণহীন, চলচ্ছক্তিহীন, এই পারমাণবিক পদার্থটিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় কোনো প্রাণীকোষে প্রবেশ করলে। একাধিক ভিন্ন জাতের প্রাণী এদের পোষক হতে পারে। ভাইরাস সংক্রমণে ভাইরাসের একটি গোষ্ঠীকে বিবেচনা করা হয়।
ভাইরাস প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি। প্রাণ প্রতিষ্ঠার পর সে নিজেই স্বয়ম্ভূ। নিজেই নিজের স্রষ্টা হয়ে ওঠে। তৈরি করে একের পর এক আপন প্রতিলিপি (রেপ্লিকেশন)। কিছু ভাইরাস (আরএনএ ভাইরাস) রেপ্লিকেশনকালে নিজেদের গঠনে (জিন) পরিবর্তন(ড্রিফট) ঘটায়। এইভাবে ভাইরাসটি কোন প্রাণীর মধ্যে তার একাধিক ভিন্ন ধরণের প্রতিলিপি (স্ট্রেন) তৈরি করে। এই অনুলিপিগুলির সম্মিলিত রূপই গোষ্ঠী। এক বা একাধিক ভিন্ন অনুলিপি বহু মানুষকে একই সময় সংক্রমিত করতে পারে (এপিডেমিক)।
আবার ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর (ধরি ভাম) মধ্যে ঐ ভাইরাসের কোন অনুলিপির সাথে এক (ধরি বাদুড়) বা একাধিক (ধরি মানুষ) পোষক প্রাণী থেকে আসা সেই ভাইরাসের ভিন্ন স্ট্রেনের সংযুক্তিতে ভাইরাসটির গঠনের (জিনের) আমূল পরিবর্তন (শিফট) ঘটতে পারে। তৈরি হয় শক্তিশালী নূতন উপপ্রজাতির ভাইরাস। অনেকটা পৌরাণিক গল্পে বর্ণিত দুর্গার সৃষ্টির মত। একাধিক অনুলিপির টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে এই নূতন ধরণের (মহা) ভাইরাসটির উৎপত্তি।এরাই বিশ্বজুড়ে মহামারী (প্যানডেমিক) ঘটায়।
পোষক প্রাণীর নামেও ভাইরাসকে চেনা যেতে পারে। যেমন শুকর, ইঁদুর, বাদুড়, পাখি বা মানুষের ভাইরাস।পরিবেশের পরিবর্তন, বন নিধন, নগরায়ণ মানুষকে নানা ধরণের বুনো প্রাণী ও তাদের দেহে থাকা ভাইরাসের সংস্পর্শে নিয়ে এসেছে। এই পথেই কোভের সাথে মানুষের নিবিড়তা।
কোভের প্রথম আক্রমণ দক্ষিণ চীনে ২০০২ সালে (সার্স কোভ-১)। বাদুড়>ভাম>মানুষ>মানুষ হয়ে চীন থেকে আরও ২৬টি দেশে। দ্বিতীয় হানা ২০১২-তে। আরব সাম্রাজ্যে “মার্স কোভ” নামে। এখানে মধ্যবর্তী প্রাণী ভামের বদলে উট। উটের দুধ থেকে মানুষে। বিজ্ঞানীরা প্রমাদ গুনলেন। ২০১৫-তে গবেষকরা আশঙ্কা করলেন কোভের ভয়ঙ্কর ভাবে ফেরার সম্ভাবনা (সূত্র : নেচার মেডিসিন, নভেম্বর, ২০১৫)। আশঙ্কা সত্যি হলো ২০১৯-এ, কোভ-১৯-এর হাজিরায়, চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে। বাদুড়>প্যাঙ্গোলীন>মানুষ>থেকে মানুষে। উহান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামজাদা বানিজ্যিক শহরে। এই সকল শহর থেকে শহরে প্রতিদিন কয়েক লক্ষ নাগরিকের আসা যাওয়া, কোভ প্রবাহের গতি সূত্র।
করোনা কোনো নূতন ভাইরাস নয়। সাধারণ সর্দি-কাশির শতকরা ত্রিশ ভাগ করোনা ভাইরাসের জন্য ঘটে। সুদীর্ঘ সময় ধরে (কয়েক শত বছর) মানব দেহ এদের চেনে। ফলে মানুষের শরীর এদের প্রতিরোধ করতে পারে। কোভিড-১৯ সম্পূর্ণ নবাগত। এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ার সময় মানব দেহ পায়নি। বিজ্ঞানীরাও সময় পাননি প্রতিষেধক তৈরি করার। তাই বিনা বাধায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
কোভ-১৯ প্রথম ছড়ায় উহান ও তার সংলগ্ন শহরে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রায় এক মাস ধরে ভাইরাসটির গতি প্রকৃতি, বিস্তার পদ্ধতি, সংক্রমন ও মারণ ক্ষমতার ভাষ্য চলেছে দুনিয়া জুড়ে। এইভাবে ভাইরাসটির বিপদ ও তাকে প্রতিরোধ করার প্রাথমিক ধারণা চীন থেকে বিশ্ববাসী জেনে যায়। ১১ মার্চ, ২০২০ হু (ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন) করোনাকে প্যান্ডেমিক ঘোষণা করে। কিন্তু ভোগ বাণিজ্যে মত্ত দুনিয়া ভাইরাসটির বীভৎসতা জানার পরও নির্লিপ্ত রইলো। কিছুদিনের মধ্যেই ধনতন্ত্রের স্বর্গ রাজ্যগুলিতে কোভে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাব লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগলো।
প্রশ্ন হলো কেন এই নির্লিপ্ততা। জেনে বুঝে কেন মৃত্যুপুরীর বিলাসিতা? আসলে বাজার অর্থনীতির মাধ্যাকর্ষণে আবর্তিত দেশগুলির পক্ষে বিশাল মাত্রার ক্রেতার উপস্থিতিকে কয়েকটা মৃত্যুর জন্য (প্রাথমিক পর্যায়ে) উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। যে বাজারের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পর্যটন শিল্প। যে শিল্পের বাজারে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করেন প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ক্রেতা।
মূলত আমেরিকা, চীন, ইংল্যান্ড, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও ভারত এই তিনটি বাজারের কম বেশি দাবিদার। কয়েকটা তথ্য দিয়ে সংক্ষেপে আমরা বিষয়টাকে বোঝার চেষ্টা করব। প্রসঙ্গত, বাণিজ্যের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিকে এই আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে।
** আমেরিকা : ২০০৭-এ ৭.৫ লাখ, ২০০৮-এ প্রায় ১০ লাখ, ২০১৭-তে ১.৪ মিলিয়ন আমেরিকান বিদেশে যান (আউট বাউন্ড) চিকিৎসার জন্য। ২০১৭-তে ৫.৫ লক্ষ বিদেশি আমেরিকা আসেন (ইন বাউন্ড) চিকিৎসা করাতে। ঐ বছর আউট বাউন্ড খরচ বাদ দিয়ে মোট উদ্বৃত্ত ছিল ৪০৪.০ মিলিয়ন থেকে ০১ বিলিয়ন ডলার। প্রসঙ্গত, এদেশের বিভিন্ন কর্মী বিনিয়োগ সংস্থার কর্তাদের লক্ষ্য কর্মীদের জন্য আউট সোর্সড চিকিৎসার দিকে। স্পেকুলেশান ও লক্ষ্য এই আয়কে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ১৬০.৮ বিলিয়ান ডলারে পৌঁছানো। ২০১৭-তে স্বাস্থ্যের বিশ্ববাজারে মোট মেডিক্যাল টুরিস্ট সংখ্যা ছিল ১৪ থেকে ১৬ মিলিয়ান। (সূত্র : The American j. of medicine, January 01, 2019)
** স্বাস্থ্য বাজারে ভারত : ক্রম প্রসারমান অভ্যন্তরীণ বাজারের ২০২০-তে ভারতের লক্ষ্যমাত্রা ৩.৯ বিলিয়ন ডলার।গত তিন বছরের থেকে ২৭.০ পার্সেন্ট বেশি। ২০১৭-তে ভারতে বিদেশি রুগীর (ইন বাউন্ড) সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখ। এছাড়া আছে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ। এপ্রিল ২০০০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৬ অব্দি যার পরিমাণ হাসপাতাল ও ডায়াগনষ্টিক কেন্দ্রে ৪.১ বিলিয়ন এবং ডাক্তারি যন্ত্রপাতি তৈরিতে ১.৪ বিলিয়ন ডলার।
**চীনের অবস্থান : ২০১৮ : আউট বাউন্ড রুগী : ১৬০ মিলিয়ন। ইন বাউন্ড রুগী : ১০ লাখের বেশি।
স্বাস্থ্যের পর শিক্ষা সবচেয়ে বেশি বিক্রয় যোগ্য পণ্য। তাই বাজারও বেশ তেজি। ২০১৯-এ বিশ্ব বাজারে উচ্চ শিক্ষার মোট মূল্য ছিল ৬৫.৪০ বিলিয়ন ডলার। এই বাজারের পঞ্চাশ ভাগ আমেরিকার দখলে। বিগত তিন বছর ধরে প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে ঐ দেশে পড়তে গেছেন ১০ লক্ষের বেশি ছাত্রছাত্রী। ২০১৭-তে মার্কিন জাতীয় আয়ে শিক্ষা বিক্রি থেকে আয় ছিল ৪২.৪ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে চিন ও ভারত থেকেই সবচেয়ে বেশি ছাত্র শিক্ষা কিনতে যান। ২০১৬-তে ভারতের যোগান ছিল তিন লাখের বেশি।
বিশ্ব বাণিজ্যের মোট আয়ের শতকরা ৩০ ভাগ আসে পর্যটন শিল্প থেকে (২০১১)। ২০১২-তে আন্তর্জাতিক পর্যটক সংখ্যা ছিল ১.০৩৫ বিলিয়ন। ২০১৮-তে পর্যটন বানিজ্য থেকে ভারতের আয় ছিল জিডিপির শতকরা ৯.২ ভাগ। ২০১৯-এ প্রায় ৭০ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক যাত্রী ভারতে অবতরণ করেন। পর্যটন শিল্পে ফ্রান্স, স্পেন, ইউএস, চীন, ইতালি, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশগুলি সামনের সারিতে।
এই তিনটি বাজারে মানুষের বিপুল স্রোত যেমন করোনা ভাইরাসের আন্তর্জাতিক বাহক, অন্যদিকে বাজারের ভর কেন্দ্র অর্থাৎ বানিজ্য শহরগুলি ভাইরাসের গতিমুখ। আবার বাজার থেকে মুনাফার স্রোতকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে আত্মস্থ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এক লহমায় একে রুখে দেওয়া কার সাধ্য? তাই আমরা বলতেই পারি, কোভিড-১৯ বাজার অর্থনীতির গর্ভজাত জারজ। অবাঞ্ছিত হলেও অনিবার্য।
(ক) ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যান্ডেমিক : আমরা কোন নূতন ঘটনাকে বিচার করি পুরোনো অভিজ্ঞতার নিরিখে। ভাইরাস জনিত মারী বা মহামারীর ধারণা ১৯১৮-১৯-এ ইনফ্লুয়েঞ্জা ঘটিত প্যান্ডামিক থেকেই। ডাকনাম “স্প্যানিশ ফ্লু”। এই অতিমারীতে সারা বিশ্বে মারা যান ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন মানুষ। ভারতে ১৮ মিলিয়ন। সমুদ্রপথে গুজরাট হয়ে ভারতে এই ফ্লু প্রবেশ করে। এরপর ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের ইনফ্লুয়েঞ্জা স্ট্রেন বিশ্ব মহামারী ঘটায়। ১৯৫৭-৫৮ এশিয়ান ফ্লু-র উৎপত্তি চীনে। মৃত্যু হয় গোটা বিশ্বে ১.১ মিলিয়ন মানুষের। আমেরিকায় ৭০ হাজার থেকে ১.১৬ লক্ষ। ১৯৬৮- ৬৯ হংকং ফ্লু। সারা বিশ্বে মৃত্যু হয় ১০ লক্ষের বেশি মানুষের। আমেরিকায় এক লক্ষ। ২০০৯-১০-এ সোয়াইন ফ্লু। ভয়ঙ্করতম এবং প্রথম আক্রান্ত দেশ ছিল আমেরিকা ২০০৯, এপ্রিলে। এক বছরে সেখানে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১২,৪৬৯। গোটা বিশ্বে ২,৮৪,০০০।
(খ) সিজনাল ফ্লু : প্যান্ডেমিকের মধ্যবর্তী বছরগুলিতে ইন্ফ্লুয়েঞ্জাকে “সিজনাল ফ্লু” বলা হয়। সতত বিবর্তনীয় ভাইরাসটির বিভিন্ন ভাইরাল স্ট্রেন-এর ফলে উন্নত বিশ্বে প্রতি বছর “সিজনাল ফ্লু”-তে মৃত্যুর সংখ্যা ভয়াবহ। যদিও এর ভ্যাকসিন আছে। মানুষের দেহে এই ভাইরাসটির বিরুদ্ধে নিজস্ব ইমিউনিটিও আছে। তবুও ২০১৭-১৮-তে এই ফ্লুতে গোটা বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল তিন থেকে ছয় লাখ। ২০১৯-এ প্রায় দুই লাখ। উন্নত দেশ গুলোর তথ্য কি?
আমেরিকা :
২০১৭-১৮ : আক্রান্ত ৪৫ মিলিয়ন ---- মৃত ৮০ হাজার
২০১৮-১৯ : আক্রান্ ৩৫ মিলিয়ন --- মৃত ৩৪ হাজার
প্রতি বছর শীতকালে গড়ে ১২ থেকে ৫৬ হাজার।
ইউরোপ ইউনিয়ন : মৃত – বছরে ৪০ হাজার।
ইতালিতে এই সংখ্যা সর্বাধিক।
২০১৪-১৫ : মৃত – ২০ হাজারের বেশি।
২০১৬-১৭ : মৃত – ২৫ হাজার।
পক্ষান্তরে, সাধারণ ফ্লুতে ভারতে মারা যান ২০১৭-তে ২২৬৬ জন। সিংহভাগ গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সাধারণ ফ্লুতে এত মৃত্যুতেও সারা বিশ্ব চুপ কেন। বিষয়টা যেন মিডিয়ার গোচরেই নেই। কিন্তু ফ্লু ও কোভিড-১৯ দুজনেরই সংক্রমন পদ্ধতি, প্রবাহ একই রকম। দুজনেরই মারণ ক্ষমতা নজরকাড়া। কোথাও এ বেশি, তো কোথাও ও বেশি। সহজাত ইমিউনিটি, ভ্যাকসিন থাকা সত্বেও এত বছর ধরে ফ্লুতে এত মানুষ মারা গেলেন, তবু আমরা শুনিনি “সোশাল ডিসটেন্স”, “আইসোলেসন”, “কোয়ারিন্টিন” শব্দগুলি। যেগুলি “সিজনাল ফ্লু”র ক্ষেত্রেও সত্য। এই নিস্তব্ধতার নিখুঁত উত্তর হয়তো সময় বলবে। তবে বিস্রস্ত সমাজ আমতা আমতা করে বলতে পারে, “ফ্লু সয়ে গেছে। ওটাই স্বাভাবিক”। তবে সম্ভাব্য সঠিক যে উত্তর প্রথমেই আসে, ওসব করে পুঁজির গতিকে থামানোর চিন্তা? অসম্ভব। ধনতন্ত্র প্রেমীদের কাছে এই ভাবনা দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
মুনাফার স্রোত পুঁজিবাদের একমাত্র লক্ষ্য। সামাজিক নিষ্ঠুরতা যে তার চালিকা শক্তি। তবে সার্স-২ কোভিডের ক্ষেত্রে এরা সক্রিয় হলেন কেন? গেল গেল রব কেন? এটাও ঠিক। তবে অনেক দেরিতে। মাসাধিক কাল পর। ৩০ জানুয়ারী “হু” থেকে কোভিডকে “গ্লোবাল হেলথ ইমার্জেন্সি” ঘোষণা করা হয়। অনেক গড়িমসি ও টালবাহনার পর, পুঁজির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে পুঁজির প্রতিভুদের সরে আসতেই হলো। দ্রুতহারে উন্নত বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে নিজের মানুষরাও (শ্রেণী) যে বিপন্ন হতে পারে! ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নিজেই আক্রান্ত হলেন। ট্রাম্প সাহেব নিজেরই পরীক্ষা করতে ছুটলেন। তাঁরা শুনতে বাধ্য হলেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত, ‘করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা মানুষের শরীরে নেই। ভ্যাকসিনও নেই। সংক্রমণের হার ও মারণ ক্ষমতা “সিজনাল ফ্লু” থেকে এই ভাইরাসের বেশি। আপাত দৃষ্টিতে সেরকম ধারনাই যে তৈরি হয়।’
**আমেরিকা : ট্রাম্প প্রশাসন বুঝলেন এই অজানা ভাইরাসকে মোকাবিলা করতে, পাবলিক হেলথ এজেন্সির সাহায্য নিতেই হবে। আসলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমেরিকায় “ঠুঁটো জগন্নাথ”। প্রাইভেট স্বাস্থ্য ব্যবসার স্বর্গরাজ্য আমেরিকায় প্রতি বছর স্বাস্থ্যবীমার অভাবে মারা যান প্রায় ষাট হাজার আমেরিকান। মুনাফার কি কোন সামাজিক বা মানবিক মুখ থাকতে পারে? সরকারী দপ্তর সক্রিয় হতেই চিহ্নিত হতে লাগল একের পর এক করোনা আক্রান্ত রুগী। ইউরোপ, আমেরিকা জুড়ে মৃত্যুর মিছিলে সন্ত্রস্ত শাসকশ্রেণী অস্বাভাবিকভাবে স্ববিরোধিতায় টেনে ধরলেন বাজারের লাগাম!
**ইংল্যান্ড : চলুন ধনতন্ত্রের আরেক স্বর্গ রাজ্যে। এখানে সকলের চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের। তবু দেশটা কিন্তু ধনবাদের স্বার্থে। ফল, মৃত্যু : ২১ হাজার। প্রথম আক্রান্ত ধরা পরে ৩১ জানুয়ারী। ২৩ মার্চ পর্যন্ত সরকার নির্বিকার। কোনো বিধিনিষেধ নেই। বরং দেখা যাচ্ছে ১১ মার্চ হু’র প্যাণ্ডেমিক ঘোষণার দিন, চাম্পিওন লীগের খেলায় পঞ্চাশ হাজারের জমায়েত। ১২ মার্চ কোন এক শহরে ঘোড় দৌড়ে দুই লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত। ফাটকা পুঁজির এটাই তো চরিত্র। ২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বরিস বলেই ফেললেন, “করোনাকে আটকাতে যাঁরা বাণিজ্য আটকাতে চাইছেন, তাঁদের রুখে দিয়েই আমরা ‘মুক্ত বাণিজ্যের’ সুপার হিরো হবো”। বিজ্ঞান মন্ত্রকের এক বরিষ্ঠ উপদেষ্টা সাধারণ নাগরিকদের গিনিপিগ ভেবে ঠেলে দিতে চাইলেন কোভের সংক্রমনে। এতে নাকি সকলের অনাক্রম্যতা (হার্ড ইমিউনিটি) তৈরি হবে! নিষ্ঠুরতার এই অনন্য নজির খুঁজতে হয়তো ফিরে যেতে হবে হিটলারের জার্মানিতে। এই দুটি দেশের নমুনা দিয়েই আমরা বোঝার চেষ্টা করব ভারতের কান্ডারিদের।
**চিত্র ভারত : ভারতে প্রথম আক্রান্তের খোঁজ মেলে ৩০ জানুয়ারী। দুদিন পরেই আরও দুজন। কেরলে। প্রত্যেকেই উহান ফেরত ছাত্র। সেদিন থেকেই কেরল প্রশাসন ‘হু’য়ের গাইড লাইন মেনে তৎপর হলেন করোনার মোকাবিলায়। তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন ২৩ জানুয়ারী থেকে উহান প্রদেশে লকডাউন শুরু হওয়াকে। তাঁরা মান্যতা দিয়েছেন ৩০ জানুয়ারী হুর “সমস্ত দেশকে করোনা প্রতিরোধে তৈরি থাকার” নির্দেশকে।
প্রশ্ন আসে, চীন থেকে বছর শেষের ছুটিতে কি মাত্র তিনজন ছাত্র ভারতে ফিরেছিলেন? যেখানে শুধু ২০ হাজারের বেশি ডাক্তারি ছাত্র আছেন? কেন্দ্রীয় সরকারের সেই ভাবনার সময় কোথায়। তাঁরা তখন ব্যস্ত সওদাগর ট্রাম্প সাহেবের আবাহন পরিকল্পনায়। শাসক শ্রেণীর চিন্তায় তখন সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কূট কৌশল।
কেরল থেকে শিক্ষা নেওয়া দূরের কথা, ১৩ মার্চ ট্রাম্প সাহেবের নকলে প্রধানমন্ত্রী নির্দ্বিধায় বললেন, “করোনা নিয়ে কোনো ইমারজেন্সি নেই”। কিন্তু বাস্তব ছিল ৪ মার্চ ১৪ জন ইতালি ট্যুরিস্ট এবং ৯ থেকে ১৩ মার্চ মহারাষ্ট্রে ৩১ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তখন চলছে নানা ধর্মের উৎসব ও জমায়েত। ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী ছয় দিনের মধ্যেই ঘোষণা করলেন, “২২ মার্চ জনতা কার্ফু”। কেউ তখনো ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি ১৪ ঘণ্টার মধ্যেই সবাইকে হতচকিত করে ঘোষণা হতে চলেছে “তালাবন্দী”। ১৩৮ কোটির দেশে সব রাজ্যে এক সাথে। বিপদে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ। অবিমৃষ্যকারিতা নাকি মুক্ত বাণিজ্যের মাধ্যাকর্ষণে সকলকে একই সময়ে থামার বাধ্যতা। লক্ষণীয় আমেরিকা ২১, ইংল্যান্ড ২৩ এবং ভারতে ২৪ মার্চ লকডাউন শুরু হয়।
(ক) কভিড-১৯ দেখিয়ে দিল
(১) পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা, দুর্যোগ মোকাবিলায় কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও সমগ্র মানব সমাজের নেতৃত্ব দেবার অক্ষমতা। তার নিজের শ্রেণীও উদ্বিগ্ন, মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত। দীর্ঘকাল ধরে লালিত আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক মানসিকতা তাদেরকে নিজের শ্রেণীরই ঘাতকে পরিণত করেছে।
(২) দেখালো এক অভূতপূর্ব সংকট। আমাদের জানা আছে পুঁজিবাদের অতি উৎপাদন জনিত সংকট। এবার দেখলাম সংকটে পুঁজির বাজার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিক্রির চাহিদা থাকা স্বত্বেও। যে বাজারে পুঁজিপতিদের পুঁজির বড় রকমের উৎস সাধারণ মানুষের সঞ্চয় পুঁজি এবং ধার নেওয়া অর্থ (লোন); স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভ্রমণ কেনার জন্য। হাজির হলো এমন একটা সময়, যখন এক দিকে এই সব বাজারে সঞ্চয় পুঁজির বহমান যোগান ও তৎজনিত মুনাফার হাতছানি, অন্য দিকে করোনা আতঙ্কে বাজার বন্ধের বাধ্যতা। পুঁজিপতি ও তাদের রাষ্ট্র হতচকিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এ যেন সোনার পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আহরণে অক্ষম কোনো স্বর্ণ ব্যবসায়ী! ভরা পেটে ব্যুফে টেবিলের সামনে অসহায় কোনো ভোজনবিলাসী। ঠিক যেন টান্টালাস কাপের গল্প। কোভিড রুগী এখন মুনফার উৎস নয়, মৃত্যুর পরোয়ানা!!
(** বাজারের ক্রমপ্রসার, প্রকৃতির অবলুপ্তি ঘটিয়ে মানবজাতির অস্তিত্বকে নানা পথে সংকটাপন্ন করছে। ভাইরাসকেও সান্নিধ্যে নিয়ে এসেছে। এই আলোচনায় এই বিষয়টাকে বাদ রাখা হয়েছে।)
(৩) সার্স-২ দেখাল সমাজের উপরতলার মানুষের আতঙ্ক কিভাবে গোটা সমাজটাকে দ্রুততার সাথে গিলে নেয়। আতঙ্ক থেকে অবিশ্বাস, দূরত্ব। মানুষই মানুষের কাছে ভয়ের উৎস। সন্দেহের বাতাবরণ। মানুষ মানুষকে নিয়ে শঙ্কিত। সহমর্মিতা নয়, মমত্ব শূন্যতা। আন্তরিকতার বদলে নিষ্ঠুরতা। বাঘা বাঘা সংবাদ মাধ্যমে একদিকে আমেরিকা ও ইউরোপের আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা, অপরদিকে সরকার নির্ধারিত সতর্কতায় নজর না দেওয়া মানুষদের লাগাতার প্রচার, ভয় ও বিদ্বেষের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে চলেছে। মানসিকতার এই উর্বর পটভূমিই তো খুঁজে বেড়ায় ধর্মীয় মৌলবাদ বা উগ্রজাতিবাদের প্রতিভূরা। এদের কাছে এটাইতো “আচ্ছে দিন”!
(৪) ধনিক শ্রেণী বিজ্ঞানকে ততক্ষণই মান্যতা দেয় যতক্ষণ সেই বিজ্ঞান মুনাফা অর্জনে সহায়তা করে। বিজ্ঞান যদি মুনাফা অর্জনের প্রতিবন্ধক হয়, পুঁজিপতিরা তখন সাহায্য নেন অপবিজ্ঞান, কল্পবিজ্ঞান প্রভৃতির। প্রয়োজনে ধর্মান্ধতা, জাতি ঘৃণা প্রভৃতি। পুঁজিপতিরা তাদের প্রতিনিধি হিসাবে বেছে নেন খামখেয়ালী, স্বাভিলাসী, সতত মিথ্যাচারী, অতিআত্মম্মন্যতা দর্শী (মেগালোমেনিয়াক) প্রভৃতি অপ্রকৃতিস্থ মানসিকতার রাজনীতিকদের।
(৫) এই ধরনের বিপদ প্রতিরোধের আবশ্যক ও প্রাথমিক শর্ত “একক ব্যক্তির সুরক্ষা”। আবার “ব্যক্তির সুরক্ষা”ই “সমাজ সুরক্ষার” প্রধান শর্ত। “ব্যক্তির সুরক্ষা” দাবি করে তাঁর দৈহিক সক্ষমতা (ইমিউনিটি), বিজ্ঞান মান্যতা ও সমাজ মনস্কতা।
(খ) করোনা ভাইরাস শিক্ষা দিল :
(১) প্রতিটি ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও গ্রামস্তরে স্বাস্থ্য সচেতনতা, সকলের অংশ গ্রহণ (কমিউনিটি পার্টিসিপেশন) ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রসার উন্নত সমাজের জরুরী শর্ত। মুনাফা নয়। মানবিকতাই হতে পারে তার চালিকা শক্তি।
(২) প্রতিটি দেশের জীব-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার গবেষকরা করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে সচেষ্ট। বিশ্বের সকল নাগরিকের স্বার্থে এই নিরলস প্রচেষ্টা দাবি করে বিজ্ঞানই হোক সকল নাগরিকের পথপ্রদর্শক।
(গ) কর্পোরেট জগৎ স্বপ্ন দেখতেই পারেন ভ্যাকসিন তৈরি করে মুনাফা লুঠের। এটাই তাঁদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তাঁদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই (১) গঠনের সতত পরিবর্তন ঘটানো ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো ভ্যাকসিন সম্পূর্ণভাবে কার্যকরী নয়। সেই কারণেই ভ্যাকসিন থাকা সত্বেও “ফ্লু”তে ২০১৭-১৮-তে শুধু আমেরিকাতেই আশি হাজার মানুষ মারা গেছেন। (২) বিবর্তনের নিয়মেই, কোনো নূতন প্রজাতির কিংবা নূতন উপপ্রজাতির ভাইরাস আগামীদিনে আক্রমণ শানবেই। আজকের মতো সেদিনও সেই মুহূর্তে কোনো ভ্যাকসিন থাকবে না। সামাজিকভাবে প্রস্তুত না থাকলে আবার মরণ ও আতঙ্কের পুনরাবৃত্তি। কোভিড ও ফ্লু থেকে মানুষ এই জ্ঞানটুকু ইতিমধ্যেই আয়ত্ত করেছেন।