কত দিন এই লকডাউন চলতে পারে! দাবি আদায়ের জন্য এক দিন ধর্মঘট করলে দেশের কত ক্ষতি ও সেই ধর্মঘটে দিনমজুর, অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষজনের কত ক্ষতি হয়, তা নিয়ে যারা শোরগোল তোলেন লকডাউনের ফলে তাঁদের ক্ষতি ও সেই ক্ষতিপূরণ নিয়ে তাদের কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না।
কেবল ভ্রমনের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৯ কোটি জনতার কী হইবে? ২০১৫-১৬ সালে জিডিপিতে ভ্রমণ শিল্পের অংশ ছিল ৫.২%। ২০১৭-১৮ সালে ওই শিল্পে প্রত্যক্ষ ভাবে কর্মরত ছিল ৩.৫৪ কোটি মানুষ, পরোক্ষ ভাবে কাজ করতেন ৪.৫৬ কোটি কর্মচারী, মোট ৮.১১ কোটি ভ্রমণ শিল্পে জীবিকা নির্বাহ করতেন, যা ভারতবর্ষে মোট নিয়োগের ১২.৩৮% ছিল। অনুপাত যাই হোক না কেন, গত দুবছরে সংখ্যাটা বেড়েছে বই কমেনি। ফলে কোভিড ১৯ জনিত আতঙ্ক, যা লকডাউনের ফলে ব্যাপকতা লাভ করেছে, সরাসরি প্রায় ৯ কোটি কর্মচারির জীবন ও জীবিকাকে বিপন্ন করে তুলেছে।
অলস তালাবন্দী জীবন। ফ্রিজ থেকে ডিম ও মাছ বেরোচ্ছে। রান্না খাওয়া চলছে। রাঁধছে অবশ্য অন্যজন। ছাদের ওয়াটার রিজার্ভয়ের থেকে চাইলেই জল। দিনে বার আষ্টেক হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়া। ইলেক্ট্রিক কেটলিতে জল গরম করে বার সাত-আট চা-কফি ও সাথে গিন্নির গালমন্দ খাওয়া। রোজকার কাজ হিশেবে একবার ঘর ঝাড় দিয়ে মপার দিয়ে ঘর মোছা। সন্ধেবেলা ছাদেঘণ্টা দেড়েক ফোন কানে নিয়ে পায়চারি। কাজের মেয়েটি (এই ডাকেই বোঝা যায় আমাদের মতো মধ্যবিত্তরা কতটাই অকাজের) ট্রেনে করে আসত, আসতে পারছে না; এলেও ঢুকতে দেওয়া হবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। তাঁদের নিষ্কর্মা বেতন দেওয়া নিয়ে ‘বামৈশ্লামিক’দের তেমন দ্বিধা না থাকলেও অনেক ‘দেশপ্রেমী’ বেতনভূক বা ব্যবসায়ীদের বেশ উষ্মা ক্রমশ বাড়ছে, কাজ যখন করছে না কেন তাঁরা বেতন পাবেন? পাড়ার অটোচালক বা ওলা-উবের চালক কিংবা সুইগি-জোম্যাটোর ডেলিভারি বয়রা সব্জির গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে নুতন দাড়িপাল্লা নিয়ে হাজির হচ্ছে। ফলের গাড়ি বা মাছের ঝুড়ি নিয়েও আসছে নভিসরা, মাছ কাটতে গিয়ে হাতও কাটছে। সরকারী চাকুরে, কলেজ-বিদ্যালয় শিক্ষক, সংগঠিত সংস্থার কর্মচারীদের দিন খুব একটা খারাপ কাটছে না। যদিও দেশের চিন্তায় অস্থির হয়ে তবলিগিরা ও মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দারা কোরোনার প্রকোপের জন্য কতটা দায়ী তা নিয়ে তাঁরা দ্বেষ ছড়াতে একটুও রেয়াত করছেন না, হোয়াটসএ্যাপে ও সব্জি বা ফলের ভ্যানের সামনে থলে নিয়ে বেরিয়ে। তবে পিএম কেয়ারে কত সোনা তাঁরা দিলেন সে খবর আমার কাছে নেই। একই সঙ্গে রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, মেটিয়াবুরুজে কীভাবে লোকে জটলা করছে সে বিষয়েও বাজারে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়েই সবাইকে শুনিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছেন, যেন এই লকডাউনের বাজারে ওনারা মেটিয়াবুরুজে পাইকারি কাপড়-চোপড় বা পার্ক সার্কাসে রেওযাজি খাসি কিনতে গিয়েছিলেন। তবে বিদায়ের সময়ে সকলকেই স্টে হোম স্টে সেফ বলে উইশ করতে ছাড়ছেন না।
ওদিকে ২৪ ঘণ্টা দুজনে বাড়িতে থাকলে যা হয়, বিবাদ বিসম্বাদ। সরকার যা বলে, লোকে যা বলে তোমরা সব সময় তার উল্টো বল – এই অভিযোগে তাঁরও ক্লান্তি নেই আমারও শ্রান্তি নেই। আমি লকডাউনের সার্বিক বিপক্ষে। বলি, এভাবে কীভাবে হবে? তাঁকে বোঝাতে চাই, কোরোনার সংক্রমণকে লক ডাউন করে তখনই বিলুপ্ত করা সম্ভব যখন কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট কোনো এক সময়ে সকল করোনা আক্রান্তকে ও সেই সময়ে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন সকলকে চিহ্নিত করতে পারবেন, কোরোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা করবেন ও সম্ভাব্যদের কোয়ারান্টাইন করতে পারবেন ও তার পরে লকডাউন তুলবেন। তেমনটা কী হওযা সম্ভব? যদি তা না হয়, তাহলে তো লকডাউন তোলার পরেই ভাইরাস আবার ছড়াতে শুরু করবে। অন্য দিকে কত দিন এই লকডাউন চলতে পারে! দাবি আদায়ের জন্য এক দিন ধর্মঘট করলে দেশের কত ক্ষতি ও সেই ধর্মঘটে দিনমজুর, অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষজনের কত ক্ষতি হয়, তা নিয়ে যারা শোরগোল তোলেন লকডাউনের ফলে তাঁদের ক্ষতি ও তার পূরণ করা নিয়ে তাদের কোন হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। অবসরপ্রাপ্ত জীবনে মাঝে মাঝে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই বলে ভ্রমণের কথা ভাবছিলাম। এবছর বেশ কিছু টাকা জমে যাবে মনে হচ্ছে, অবশ্য যদি সরকার পেনশন দিতে থাকেন। কারণ, ভারতীয় জীবনে যে পরিমাণ ভয়ভীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে কোথাও গেলে সেখানকার মানুষ তাড়া লাগাতে পারে, তাছাড়া নন্দলালের নুতন সংস্করণ হিসেবে “হাঁটিতে সর্প কুক্কুর আর গাড়ি চাপা পড়া ভয়”-এর বদলে এখন ভ্রমনে যাহিলে ট্রেনে বা বিমানে কোরোনা জনিত ভয়। ফলে, ভ্রমণের অর্থ সঞ্চিত হবে, এবং উহা বিনি সুদের ব্যাঙ্ক এফডির বদলে মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে শেয়ার বাজারেও যাইতে পারে।
কিন্তু ওই ভ্রমনের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৯ কোটি জনতার কী হইবে? ২০১৫-১৬ সালে জিডিপিতে ভ্রমণ শিল্পের অংশ ছিল ৫.২%। ২০১৭-১৮ সালে ওই শিল্পে প্রত্যক্ষ ভাবে কর্মরত ছিল ৩.৫৪ কোটি মানুষ, পরোক্ষ ভাবে কাজ করতেন ৪.৫৬ কোটি কর্মচারী, মোট ৮.১১ কোটি ভ্রমণ শিল্পে জীবিকা নির্বাহ করতেন, যা ভারতবর্ষে মোট কর্মসংস্থানের ১২.৩৮% ছিল। অনুপাত যাই হোক না কেন, গত দুবছরে সংখ্যাটা বেড়েছে বই কমেনি। ফলে কোভিড ১৯ জনিত আতঙ্ক, যা লকডাউনের ফলে ব্যাপকতা লাভ করেছে, সরাসরি প্রায় ৯ কোটি কর্মচারীর জীবন ও জীবিকাকে বিপন্ন করে তুলেছে। ২০১৮ সালে ভ্রমণ শিল্পে বিদেশী মুদ্রার আয় ছিল ২৮৫৯ কোটি ডলার বা টাকার অঙ্কে ১.৯৪, ৮৯২ কোটি টাকা। অবশ্যম্ভাবীভাবে বিগত সময়ে তা বেড়ে ৩০০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, কারণ ওই অঙ্ক ২০১৮ সালে ৪.৭% হারে বাড়ছে। (এসমস্ত তথ্যই ভ্রমণ মন্ত্রক কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৮-১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া।)
ভ্রমণপ্রিয় জনতার বেড়ানো বন্ধ হয়ে গেলে কতটা ক্ষতি হবে ভারতীয় অর্থনীতির ও তার উপরে ভরসা করে বেঁচে থাকা কর্মীদের তা উপরের হিসেব থেকে বোঝা গেলেও তাই সম্পূর্ণ নয়। ভ্রমণের সঙ্গেঅঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে আরো কয়েকটি শিল্প। তার মধ্যে অন্যতম মোটরগাড়ি শিল্প। মোটরগাড়ি ও সহযোগী শিল্প ও সহযোগী কাজকর্মের উপরে প্রায় ৪ কোটি শ্রমিক কর্মচারি নির্ভরশীল ও দেশের মোট জিডিপির ৭.৫% ও ম্যানুফাকচারিং শিল্পের ৪৯% মোটরগাড়ি শিল্প থেকে আসে। এমনিতেই ভারতের মোটরগাড়ি শিল্পের অবস্থা খারাপ ছিল। এই কোভিড ১৯ উদ্ভুত আর্থিক ধাক্কা শিল্পের অবস্থাকে আরো খারাপ করবে। ফলে বহু মানুষের কাজ হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এই সময়ে যে ক্ষেত্রটি চরম বিপদের মুখে পড়েছে সেটি হল পরিবহণ শিল্প। পথ ও জলপথ পরিবহণের অধিকাংশটাই বেসরকারী ক্ষেত্রে। ট্যাক্সি, অটো, বাস, টোটো, রিক্সা, জলপথ পরিবহণ এগুলি গত দেড় মাস চলছে না। এগুলির অধিকাংশই একত্রে অনেক মানুষকে নিয়ে চলে। পরিবহণ চালু হলেও সেভাবে চলার উপরে নিষেধ থাকবে বলে মনে হয়। ফলে সেই কাজেও একটি সঙ্কট থেকে যাবে। রেলওয়ে স্টেশনগুলিতে যে দোকান পসার থাকে সেগুলি এখন বন্ধ। সরকার কোভিড-১৯ এর সুযোগ নিয়ে সেগুলিকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করবে। রেস্তোরা ও পথ পার্শ্বের ছোট খাবার দোকানগুলিও একই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেগুলির পুনর্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা কমছে। শপিং মলের কর্মচারি ও ফুটপাথে হকাররাও বিপুল সমস্যার সম্মুখীন। গত বৈশাখ বা বর্ষ শেষের সেলের বিক্রি বন্ধ হয়েছে। ঈদের বিক্রিও বন্ধের মুখে। পুজোয় যে বিক্রি বাটা হয় তাও কতটা হতে পারবে বলা দুস্কর। প্রায় দেড় মাসের টানা লকডাউন জনসাধারণের অনেক অভ্যেসকে পাল্টে দিয়েছে। যারা বইএর পাতা উল্টাতেন ও মোবাইল বা কম্প্যুটারে পড়ে আনন্দ পেতেন না, তাদের অনেকেই তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ফলে বইপাড়াতে ও ছাপাখানায় এর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। সংবাদপত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক, বণ্টনকারীদের উপরেও বড় ধাক্কা আসতে পারে। অর্থনৈতিক ডামাডোল বিজ্ঞাপন কমাবে, উপরন্তু কাগজের বদলে ইন্টারনেটে সংবাদ পাঠের প্রবণতা ও অভ্যেস তৈরি হয়েছে এই কদিনে। ফলে সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত সর্বস্তরের কর্মীদের উপরে কর্মী সঙ্কোচনের খাড়া ঝুলছে। বিমান পরিবহণ শিল্প এমনিতেই দুরবস্থায় ছিল। কোভিড সেই খারাপ অবস্থাকে গভীর করছে। একদিকে ভ্রমণ শিল্পের অবনতি, অপরদিকে কোভিড-১৯ এর জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে গেলে বিমান শিল্পের ব্যয় প্রভূত বাড়বে। ফলে বিমান ভড়াও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে। সম্প্রতি বিমান ভাড়া যে মধ্যবিত্তদের আয়ত্বে এসেছেল সেই পর্যায়কে অতিক্রম করে তা আবার উচ্চবিত্তের বিলাসে রূপান্তরিত হবে। ফলে বিমান শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের আয় কমবে ও কর্মী সঙ্কুচিত হবে। রেলপথ পরিবহণের ক্ষেত্রেও যৎপরোনাস্তি ক্ষয়ক্ষতি হয়েচে ও হবে। কিন্তু যেহেতু সেটি সরকারী বিভাগ তাই এই মুহূর্তে সেখানে কর্মী ছাটাই সহজ হবে না।
সব মিলিয়ে শ্রমিক কর্মচারিদের উপরে কোভিড এক দুর্যোগের আবহ তৈরি করেছে। যা কেবল অসংগঠিত ক্ষেত্রের ৪০ কোটি শ্রমিক কর্মচারিই নয়, সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক কর্মচারিদের উপরেও আঘাত হানার বাতাবরণ তৈরি করছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কোথায়? যারা বেসরকারী উদ্যোগের জয়গান গেয়ে থাকেন, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, এই যে প্রবল কর্মী সঙ্কোচনের সম্ভাবনা তা কিন্তু বেসরকারী ক্ষেত্রেই। সরকারী ক্ষেত্র সমস্ত ‘অদক্ষতা’র অভিযোগ সত্বেও টিকে থাকবে ও অর্থনীতিতে চাহিদার যোগান বজায় রেখে তাকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে। বেসরকারী ক্ষেত্র নিজের মুনাফার তাগিদে ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে পারে ও অর্থনীতির দুরবস্থাকে ত্বরান্বিত করতে পারে নিজের সুবিধের জন্য।
শেষ করার আগে অবহেলিত কিছু মানুষজনের দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যে সমস্ত মানুষদের আমরা অবমানব হিশেবে গণ্য করি বা ধর্তব্যে আনি না, সব ধরনের হিসেব নিকেশের সময়ে তাদের গুণতির বাইরে রাখি, সেই ট্রান্সজেনডার বা উভলিঙ্গ বা এলজিবিটিকিউ বা হিজরেদের আয় একদম বন্ধ, বন্ধ দেহব্যবসায়ীদের আয়। সমাজের অংশ হিশেবে তাদের বেঁচে থাকার দাবি কেউ কেউ তুললেও তা কোনো স্বর হয়ে উঠতে অপারগ।