তেলিনিপাড়ার হিংসা-বিধ্বস্ত পরিবারগুলির পাশে: দ্বিতীয় দফার রিপোর্ট
teleni

১৮ মে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন ও শ্রমিক সংগঠন এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে পার্টির জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম (বাকি সদস্যরা – সুদর্শন বসু, প্রশান্ত নাথ, সমীর ব্যানার্জি ও ভিয়েত) হুগলির ভদ্রেশ্বর তেলিনিপাড়ায় হাজি মহম্মদ মহসিন প্রাইমারী স্কুলের শিবিরে আশ্রয় নেওয়া দুই শতাধিক মানুষের সাথে দেখা করেন। এঁরা সকলেই মুসলমান। গত ১২ মে এক পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হন এঁরা। কথা শুরুর আগে তাঁদের জন্য কিছু শুকনো খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হয়। রমজান মাস চলছে এবং সামনেই ঈদের উৎসব, কিন্তু ঘর হারানো এইসব মানুষের চোখে মুখে শুধু আতঙ্ক আর তীব্র ক্ষোভ। প্রশাসনের তরফে মোট তিনটি আশ্রয় শিবিরে এই মানুষদেরকে রাখা হয়েছে। এই স্কুলটি ছাড়াও ফায়জামা ফাইদুল হাইস্কুল, সেখানে আছে প্রায় ৭০ টি পরিবার, আরেকটি স্কুলে অল্প কয়েকটি পরিবার। এই সংকটে কাছে পেয়ে তাঁরা পার্টির কাছে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। শিবিরে জায়গা অপ্রতুল হওয়ার জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

dist

 

সমাজকর্মী নাসির বলছিলেন, “এখন সবচেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে শিবিরে যেভাবে মহিলারা বাচ্চা নিয়ে আছেন, সেখানে কোনো শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না”। স্থানীয় যুবক আজমল সামনের বিস্তৃত খোলা জায়গা (যা নর্থ শ্যামনগর মিলের সম্পত্তি) দেখিয়ে বললেন, “এখানে অস্থায়ী ছাউনি করে থাকার ব্যবস্থা করলে, দূরত্বও বজায় থাকতো আর এই প্রচন্ড গরমে মানুষগুলোও স্বস্তি পেতো”। স্কুলে ঢুকে দেখা যায় – একটা ছোট হলঘরে মহিলা, কিশোরীরা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছেন, পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরেও দূরত্ব বজায় রেখে থাকা সম্ভব নয়। দিনের বেলায় অনেক ছেলে ঘরের বাইরে থাকে বলে কিছুটা ফাঁকা!

doc

 

ইদানিংকালে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন জায়গার দাঙ্গার সাথে এখানকার ঘটনার একটা অদ্ভুত তাৎপর্যপূর্ণ মিল খুঁজে পাওয়া গেল – সেটা হচ্ছে আক্রমণকারীরা ঘরে আগুন লাগানোর পাশাপাশি সমস্ত নথি আলাদাভাবে পুড়িয়ে দিচ্ছে। এখানেও যুবক ওয়াসিম বা মোক্তার আলম একই কথা জানালেন যে, তাঁদের কোনো সার্টিফিকেট অবশিষ্ট নেই। যখন আগুন লাগানো বা ভাঙচুর চলছে, তখন পুলিশ বা দমকলকে ফোন করে পাওয়া যায়নি, কেউ ফোন ধরেনি। ফলত বহিরাগতদের ব্যাপক তাণ্ডব ও ক্ষয়ক্ষতির ভালোরকম শিকার তাঁদেরকে হতে হয় বলে তাঁরা জানান। দাঙ্গাকারীরা বেশিরভাগ ছিল বাইরে থেকে আসা তবে এলাকার বিজেপি কর্মীরা মুসলিমদের ঘরগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। ওইদিন গুরুতর আহত মঞ্জুর আলম এবং মহম্মদ এজাজের সঙ্গে দেখা করলে জানা যায়, পুলিশ হাসপাতালে শুধু তাঁদের নামটা জেনেছে, বাকি কিছুই করেনি! অন্যরাও জানালেন যে, থানা এফআইআর নেয়নি, কোনো লিখিত আবেদনও গ্রহণ করেনি। জনসাধারণের জন্য শৌচাগার বা প্রস্রাবগার ব্যবহার করতে গিয়ে মুসলমানেরা বাধার সম্মুখীন হন। এই ঘন অন্ধকারে রূপালি রেখার আভাস দিয়ে নাসিরুদ্দিন জানালেন, স্থানীয় হিন্দু দুধ ব্যবসায়ীরা সেদিন বুক দিয়ে অনেককে আগলেছেন, তাঁদের বাধাতেই দাঙ্গা এই এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারেনি। শিবিরে থাকা মহিলাদের চোখে মুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। চোখের সামনে বাড়ি ঘর সংসারের সমস্ত জিনিস পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা ও ক্ষোভের কথা তাঁরা জানালেন। সামনে ঈদ। নতুন জামা কাপড়ের কথা ভাবা এখন তাঁদের কাছে বিলাসিতা, একবার বদল করার মতো কাপড়ও অবশিষ্ট নেই। অত্যাচারিতদের অধিকাংশই নর্থ শ্যামনগর, ভিক্টোরিয়া ও গোঁদলপাড়া জুটমিলের শ্রমিক।

te

 

প্রসঙ্গত গত ১৬ মে যখন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের তথ্যানুসন্ধানী দল প্রথমবার ঐ এলাকা পরিদর্শনে যায় তখনই এই অত্যাচারিত মানুষরা অভিযোগ করেন যে, গত ১২ মে মাত্র তিন ঘণ্টায় ৯, ১০, ১১, ১২নং শ্রমিক লাইনের কোয়ার্টারগুলোতে হামলা, ভাঙচুর, আগুন জ্বালানো, টাকাপয়সা, জিনিস লুঠপাট করা হয় এবং বাসিন্দাদের আক্রমণ করা হয়। বিজেপির প্রত্যক্ষ মদতপুষ্ট সমাজবিরোধী বাহিনী বাড়ি বাড়ি হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে রক্তাক্ত করে। এখনও কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শোনা যাচ্ছে হামলার আগে বহিরাগতরা বন্ধ গোঁদলপাড়া ও ভিক্টোরিয়া জুটমিলের ভেতরে লুকিয়েছিলো! ইতিমধ্যে নর্থ শ্যামনগর জুট মিল খুলেছে, দুই শিফটে কাজ চলছে। ‘করোনা সংক্রমণ মুসলিমদের দ্বারা বাহিত’ – সংঘ পরিবারের এই পরিকল্পিত মিথ্যা প্রচার এই এলাকায় ভাল মাত্রায় ছড়ানো চলছে এবং মিল কর্তৃপক্ষও এই কারণে কোন মুসলিম শ্রমিককে কাজে নিচ্ছে না! আরো অভিযোগ যে, একের পর এক শ্রমিক কোয়ার্টার ভাঙচুর ও জ্বালানো সত্ত্বেও মিল ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে এখনও অবধি কোনো অভিযোগ দায়ের করাই হয়নি। মালিকপক্ষের এই সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব নিয়েও আক্রান্ত শ্রমিকেরা স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ।

vio

 

সিপিআই(এম-এল) দলের হুগলি জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার বলেন, “প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে হামলার অভিযোগে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে নানাপ্রকার উস্কানিমূলক প্রচারের জন্যও দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই একইরকম তৎপরতা হামলাকারীদের প্রত্যক্ষ মদতদাতা ও সংগঠক তথা নেপথ্য নায়কদের বিরুদ্ধে কেন নেওয়া হচ্ছে না? সোশ্যাল মিডিয়াতে ক্রমাগত মিথ্যা ছবি ও ভিডিও প্রচার করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও হামলার প্ররোচনা ছড়াতে দেখা গেছে বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং ও লকেট চ্যাটার্জিকে। এবিষয়ের যথেষ্ট প্রমাণও রয়েছে। সাংসদ পদে থেকেও এসব করেছেন তাঁরা। তবু বিজেপির মাথাদের বিরুদ্ধে কেন আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না! সরকার ও প্রশাসনের কাছে সদুত্তর দাবি করছে সিপিআই(এমএল)।”

সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শিকার মানুষদের পাশে আছে ও থাকবে পার্টি। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে তাঁদেরকে ভাতে মারার এই ঘৃণ্য চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করবে পার্টি। প্রশাসনের তরফে আরও খাদ্য সরবরাহ করা এবং ভাঙা ও পুড়ে যাওয়া বাড়ির পুনর্নির্মাণের আশু দাবি নিয়ে আন্দোলন এবং ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করতে মিল মালিকের উপর চাপ জারি রাখবে। পুলিশ, প্রশাসন, স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে শ্রম দপ্তর সর্বত্র উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সর্বতো প্রচেষ্টা ও ধারাবাহিক উদ্যোগ জারি থাকবে বলে জানিয়েছেন জেলা সম্পাদক।

খণ্ড-27