শুরুতেই বলি, চীন ল্যাবরেটরিতে একটা জীবাণু যুদ্ধের অস্ত্র বানিয়ে তাদের নিজেদের দেশে বা বাকি বিশ্বে ছেড়ে দিয়েছে এরকম আজগুবি থিওরিতে আমি বিশ্বাস করি না। হোমিনিড-রা পৃথিবীতে আসার পর বার বার ভাইরাল প্যানডেমিকে তারা প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে হতে টিঁকে গেছে। মানুষের জিনোমের একটা বড় অংশ হল তার কোষে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আপাত ঘুমিয়ে পড়া রেট্রোট্রান্সপোজন যা আদতে এইচআইভি-র মতো ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণের জিন-ইতিহাস। তা ছাড়া ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় ভাইরাসের অনন্যতা পোষকের ইমিউনিটিকে এড়িয়ে যাবার ক্ষমতায়। ছোটখাটো মিউটেশনের ফলে অ্যান্টিজেনিক বদল বা ড্রিফট ঘটিয়ে সে অহরহই মানুষের অ্যান্টিবডিভিত্তিক শারীরবৃত্তীয় ‘স্মৃতি’কে ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া, বেশ কিছুদিন অন্তর অন্তর দুই বা ততোধিক টাইপের ফ্লু-ভাইরাস মানুষ বা অন্য কোনও অন্তর্বর্তী বাহকে জিন আদানপ্রদান করে সম্পূর্ণ নতুন অ্যান্টিজেনিক ধর্ম অর্জন করে হয়ে উঠছে নভেল। যেমন হয়েছে কোভিড ১৯-র ক্ষেত্রে। একে বলে অ্যান্টিজেনিক শিফট। ড্রিফট সামলে নেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ কেন না সেটা হল প্রতারিত স্মৃতির গল্প। শিফট নিয়ে সমস্যা বেশি কেন না নভেল বলে মানুষের দেহে তার ‘স্মৃতি’ থাকার অবকাশটাই হয়নি। মানুষের কোষ যে বহুমাত্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে জীবাণুদের হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে তাকে ঘোড়ার আড়াল নেওয়া গ্রিক সৈন্যদের মত ঠকিয়ে নভেলরা আমাদের লিখিত ইতিহাসকালেই বার বার ঢুকে পড়ছে আমাদের দেহে এবং বহু মৃত্যুর কারণ হয়েছে। ১৯১৮-র স্প্যানিশ ফ্লু কেবল একটিমাত্র উদাহরণ নয়।
এতদিনে আমরা সবাই জেনে ফেলেছি যে করোনাভাইরাস হল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের অতি নিকট আত্মীয় এবং এটিও এর আগে দু-দুবার মহামারী ঘটিয়ে ফেলেছে। এর মধ্যে ২০০২-০৩ এর SARS (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) নিয়ে আমাদের একটু বিস্তৃতে আলোচনা করতে হবে কেন না সেটিরও এপিসেন্টার ছিল চীন। আমরা দেখতে চাই এবারের এই কোভিড-১৯ অতিমারীর উদ্ভব ও বিস্তারে চিনের ভূমিকাকে সত্যিই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় কি না!
২০০২-০৩ সালের চীন হল তিয়েন আনমেন সঙ্কটকালের পরবর্তী চীন। ইনফরমেশন শেয়ারিং নিয়ে বাকি দুনিয়া চীনকে বিশ্বাস করতে ভরসা পাচ্ছে না। SARS মহামারীতে সরকারী হিসাব অনুযায়ী চীনে আক্রান্ত হয় পাঁচ হাজারের বেশি লোক আর মারা যায় ৩৪৯। এর প্রভাবে চীন ঘরে ও বাইরে দুভাবেই অস্থিরতার সম্মুখীন হয়। এমন কি পার্টিও রেকর্ড করছে “the health and security of the people, overall state of reform, development, and stability, and China’s national interest and international image are at stake” [[১]]। SARS এর প্রথম রোগীর খবর পাওয়া যায় গুয়াংডং প্রদেশের ফরশান শহর থেকে ২০০২ এর নভেম্বর মাসে। কিছুদিনের মধ্যেই আশেপাশের আরও দু একটা শহর থেকে একটা “স্ট্রেঞ্জ ডিজিজ”-এর খবর আসতে শুরু করে। কিন্তু গুয়াংঝাউতে কেন্দ্রীয় কমিটি প্রথম এক্সপার্ট পাঠায় ২০ জানুয়ারী ২০০৩। সরকারীভাবে প্রেস করা হয় ১১ ফেব্রুয়ারী ২০০৩ এবং লোকে জানতে পারে যে রোগ একটা হয়েছে তবে সেটা ‘কম্প্রিহেনসিভলি আন্ডার কন্ট্রোল’। SARS-এর কারণ হিসাবে চিহ্নিত হল SARS-CoV নামের একটি ভাইরাস যা করোনাভিরিডি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই দেরির ফলে যা হল তা হচ্ছে এই যে, রোগটিকে দেশের ও দেশের বাইরের মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক হিসাবে ঘোষণা করার আগেই একাধিক দেশে SARS-জনিত মৃত্যুর খবর পাওয়া যেতে থাকল। ১১ এপ্রিল ২০০৩-এ WHO সর্বপ্রথম SARS-কে ‘গ্লোবাল হেলথ হ্যাজার্ড’ হিসাবে সতর্কীকরণ ইস্যু করে এবং বিমানযাত্রাই যে এটির ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ – এই মর্মে একটি অ্যাডভাইসরি ইস্যু করে। এপ্রিলের ২৬-২৭ তারিখে বেইজিং শহরে শুরু হয়ে যায় আংশিক লকডাউন কেন না ততদিনে রোগটির এপিসেন্টার সরে এসেছে সেখানে। কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, কোয়ারান্টাইন, ট্রান্সমিশন চেইন অর্থাৎ সংক্রমণ শৃঙ্খলটির পথ ও গতি রুদ্ধ করার যে সমস্ত উপায়গুলি আজ সারা বিশ্ব জুড়ে অনুসৃত হচ্ছে তার সব কটিই চীন অতঃপর যে দ্রুততার সঙ্গে লাগু করে তাকে একটা ক্রুসেড বলাই সমীচীন। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দুটোই অচিরেই নিয়ন্ত্রণে আসে। জুন ২০০৩-এর মধ্যে বিশ্বের ২৯টি দেশের প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষ সংক্রামিত হন এবং তাদের মধ্যে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয় অর্থাৎ মৃত্যুহার দাঁড়ায় ৯.৪ শতাংশ। যদিও ২০০৪-এর মে মাস অবধি বেইজিং থেকে SARS আক্রান্তের খবর মিলেছে চিন সরকারের সূত্রে। যদি মনে হয় ২০০২ নভেম্বরে SARS-এর প্রথম হদিশ পাওয়া থেকে সেটার অস্তিত্ব ২০০৩-এর জানুয়ারি মাসে সরকারিভাবে স্বীকার করা এবং নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাগুলো নিতে তাদের দ্বিধা এপ্রিল পর্যন্ত বিলম্বিত হওয়ায় এই মহামারীতে এতগুলো প্রাণ গিয়েছিল, তা হলে এটাও মনে রাখতে হবে যে সেটাই ছিল করোনাভাইরাসঘটিত প্রথম মহামারী। এর মোকাবিলায় প্রাথমিক হতচকিত অবস্থা কাটিয়ে চীন সেটির নিয়ন্ত্রণে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল সেগুলোই পরবর্তীকালের এইরকম পরিস্থিতির মুখে পড়ে বাঁচবার গাইডলাইন হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
লক্ষ করার কথা এই যে, চীনের এবারের প্রতিক্রিয়াকাল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ডিসেম্বরের গোড়ায় প্রথম সংক্রমণের খবর পেয়ে WHO-কে জানাল তারা ৩১শে ডিসেম্বর। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা জীবাণুর সংক্রমণজনিত প্রতিক্রিয়াকাল হিসাবে এই মাসখানেক সময়কে অতি দীর্ঘ বলা ঠিক হবে না। সংক্রমণ মানুষ থেকে মানুষে হচ্ছে কিনা, এটি করোনা ভাইরাসের নতুন কোনও প্রকরণ কিনা, সেটির জিনোমের বিশ্লেষিত প্রকৃতি SARS-CoV-এর অনুরূপ না ভিন্নতর ইত্যাদি বুঝে উঠে সেটিকে নভেল হিসাবে চিহ্নিত করার পক্ষে সময়টা খুব বেশি এটা চীনের অতি বড় শত্রুও বলতে পারবেন না। ডিসেম্বর মাসেই উহান ফুড মার্কেটে সংক্রামিত মানুষের লালারস নিয়ে, মেটাজিনোমিক নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং টেকনিক ব্যবহার করে। তারাই সনাক্ত করে যে এটি নভেল বা সম্পূর্ন নতুন একটা করোনাভাইরাস SARS-Cov-2।
জানুয়ারীর মাঝামাঝি থেকে তারা রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যে ব্যবস্থা নেয় তা অভূতপূর্ব বললেও কম বলা হবে। প্রাথমিক হিসেব বলছে যদি ২৩ জানুয়ারী তারিখের লকডাউন না হত তাহলে সে দেশের ৫০ কোটি মানুষ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হত। একজন কোভিড-১৯ সংক্রামিত মানুষ কোনও নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাবিহীন স্বাভাবিক পরিবেশে গড়ে আড়াই থেকে তিন জন সুস্থ লোককে সংক্রমিত করতে পারে। চীনের লকডাউন দেখাল জানুয়ারীর ৩০ তারিখেই সে হার ১.০৫-এ নেমে এসেছে, যেটাকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা এপিডেমোলজিস্ট অ্যাডাম কুচারস্কি বলছেন – অ্যামেজিং। মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে এ সংখ্যায় জল আছে- আদতে তা অনেক বেশি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এপিডেমোলজিস্ট ক্রিস্টোফার ডাই বলছেন – কত বেশি? যদি ধরা যায় আসলে সংক্রামিতের সংখ্যা এ সময় সরকারী সংখ্যার তুলনায় ২০ থেকে ৪০ গুণও বেশি ছিল, তা হলেও মানতে হবে চীন তাদের দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। দেখে শুনে WHO বলছে – চীন ধন্যবাদার্হ।
সব ঠিক আছে, কিন্তু প্রায় সকলেই এ কথাও মেনে নেবেন যে লকডাউন যদি আরও আগে করা যেত তা হলে চিনে এবং চীনের বাইরে অবশ্যই এ হার অনেক কম হতে পারত। সাউদহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মডেল বলছে চীন মাত্র এক সপ্তাহ আগে তৎপর হলেই সে দেশে সংক্রমণ হার ৬৭ শতাংশ কমে যেত আর জানুয়ারীর প্রথম থেকেই তৎপর হলে তারা কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা তুলনায় ৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারত [[২]]। ইতালি, চীন এবং আমেরিকার বৈজ্ঞানিকদের একটি মিলিত সমীক্ষা বলছে উহান থেকে ট্র্যাভেল ব্যান লাগু করতে চীন চারদিন দেরী করেছে, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও বলছেন তাঁরা যে ট্র্যাভেল ব্যান চালু করে চীন থেকে সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাযুক্ত প্রতি পাঁচজন বাহকের মধ্যে চারজনকে তারা ওই দেশেই আটকে রাখতে পেরেছে [[৩]]।
একটু দেখে নেওয়া যাক, কী হত যদি চীন জানুয়ারির প্রথমদিন থেকেই অন্তঃদেশীয় ও আন্তর্জাতিক ট্র্যাভেল ব্যান লাগু করতে পারত? আমরা সবাই জেনে গেছি ইতিমধ্যেই যে করোনা-লিঙ্কের একদম কেন্দ্রে আছে হুবেই প্রদেশের প্রধান শহর উহান। গুগল করলে ২০১৮-র সেন্সাস ডেটা দেখতে পাওয়া যায় – অধিবাসীর সংখ্যা ১.১১ কোটি। প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ার কারণে এবং শিল্প-বাণিজ্যের ক্রমপ্রসরমানতার জন্য চীনের বিভিন্ন প্রান্তের লোক রোজ উহানে আসেন, থাকেন, যাতায়াত করেন। দুটি নদী – ইয়াংজি এবং হান, অনেকগুলি লেক ও পার্ক এবং ফুড মার্কেট উহানকে ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসেবেও পূবের বিশ্বে উল্লেখযোগ্য জায়গা দিয়েছে। সম্ভবত ডিসেম্বরের গোড়া থেকেই উহানের হাসপাতালগুলি এমন কিছু রোগী পেতে শুরু করে যাদের লক্ষণ ভাইরাল নিউমোনিয়া বা অজানা জ্বরের মতো এবং এও লক্ষ করা যায় যে প্রচলিত কোনও ওষুধেই এ জ্বর সারছে না। ডিসেম্বরের শেষাশেষি শনাক্তকৃত এমন রোগী ছিল ওদের হিসেবে ডজনখানেক, জনস হপকিন্স ইউনিভারসিটির হিসেবমতে তখনই তা হাজারের নীচে নয়। হয়ত তখনই কম্যুনিটি স্প্রেড হয়ে গেছে, কিন্তু চীনের প্রশাসকেরা নিজেদের জনতাকেই প্রথম অ্যালার্ট করে বছরের শেষে – ৩০শে ডিসেম্বর। সে দিনই তারা WHO-কে জানায় এমন একটি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে বটে তবে তা “প্রিভেন্টেবল অ্যান্ড কনট্রোলেবল”! এ কথাও মানতে হবে যে, করোনার বিশ্বপরিক্রমার জন্য এর চেয়ে সুসময় আর কিছু হতে পারত না। এটা চৈনিক ক্যালেন্ডারের নববর্ষ উদযাপনের সময়। মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে দেখা যাচ্ছে শুধু পয়লা জানুয়ারীতেই এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার লোক উহান থেকে বেরিয়ে দেশের এদিক ওদিক গেছে। জানুয়ারীর ২১ তারিখে চীন প্রথম খোলসা করে যে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ হচ্ছে কিন্তু ততদিনে বেইজিং, সাংহাই সহ অন্যান্য বড় শহরগুলোতে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর দু-দিনের মাথায় তারা উহান শহর লকডাউন করে এবং অচিরেই আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ততদিনে করোনার বীজ পৌঁছে গেছে দুনিয়ার নানা প্রান্তে। নিউ ইয়ারের ছুটিতে হাজার হাজার মানুষ উহান থেকে উড়ে গেছে বিভিন্ন গন্তব্যে। ৯০০ জনের একটি দল গেছে নিউ ইয়র্কে, ২২০০ মানুষ গেছে সিডনিতে, ১৫০০০ গেছে ব্যাঙ্ককে এবং করোনার চীন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার খবর পাওয়া যেতে থাকে সিঙ্গাপুর, সিওল আর সিয়াটল থেকে। অনুমান করা যায়, এই ভ্রমণার্থীদের মধ্যে তখনও বহু লোক এমন ছিল যাদের মধ্যে রোগের লক্ষণ নেই বটে তবে রোগ তারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল দেশে দেশান্তরে। SARS-এর অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও কেন যে চীন ট্র্যাভেল ব্যান লাগু করতে এতটা দেরী করল আর কেন যে WHO তার পরেও একমাস বসে রইল বাকি বিশ্বকে সতর্ক করতে, তা ব্যাখ্যা করা কঠিন।
এখানেই আর একটা কথা চলে আসে প্রাসঙ্গিকভাবে। ২০০২-০৩ এর SARS মহামারীর পরে চীন দেশ জুড়ে একটা প্রযুক্তিনির্ভর অ্যালার্ম সিস্টেম চালু করেছিল যেটাকে অভ্রান্ত এবং সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে সক্ষম বলেই ওরা ভাবত এবং SARS পরবর্তী যে কোনও আউটব্রেকের ক্ষেত্রে এটাকেই তারা ফ্রন্টলাইন ইমিউনিটি বলে ভেবে নিয়েছিল বলে মনে হয়। অর্থাৎ মানুষের হাড়ে-মজ্জায়-রক্তে-মাংসে অনাক্রম্যতার যে অমোঘ সঙ্কেতগুলি মহামারির পূর্বাবস্থা ঘোষিত করে তার চেয়ে প্রযুক্তিগত সঙ্কেতের উপর তাদের ভরসা ছিল বেশি [[৪]]। দেখাই যাচ্ছে সিস্টেমটা প্রত্যাশামাফিক কাজ করতে পারেনি। অনুমান করা যায় স্থানীয়ভাবে যখন চিকিৎসকরা মনে করছিলেন নতুন একটি ভাইরাল সংক্রমণের হদিশ পাচ্ছেন তাঁরা, তখন তার প্রযুক্তিগত সমর্থন নেই সিস্টেম থেকে। ঠিকঠাক কাজ করলে এই সিস্টেম থেকে বেইজিং খুব দেরী হবার আগেই জানতে পারত কী আসতে চলেছে। চীনের ন্যাশানাল ডিজিজ রিপোর্টিং সিস্টেম (NDRS) হল এমন একটা নেটওয়ার্ক যা দেশের ১৪০ কোটি মানুষের প্রতিজনকে পঁয়ত্রিশটি সংক্রমণযোগ্য অসুখের পরিপ্রেক্ষিতে নজরে রাখতে পারে। এটাকে এক ধরনের মাস সার্ভেলেন্স নেটওয়ার্ক বলা যেতেই পারে কেন না প্রতিটি মানুষের রোগসংক্রান্ত তথ্য তার ন্যাশানাল আইডিভিত্তিক তথ্যের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া চীন সারা দেশে ১৪৫টি ডিজিজ সার্ভেলেন্স পয়েন্ট (DSP)-এর মাধ্যমে র্যান্ডম স্যামপ্লিং-এর সাহায্যে বয়স, লিঙ্গ, অন্য ধরনের অসুস্থতা, জীবিকা, রোজগার ইত্যাদির উপর নির্ভর করে যে কোনও জায়গার মানুষের গড়পড়তা সংক্রমণ প্রবণতার একটা হদিশ দিতে পারে বলেই বিশ্বাস ছিল SARS পরবর্তীকালে। কোভিড ১৯-এর ক্ষেত্রে এই সিস্টেম ব্যর্থ হয়েছে আগত দুর্যোগের আগাম হদিশ ঠিক সময়ে দিতে, কিন্তু মানতেই হবে বহুলাংশে সফল হয়েছে ভাইরাসের ট্রান্সমিশন চেইনকে রুখে দিতে। এই নেটওয়ার্ককে তারা জুড়ে দিয়েছে একটি কনট্যাক্ট ট্রেসিং অ্যাপ-এর সঙ্গে যা কেন্দ্রীয় ডেটা ব্যাঙ্কে জমা হওয়া তথ্যের মাধ্যমে মানুষকে ভাগ করে দিচ্ছে সবুজ-হলুদ- লালে। আপনার হাতের স্মার্টফোনে থাকা অ্যাপটি আপনাকে জানিয়ে দেবে মেট্রোয় যার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সে আপনার পক্ষে নিরাপদ (সবুজ) না কি আপনার সরে যাওয়াই বাঞ্ছনীয় (হলুদ) না সে ইতিমধ্যেই সংক্রামিত। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে যা যা চীন করেছে, সে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং-ই হোক বা কন্ট্যাক্ট ইনহিবিশন (সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং কথাটা ভালো লাগে না), লকডাউনই হোক বা চেইনব্রেকিং– সবকটাই আজ বাকি বিশ্বে অনুসৃত হচ্ছে। হার্ড ইমিউনিটির প্রবক্তা বরিস জনসন বা ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও শেষ পর্যন্ত তাদের দেখানো পথেই হাঁটতে হয়েছে। পথ হিসাবে সেটাই যে ষোল আনা গ্রহণযোগ্য সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। যদি তাও হয়, তাহলে তা মেনে নিয়েও বলতেই হচ্ছে চীন যদি আর কয়েকদিন মাত্র আগে, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, তাদের নববর্ষের আগে উহান থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে পারত তা হলে SARS-Cov-2-এর বিশ্বভ্রমণ বহুলাংশে আটকানো যেত।
চীনের বিরুদ্ধে আর যে অভিযোগ সঙ্গতভাবেই তোলা যায় তা হল তাদের একাংশের খাদ্যরুচি যা নিশ্চিতভাবেই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী। করোনা প্যান্ডেমিকের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভবত এই প্রথমবার বেইজিং মেনেও নিয়েছে এই কথা। বেইজিং ইনস্টিটিউট অফ মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড এপিডেমোলজির প্রখ্যাত দুই বিজ্ঞানী নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁদের সাম্প্রতিকতম গবেষণাপত্রটিতে অন্তত প্রকৃতিবিরূপ খাদ্যরুচির কথা পরোক্ষে মেনে নিয়েছেন [[৫]]। তাঁরা বলছেন বাদুড় হল এই করোনাভাইরাসের একমাত্র স্বাভাবিক পোষক যার থেকে মানুষে এই সংক্রমণ ছড়িয়েছে এবং বাদুড় আর মানুষের মাঝে আরও দু-তিনটে ইন্টারমিডিয়েট বাহক থাকতেই পারে। এর পরেই তাঁরা যা বলেছেন তা খাদ্যরুচির নিরিখে চীনের প্রতি বাকি পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিযোগের নিরিখে প্রণিধানযোগ্য। তাঁরা বলছেন “If wild animals are not treated well, humans may be punished by nature.” নেচার-এর মতো পত্রিকায়, কোনও বিজ্ঞান সন্দর্ভ পেশ করতে গিয়ে এরকম উপসংহার ব্যক্ত করাকে খাদ্যরুচির সঙ্গে অতিমারির সম্পর্ক স্বীকার করে নেওয়া বলেই মনে করি। আশা করাই যায় চীন এরপর থেকে তাদের মানুষের খাদ্যরুচিকে প্রকৃতি-বিরূপতার মানদণ্ডে যাচাই করে দেখবে এবং সেভাবেই তাদের দেশের মানুষকে প্রণোদিত করবে। এই লেখা যখন লিখছি তখন জানা যাচ্ছে ফেলাইন অর্থাৎ বাঘ-বিড়াল ফ্যামিলির প্রাণীও নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এহ বাহ্য, বিড়াল তো আইনসম্মতভাবে সে দেশে ভক্ষ্য আর বাঘের মাংসের যৌনক্ষমতা বিবর্ধক হিসাবে চীনে প্রবল চাহিদা আছে। বিজ্ঞানীদের হুইসল তারা শুনলে হয়!
কিন্তু ভাইরাল প্যানডেমিকের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে এবং ফ্লু-জাতীয় ভাইরাসগুলির মিউটেবিলিটি বা জিনগত পরিবর্তনশীলতা অর্জনের ক্ষমতা মাথায় রাখলে বলে দেওয়া যায় – মানুষ বিপন্ন বটে তবে এই শেষবার নয়। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আমাদের জন্য আরও অনেক বড় দুর্যোগ অপেক্ষা করে আছে। SARS-CoV-2-এর টীকা অচিরেই বেরিয়ে যাবে কিন্তু তা দিয়ে অনাগত SARS-CoV-3 বা অন্য কোনও গোকুলে বাড়তে থাকা ভাইরাসকে দমিয়ে রাখা যাবে না যদি ঠিক সময়ে ঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া যায়। ঠিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে চিন উদাহরণ হতে পারে, কিন্তু সময় ও প্রাণীবাহিত সংক্রমণের নিরিখে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকেই গেল।
তথ্যসূত্র:
[[১]] https//www.ncbi.nim.nih.gov >books
[[২]] https://www.nature.com/articles/d41586-020-00741-x
[[৩]] https://doi.org/10.1126/science.aba9757
[[৪]] https://www.nytimes.com/by/steven-lee-myers
[[৫]] https://www.nature.com/articles/s41423-020-0407-x
(লেখাটি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম নামক ই প্ল্যাটফর্ম থেকে গৃহীত। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।)