করোনা ভাইরাস প্রতিহতে লকডাউনের দাপাদাপি সকলের মুখে মুখে। আবার কাশ্মীরে আগস্ট, ২০১৯ থেকে নিরাপত্তার নামে লকডাউন প্রয়োগের ইতিহাসও টাটকা।
মানব ইতিহাসে সংক্রামক রোগ প্রতিহতে চীনে লকডাউনের ব্যবহার প্রথম শুরু হয়, সফলতাও আসে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক অন্যান্য পন্থার সাথে কখনো কখনো লকডাউনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু সমস্যা হল অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে। লকডাউন সত্ত্বেও আমেরিকা, ইউরোপে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা আটকাতে সাফল্য এলো না। আবার কোনো কোনো দেশ লকডাউনের সাহায্য ছাড়াই সফল হল।
সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদ্ধতির ধারণা মহামারীর ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায়। যেমন, পঞ্চদশ শতাব্দীতে, রোগীকে আলাদাভাবে রাখা ( আইসোলেসন) বা ষোড়শ শতকে, সুস্থ মানুষকে রোগের ছোয়াছুঁয়ি থেকে দূরে (কনফাইনমেন্ট) রাখা ইত্যাদি। জনস্বাস্থ্য(পাবলিক হেলথ) সম্পর্কিত ধারণা বিকাশের সাথে সাথে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানে আরো কিছু শব্দ যুক্ত হয়েছে। যেমন, সোশ্যাল ডিস্টান্সিং এবং তার উন্নত রূপ কোয়ারিন্টিন ও লকডাউন। শব্দগুলি শুধুমাত্র জনস্বাস্থ্য বিষয়ক (পাবলিক হেলথ মেজার)। তাই যে দেশে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, জনস্বাস্থ্যের জন্য পরিকাঠামো ও পরিকল্পনা বর্তমান, একমাত্র সেখানেই এই উপায়গুলির সুশৃঙ্খল ও সফল প্রয়োগ সম্ভব।
ক) পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্য :
রাষ্ট্র এই জনমুখী পরিষেবার পরিচালক ও নিয়ন্তক। লক্ষ্য, কমিউনিটিকে ভিত্তি করে সকলের জন্য স্বাস্থ্য ও তার সুরক্ষা। এই পরিষেবার বিশেষ দিক হছে কমিউনিটির সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণ। এপিডিমিওলজিস্ট ও পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারবাবুরা এই বিভাগের অন্তর্গত ও উপদেষ্টা। তাঁরাই এপিডেমিক রুখতে সারা বছর ধরেই বিভিন্ন পরিকল্পনা, আপৎকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং কমিউনিটিকে স্বাস্থ্য সচেতন ও সক্রিয় করেন। কমিউনিটিতে কোনো বিশেষ রোগের প্রবণতা, প্রত্যেকের শারীরিক অবস্থা, ইমিউনিটির মাত্রা, ইত্যাদি সব তাঁদের নখদর্পণে থাকে।
জনস্বাস্থ্যের ধারণা শুরু হয় ১৮৪০, ইংল্যান্ডে; কলেরা এপিডেমিক থেকে। জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর কল্যাণেই, চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, এমনকি ভারতের অঙ্গরাজ্য কেরল দ্রুততার সঙ্গে করোনা প্রবাহকে থামাতে সক্ষম হয়েছে।
খ) কিউরেটিভ মেডিসিন (রোগ নিরাময় বিজ্ঞান): রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা। এই বিভাগকে কেন্দ্র করেই স্পেশ্যালিটি, সুপার স্পেশ্যালিট, ঝাঁ চকচকে চিকিৎসা কেন্দ্র বা হাসপাতাল। এরই ভুলভুলাইয়ায় চিকিৎসার জন্য মানুষ ছুটছে শহর থেকে শহরে, দেশের ভিতর ও বাইরে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই শাখাটি স্বাস্থ্য বাণিজ্যের প্রাণ ভোমরা। ব্যবসায়িক দিক থেকে এই চিকিৎসা বিজ্ঞান যে দেশে যত পরিব্যাপ্ত, করোনা মোকাবিলায় সেই দেশের বিপর্যয় তত বেশি।
কিন্তু আমরা কী দেখলাম? করোনা প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনায় মিডিয়ায় তুফান তুলছেন, পত্রপত্রিকায় লিখছেন, সরকারকে উপদেশ দিচ্ছেন পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞদের বদলে কিউরেটিভ মেডিসিনের নানা শাখার দিকপালেরা।পাবলিক হেলথ সম্বন্ধে যাঁদের অভিজ্ঞতা ও অধ্যাবসায় প্রায় শূন্য। ব্যাপক হারে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করেই চীন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছে।
তাইওয়ান: (স্বাস্থ্যে খরচ: ২০১৭ ,জিডিপি র ৬.৪%)
করোনা প্রতিরোধে তাইওয়ানের সাফল্যে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের(হু) কাছে নিউজিল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী তাইওয়ানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তার কারণ ছিল তাইওয়ানে বিভিন্ন পদক্ষেপের সাথে অনেক এপিডেমিওলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ এবং লকডাউন প্রয়োগ না করার জন্য।
ভিয়েতনাম: (স্বাস্থ্যে খরচ: ২০১৭, জিডিপি র ৭.৫%)
সাফল্যের আরেক দাবিদার। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেখানে স্বাধীনতার (১৯৭৫) প্রথম থেকেই নজরকাড়া।৷ ফলে মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা মর্যাদাপূর্ণ। করোনায় মৃত্যু ভিয়েতনামে শূন্য। যেটা উল্লেখযোগ্য, ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী একজন এপিডেমিওলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে অভিজ্ঞ ও গবেষক। রোগ নির্ণয়ে গণহারে পরীক্ষার বদলে স্যানিটাইজেশন, সামাজিক দূরত্ব ও কোয়ারিন্টিনকে তাঁরা প্রাধান্য দিয়েছেন। শুধু দুটি স্থানে লকডাউন। আর প্রথম থেকেই থেকে উড়ানের আসা যাওয়া বন্ধ।
দক্ষিণ কোরিয়া : (স্বাস্থ্য খাতে: জিডিপি-র ৮.১% )
গণহারে পরীক্ষা করে আক্রান্তদের পৃথকীকরণ, রুগীর নিকটস্থদের কন্টাক্ট ট্রেসিং করে কোয়ারিন্টিনে রাখাতে এঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন। সম্পূর্ণভাবে কোনো শহরকে লকডাউন এখানে করা হয়নি।
মৃত্যু: ২৬০ (১৩ মে পর্যন্ত)।
চীন : (স্বাস্থ্যে খরচ : ২০১৮, জিডিপি-র ৬.৫৭%)।
এখান থেকেই, বলা হচ্ছে কোভিডের শুরুয়াত। একমাত্র উহান ও তার লাগোয়া অঞ্চলে করোনাকে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা এবং অন্যান্য রাজ্যে ব্যাপক হারে না ছড়াতে দেয়ার সাফল্যে অনেকেই সন্দিগ্ধ। আসলে আমাদের কোনো বাস্তব ধারণাই নেই, পাবলিক হেলথ সিস্টেম শক্তিশালী হলে কত দ্রুততার সাথে অসাধ্য সাধিত হতে পারে। চীন সেই দৃষ্টান্ত।
চীনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রথম থেকেই গুরুত্ব পেয়েছে প্রিভেনটিভ ও কমিউনিটি চিকিৎসা (১৯৪৯-৭৮)। ১৯৮০-র দশক থেকে চীন বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করলে সরকার প্রিভেনটিভ চিকিৎসা থেকে হাত গুটাতে শুরু করে। “ফেলো কড়ি মাখো তেল” ভিত্তিতে শুরু হয় ব্যয় বহুল চিকিৎসা। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গুরুত্বহীন হয়ে যায় (১৯৭৯-২০০৩)। ২০০২, সার্স-১ করোনা ভাইরাসের আক্রমণ সব হিসাব পাল্টে দিল। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুনর্জন্ম ঘটলো। বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে। তৈরি হল জনস্বাস্থ্যের জরুরি বিভাগ (পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি) শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত; দেশজুড়ে দ্রুততম উপায়ে সংক্রমণের খবর দেওয়া নেওয়ার নেট ওয়র্ক। ২০০৯ থেকে শহর ও গ্রামের প্রত্যেককে বিনামূল্যে বেসিক পাবলিক হেলথ সার্ভিস দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এবং উন্নত মানের জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে নিয়ে করোনার গতি রোধে চীন তাই সফল। বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে বেশ কিছু শহরে চীন লকডাউন লাগু করে। মনে রাখতে হবে, করোনার প্রথম পরীক্ষাগার চীন। ভাইরাসকে চেনা ও তার সংক্রমন পদ্ধতি বুঝতে সময় চলে যায় প্রায় এক মাস। ততক্ষণে “কমিউনিটি ট্রান্সমিশন” শুরু হয়ে গেছে। ২০ জানুয়ারী চীন নিশ্চিত হয়, ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটায়। অন্য দেশকে আবিষ্কার বিজ্ঞানের এই কঠিন সময়টুকু অতিক্রম করতে হয়নি।
ভারত : (স্বাস্থ্যে খরচ: ২০২০, জিডিপি-র ১.২৯ %)
কেরল রাজ্য ছাড়া ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা মর্মান্তিকভাবে অবহেলিত ও উদ্বেগজনক। ৩০ জানুয়ারী হু কোভিডকে গ্লোবাল ইমার্জেন্সি ঘোষণা করে। সেদিনই কেরালায় প্রথম করোনা রুগী চিহ্নিত হয়। সেই মুহূর্ত থেকেই ভারতের এই অঙ্গ রাজ্যে করোনার বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ শুরু হয়। কন্টাক্ট ট্রেসিং করে তিন হাজার জনকে কোয়ারিন্টিন করা হয়। সেখান থেকে ৪৫ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ৫ মার্চ, হু’র ডিরেক্টর জেনারেল টুইট করলেন, কোভিড-১৯ সব দেশের কাছেই বিপদজনক। প্রতিটি দেশের সরকার যেন খোলা মনে, দ্রুততার সাথে তাদের জরুরি পরিকল্পনা ও পরিষেবাকে সক্রিয় করেন। ১০ মার্চ হু করোনাকে প্যান্ডেমিক ঘোষণা করে। সেদিনই কেরল সরকার স্কুল কলেজ বন্ধের নির্দেশ দেন। ১২ মার্চ ভারতে করোনার হিসাব ছিল : মৃত ০২; আক্রান্ত ৮১। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিরুত্তাপ। হু’র পরামর্শকে তুড়ি মেরে, ১৩ মার্চ তিনি জানালেন, করোনার কোনো ইমার্জেন্সি নেই। আবার ঠিক সাত দিনের মধ্যেই জনতা কার্ফু এবং তার পরপরই নাটকীয়ভাবে লকডাউন ঘোষণা করলেন ২৪ মার্চ। কাকপক্ষীকে আঁধারে রেখে দেশের ২৯টি রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে একসাথে। শাঁখের করাতের মতো প্রথমে বিপদ ঘটালেন করোনাকে প্রতিরোধ না করে, পরে বিপদকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিলেন লকডাউনের অবিমৃষ্য সিদ্ধান্তে।
নিজেদের বাসগৃহ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা, কয়েক কোটি (১১ কোটি ৩০ লক্ষ) মজুরের জীবনকে ভাসিয়ে দেওয়া হলো বাণের জলে। দীর্ঘকাল ধরে কৃষি উৎপাদনে ধুঁকতে থাকা কৃষি ভারতকে পরিযায়ী শ্রমিকরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন। হঠাৎ চাপানো লকডাউনে একদিকে অসংগঠিত শ্রমিকদের বিপর্যয়, অপরদিকে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় উৎপন্ন কৃষি পণ্যের বাজারে ধ্বস, গ্রাম ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে দুর্ভিক্ষের গ্রাসে ঠেলে দিল ।
ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে মুহূর্তের মধ্যে ১৩৫ কোটি মানুষকে গৃহবন্দী করা হল। কিন্তু আমরা দেখেছি লকডাউন না করেও দেশকে করোনা মুক্ত রাখা যায়।
প্রতিরোধের প্রাথমিক উপায়গুলিকে সময় মতো গুরুত্ব না দিয়ে এক লাফে যুদ্ধং দেহি মনোভাব। শুরু হয়ে গেল রাস্তায় পুলিশের টহল ও শাসানি। ঘরে ঘরে আতঙ্ক! কমিউনিটির অংশগ্রহণের বদলে “কমিউনিটির গ্রহণ”। দেখলাম, অসহায়, ক্ষুধার্ত জনতার দুর্গম পথচলা মারী ও মরণকে সাথে নিয়ে। বুঝলাম লকডাউনের ঝাঁকি করোনাকে নয়, সাধারণ ভারতবাসীকে।
মরণাতঙ্কের আবহে আমআদমি যখন করোনা সমস্যা সমাধানে দিশেহারা, কয়েক হাজার কোটির সম্পদ লুটে নিয়ে নীরব, মালিয়ার দল দায় মুক্ত হয়ে সুখ নিদ্রায়। শাহিনবাগের শামিয়ানা ভেঙে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন সরকার পক্ষ। এনআরসি-র বিক্ষোভ থামিয়ে কপালের ঘাম মোছে স্বরাষ্ট্র দপ্তর। একের পর এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে কারারুদ্ধ। অব্যাহত সাম্প্রদায়িক বিষোদ্বমন ও আক্রমণ। মে দিবসের অর্জিত অধিকার ভূলুণ্ঠিত ভারত সরকারের পদতলে। জীবন্মৃত, গৃহবন্দী জনতা প্রমাদ গোনে হৃত স্বাধীনতার।
অণু জীবের ক্রম বিবর্তনের কারণে বিভিন্ন রূপের আত্মপ্রকাশ। নবাগত জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিষেধক নির্মাণ সময় সাপেক্ষ। কিন্তু প্রতিরোধের বিজ্ঞান জানা স্বত্বেও যদি তার প্রয়োগে রাষ্ট্র নির্বিকার থাকে কিংবা অপপ্রয়োগ করে তবে সে দায় রাষ্ট্রের পরিচালকদের।
করোনার বিরুদ্ধে লকডাউন ভারতের জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের ইতিহাসে বিষ্ময়সূচক ও প্রশ্ন চিহ্ন রেখে গেল।
-- ডাঃ সমীর দাশগুপ্ত