প্রশ্নোত্তরে ২০ লক্ষ কোটি টাকার আত্মনির্ভর ভারত অভিযান প্যাকেজ
pack

কোভিড-১৯ অতিমারী আক্রান্ত অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য যে টুয়েন্টি টুয়েন্টি ও পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল তা গত ১৭মে শেষ হয়েছে। একই সাথে ওইদিন লকডাউনের চতুর্থ পর্যায় শুরু হল, ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে। মোদিজী বলেছিলেন, ৪র্থ পর্যায়ের লকডাউন অন্যরকম হবে। তাঁর কথার মর্যাদা রাখতে এবারে সন্ধে ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফু জারি করা হল। গত ৫৪ দিনে রাতে যা ঘটেনি আগামী ১৪ দিনে তেমন কী ঘটবে যার জন্য ১২ ঘণ্টা কারফু তার ব্যাখ্যা অবশ্য দেওয়া হয়নি। তবে সম্রাটরা প্রজাদের অত ব্যখ্যা দেন না।

গত ৩টি পর্যায়ের লকডাউন ও তার থেকে উদ্ভুত অর্থনীতি ও সেই অর্থনীতি সংক্রান্ত ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ নিয়ে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, সেই প্রশ্নগুলিকে উত্থাপন করে নিজেই তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।

pag

 

প্রশ্ন: ২০,০০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজে কী কী অন্তর্ভুক্ত হযেছে?

প্রথমত, মনে রাখতে হবে যে আর্থিক সুরাহার ঘোষণা, আত্মনির্ভর ভারত অভিযানের পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তা লকডাউন ঘোষণার ২ দিন পর থেকে শুরু হওয়া সমস্ত সরকারি রাজস্ব ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃক গৃহীত অর্থ ব্যবস্থা (মানিটারি) বন্দোবস্তের সমাহার। এর মধ্যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ৮০০ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক সহায়তার মাধ্যমে অর্থনীতিতে নগদ সরবরাহের প্রকল্প আছে যার জন্য সরকারের কোন খরচ কখনো হবে না। এর পাশাপাশি এর মধ্যে ২৬ মার্চ ঘোষিত সরকারের বাজেট অন্তর্ভুক্ত বা নির্মাণ কর্মী তহবিল বা জেলা খনিজ তহবিলের  সর্বমোট প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা রয়েছে, ফলে ওই সময়ে ঘোষিত ১৯৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে কেবল ১১৫ হাজার কোটি টাকাকে আর্থিক সুরাহার জন্য ধরা যেতে পারে। অর্থমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঘোষণায় যা জানা গেছে তাতে ওই টাকাও পুরো খরচ হয়নি।

দ্বিতীয়ত, ১৩ মে থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ধারাবাহিক ঘোষণায় যে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে তার পরিমাণ তিনি বলেছেন, ১১০৩ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে সরকারের ঘর থেকে জনসাধারণের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকা (এমএসএমইদের জন্য তহবিল সংক্রান্ত ১৪ হাজার কোটি, ইপিএফ-এর জন্য ২, ৫০০ কোটি, পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্য শস্যের জন্য ৩, ৫০০ কোটি ও ১০০ দিনের কাজের জন্য ৪০ হাজার কোটি)। মনে রাখা দরকার, আগেই বলা হয়েছে, ১০০ দিনের কাজের জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কেবল নিয়মতান্ত্রিকতা, কাজ চাইলে আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার দিতে বাধ্য। বাকি ১০৪৩ হাজার কোটি টাকার সবটাই হয় বিভিন্ন পরিকাঠামো উন্নয়ন সংক্রান্ত বরাদ্দ যা কাজ শুরু করলেও কয়েক বছর লাগবে, এবং অধিকাংশ বিভিন্ন ঋণদানের অনুমিত পরিমাণ। এছাড়া, উৎসমূলে কর কাটাতে ছাড় যা সমস্ত করদাতাকেই বছর শেষে মেটাতে হবে (পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি) বা কর্মচারির ইপিএফ না দেওযার সুবিধে, সেই কর্মীর নিজের টাকা ও ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় এবং নিয়োগকর্তা কর্তৃক প্রদেয় সমপরিমাণ টাকা (মোট ৬, ৭৫০ কোটি) এগুলিকেও অর্থমন্ত্রী আপন মনে করে প্যাকেজে ঢুকিয়েছেন।

প্রশ্ন:  তাহলে সব মিলিয়ে কত কোটি টাকা রাজকোষ থেকে সরকার দিযেছে বা দিচ্ছে কোভিড ১৯ এ অভাবীদের সাহায্যে? তা জিডিপির কত শতাংশ?

উপরের হিসেব অনুযায়ী ১৭৫ হাজার কোটি টাকা। যদি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিযা রিসার্চের হিসেবকে ধরা হয়, তাহলে পরিমাণটা দাঁড়াবে ২০৩ হাজার কোটি টাকা। বার্কলে রিসার্চের হিসেবকে অনুসরণ করলে অর্থমন্ত্রী নুতন রাজকোষ থেকে সাহায্যের ঘোষণা করেছেন ১৫০ হাজার কোটি টাকা, তার সঙ্গে স্টেট ব্যাঙ্কের হিসেবে অন্তর্ভুক্ত গরিব কল্যাণ যোজনার ৭৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ জুড়লে হবে ২২৩ হাজার কোটি টাকা। আর্নস্ট ইয়ঙ-এর হিসেবে নুতন বরাদ্দ ১২৩ হাজার কোটি টাকা, তার সঙ্গে ওই ৭৩ হাজার কোটি টাকা জুড়লে দাঁড়ায় ১৯৬ হাজার কোটি টাকা। ফলে সর্বোচ্চ পরিমাণটি ২২৩ হাজার কোটি টাকা, ২০০০ হাজার কোটি টাকার ১১% মাত্র বা জিডিপির ১.১% র কম। যদিও মোদিজী বলেছিলেন যে, প্যাকেজটি হবে জিডিপির ১০%।

প্রশ্ন: হিসেবগুলির মধ্যে এত তফাত কেন?

কারণ ঠিক কত টাকা এক্ষুণি বা এই বছরে সরকার খরচ করবে বিভিন্ন প্রকল্পে তার কোনো নির্দিষ্ট হিসেব নেই। যেসব পরিকাঠামো হয়তো বছরের পর বছর ধরে তৈরি হবে যেমন কৃষি পরিকাঠামো, তার পুরোটাকেই তো প্যাকেজের মধ্যে ধরা হচ্ছে, বা যে ঋণের ক্ষেত্রে সরকার সুদে ভরতুকি দেবে, যদি ব্যাঙ্ক ঋণ দিতে পারে, সেই ঋণের সুদে ভরতুকির অঙ্কটাই কেবল সরকারকে দিতে হবে। যেমন এমএসএমইকে ৩ লক্ষ কোটি টাকা ঋণের টপআপের কথা বলা হয়েছে। সেটাতো তারা নিতেও পারে নাও নিতে পারে। নিলেো সরকার কেবল ঋণ পরিসোধ সংক্রান্ত গ্যারান্টি দেবে ব্যাঙ্কগুলিকে। ফলে সরকারের কোনো খরচ নেই, কিন্তু সরকার পুরো ৩ লক্ষ টাকাই প্যাকেজে ঢুকিয়ে দিযেছে। এই সবভরতুকি বা ছাড় সংক্রান্ত হিসেব বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্নভাবে করেছে।

migrant

 

প্রশ্ন: মাইগ্রান্ট লেবার বা পরিযায়ী শ্রমিকদের অভাবনীয় কষ্ট পুরো লকডাউন জুড়ে দেখা যাচ্ছে, তারা ঘরে ফেরার পরেও কাজ থাকবে না। ওই শ্রমিকদের ব্যাপারে কোনো বিশেষ ব্যয় আছে?

হ্যাঁ আছে, তবে তা ওই শ্রমিকদের কতটা তাচ্ছিল্য করা হয় তার প্রমাণ। অর্থমন্ত্রী বলেছেন কত মাইগ্রান্ট শ্রমিক আছে সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। রাজ্যগুলি থেকে প্রাপ্ত হিসেব অনুসারে ৮ কোটি আছে। তাদের জন্য দুমাসের খাদ্য শস্য বরাদ্দ করা হয়েছে, যার জন্য আর্থিক বরাদ্দ ৩.৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে মাথাপিছু ২১৮ টাকা ৭৫ পয়সা।

এছাড়া, ওইসব শ্রমিকদের জন্য ভবিষ্যতে সস্তা ভাড়ায় বাস্থানের জন্য ভেবেছেন তিনি। যখন তাঁরা বাড়ি ফিরতে চাইছেন, তখন বাসস্থানের কথা ভাবা হচ্ছে যেখান থেকে তাঁরা চলে যেতে চাইছেন সেখানে।

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য পরিবহণের সুচারু বন্দোবস্ত করা যখন প্রয়োজনীয় তখন সরকার তাদের বাসস্থানের কথা বলছেন। ৮ কোটি শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে নিজেদের বাসস্থানে ফেরাতে যে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচা হত সেটি করতে কোনো উদ্যোগ নিতে সরকারকে দেখা গেল না।

প্রশ্ন: সরকারতো পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজ দেওযার জন্য ১০০ দিনের কাজে ৪০ হাজার কোটি টকা বরাদ্দ করেছে।

প্রথমত, মোদিজী নিজেই এমএনআরইজিএ বা ১০০ দিনের কাজকে চূড়ান্ত বিদ্রুপ করে বলেছিলেন যে, ওটা কংগ্রেস সরকারের ৬০ বছরের অপদার্থতার নজির, সেই হিসেবে তিনি ওই আইনকে রেখে দেবেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তার সরকার আরো অপদার্থ, কাজ দেওয়ার জন্য ওই এমএনআরইজিএর দ্বারস্থ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ১০০ দিনের কাজকে অবহেলা করার ফলেই গত কয়েক ভছরে গ্রাম থেকে অন্যত্র পরিযায়ী শ্রমিকদের যাওয়া বেড়েছে। মোদিজীর ১০০ দিনের কাজ সংক্রান্ত নীতিই পরিযায়ী শ্রমিকদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী। বলা যায়, বরাদ্দ বাড়িয়ে মোদি সরকার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছে।

poor

 

প্রশ্ন: যাই হোক না কেন, অর্থমন্ত্রী মহাত্মা গান্ধি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান আইন (এমএনআরইজিএ) মোতাবেক ১০০ দিনের কাজে ২০২০-২১ এর বাজেট বরাদ্দ ৬১ হাজার কোটি টাকা থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ১০১ লক্ষ কোটি টাকা করলেন, এর আগে তিনি দৈনিক মজুরি ১৮২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০২ টাকা করেছিলেন। এটা কি গ্রামে ফেরত যাওয়া মজুরদের রোজগার বাড়িয়ে তাঁদের সাহায্য করবে না?

আপাতভাবে এমনটাই মনে হয় যে, এই বর্ধিত বাজেট বরাদ্দ সরকারের বদান্যতা, তাঁরা গ্রামীণ গরিব ও পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা ভেবে এই বরাদ্দ বাড়ালেন, প্রায় ৬৫%। কিন্তু এমএনআরইজিএ কোনো প্রকল্প নয় যে, বাজেটে না থাকলে সরকার দিতে বাধ্য নয়। ১০০ দিনের কাজে সরকার চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে আইনত বাধ্য। যাদের জব কার্ড আছে তাঁরা কাজ করতে চাইলে তাঁদের ১০০ দিনের কাজ দিতে সরকার বাধ্য নতুবা তাদের বেকার ভাতা দিতে হবে। ফলে যদি ওই বরাদ্দ নাও বাড়াতেন তাহলেও বাজেট ছাপিয়ে যাওয়া টকা সরকারের দেওয়া বাধ্যতামূলক। এমনিতেই গত বছরে যত টাকা সরকার ১০০ দিনের কাজের জন্য দিতে বাধ্য হয়েছে, যা সংশোধিত বাজটে ছিল, তার তুলনায় ১০ হাজার টাকা কম বরাদ্দ করা হযেছিল। এর পরে সরকারের নিজস্ব বক্তব্য (যদিও তা ভুল বা মিথ্যে) অনুযায়ী ২০ টাকা করে দৈনিক মজুরি বাড়ানো হয়েছে ফলে  পূর্বতন বাজেট বরাদ্দে সৃষ্ট করা যেতে পারে এমন কর্মসংস্থান কমেছিল। সেই বাজেট বরাদ্দ ৪০ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো তেমন কোনো প্রভাব পরার মতো নয়।

সরকারের হিসেব অনুযায়ী দেখা যাক:

২০১৯-২০-র সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ ৭১ হাজার কোটি টাকা
১৮২ টাকা দৈনিক মজুরি হলে কাজের পরিমাণ = ৭১ হাজার কোটি/১৮২ = ৩৯০ কোটি দিন
১০০ দিন করে কাজ হলে  মোট শ্রমিকের সংখ্যা = ৩ কোটি ৯০ লক্ষ
অতিরিক্ত বরাদ্দ সমেত বর্তমান পরিমাণ = ১০১ হাজার কোটি/২০২ = ৫০০ কোটি দিন
১০০ দিন করে কাজ হলে  মোট শ্রমিকের সংখ্যা = ৫ কোটি ]
ফলে, অতিরিক্ত কর্মসংস্থান হবে ১ কোটি ১০ লক্ষ শ্রমিকের।
কিন্তু, অর্থমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী ৮ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারাচ্ছে।

(যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে, সমস্ত শ্রমিক ১০০ দিন কাজ পায় না। কিন্তু তাতো দিতে হবে, যখন কাজের অভাব। দ্বিতীয়ত ২৭ মার্চ অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে, ২০ টাকা করে মজুরি বাড়ানোর ফলে প্রত্যেক মজুর বছরে ২০০০ টাকা বাড়তি পাবেন। ফলে তিনি প্রতি মজুর ১০০ দিন কাজ করে এটাই বলেছিলেন।) ।

pad

 

প্রশ্ন: কৃষি পরিকাঠামোর জন্য ১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ, ২.৫ কোটি কিষাণ ক্রেডিট কার্ড বিতরণ করে ২ লক্ষ কোটি টাকা কৃষি ঋণ, চাষির পরিবহন খরচ ও মজুত খরচের অর্ধেক ভরতুকি এগুলি সবই তো কৃষিকে চাঙা করবে, তাছাড়া অত্যাবশ্যক পণ্য আইনকে সংশোধন করে চাল, গম, অন্যান্য দাম শস্য, তৈলবীজ, ভোজ্য তেল, ডাল, আলু, পিঁয়াজে মজুতকে বৈধ করা হল। এতে তো কৃষক বাজারে বেশি দাম পাবে।

কৃষি পণ্যের ন্যায্য দাম কৃষকের সুরাহা করার পক্ষে সব থেকে ভালো। কৃষি-উপকরণে ভরতুকি তুলনামূলকভাবে কমায় ও সারের দাম বাড়ে, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ চাষিরা পায় না, ফলে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেয়। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা সস্তায় উৎপাদন পরবর্তীতেই ফসল কম দামে মহাজদের বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। সরকার যদি না চাষিদের মাট থেকে ফসল সংগ্রহের বন্দোবস্ত করে তাহলে চাষির পক্সে যথোপযুক্ত দাম পাওযা সম্ভব নয়।  পরিবহণের ওই ভরতুকিও এখন ওই ফঁড়ে বা মিডলম্যানদের কাছেই পৌঁছবে। লকডাউনের ফলে খেতে ফসল রয়ে গেছে, ফঁড়েরা আরো কম দাম দিচ্ছে। সরকারের উচিত ছিল ফসল সংগ্রহে তৎপর হওয়া। তার বদলে ইঙ্গিত দিল যে, ফসল নিজ উদ্যোগে বহন করে গুদামজাত করা হোক সরকার ভর্তুকি দেবে। ভাগচাষিদের জমি নেই তাই তাঁরা কিষাণ ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার যোগ্য নয় কারণ তার জন্য জমির দলিল জমা রাখতে হয়। এমনিতেও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা জমির দলিল হাতছড়া করতে চায় না। এই মুহূর্তে গ্রামে মানুষের কাছে অর্ত নেই। সেই অর্থ সরবরাহ করে চাহিদা তৈরির দরকার ছিল। সে ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী কোনো আগ্রহই দেখালেন না।

অত্যাবশ্যক পণ্য আইনকে সংশোধনতো বৃহৎ চাষি ও ব্যবসায়ীদের সুবিধে করবে। শুনেতো মনে হচ্ছে মোদিজী তার স্যাঙাত আদানি ও রামদেবকে কৃষিপণ্যের ব্যবসায়ে আরো বেশি করে লাভ করতে দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা  করল। ওই আইন সংশোধনের পরে কৃষিপণ্যের বাজারকে অবাধ করা হবে। পণ্য সংগ্রহে সরকারের ভূমিকা আস্তে আস্তে পুরোপুরি উঠে যাবে। ফলে ফাটকা বাড়বে। তাছাড়া, কৃষকরা যাতে আগাম চুক্তির ভিত্তিতে পণ্য বিক্রি করে দিতে পারে তার বন্দোবস্তও করা হচ্ছে। অবশ্যম্ভাবীভাবে দাদনপ্রথা চালু হবে। যার ফলে মারাত্মক হতে পারে।

প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সম্পদ যোজনায় পরিকাঠামো উন্নয়ন, পশুপালন, মৌমাছি পালনে উৎসাহ এসব তো উত্তম প্রস্তাব।

এগুলি হলে ভালোই। কিন্তু এগুলিতো এক্ষুণি হচ্ছে না। এই প্রস্তাবও প্রকল্পগুলিতো বাজেটের সময় নেওয়া হয়। এখন তো কোভিড ১৯-এর ফলে যে জরুরি বন্দোবস্ত করা দরকার সে বিষয়ে অর্থদানের কথা ছিল।

প্রশ্ন: ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগকে যে ৩ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার তহবিল প্রদান করা হবে তাতে তো বিপদে পড়া ক্ষেত্রটি চাঙা হবে

মূলত ওই ক্ষেত্রকে তাদের বর্তমান ঋণের টপ আপ হিসেবে ৩ লক্ষ কোটি টাকা কোনো বনন্ধক ছাড়া দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। সরকার সেই ঋণের গ্যারান্টি দেবে। কিন্তু সেই সংস্থাগুলি ঋণ নেবে কেন? উৎপাদনের জন্য তো? কিন্তু বাজারে চাহিদা কোথায় যে তাঁরা উৎপাদনে আগ্রহী হবে? আমেরিকায় যেমন ধরণের সংস্থাগুলিকে কর্মীদের কাজে রেখে দেওয়ার শর্তে অর্থ দেওয়া হয়েছে তেমন যদি তাদের টাকা দেওযা হত (ঋণ নয়) তাহলে তা বাজারে চাহিদা তৈরি করত। তাছাড়া, সংস্থাগুলি সরকার ও সরকারি উদ্যোগের কাছে ৫ লক্ষ কোটি টাকা পায় সরবরাহ করা পণ্যের মূল্য হিসেবে। সেই টাকা মিটিয়ে দিলেই সংস্থাগুলির সুরাহা হয়।

kol

 

প্রশ্ন: কোভিড-১৯ এর সময়ে প্রতিরক্ষা শিল্পে ৭৪% বিদেশি বিনিয়োগ বা সমস্ত শিল্পক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করে দেওযা, কয়লার ব্লক বণ্টন করে কয়লা ব্যবসায়ে উৎসাহ প্রদান এগুলি কি কোভিডএর বিরুদ্ধে ভারতের লড়াইকে সাহায্য করবে?

আত্মনির্ভর ভারতে প্রতিরক্ষা শিল্পে ৭৪% বিদেশি বিনিয়োগ, শুনলে কেমন লাগছে? বিদেশীরা তাঁদের প্রতিরক্ষার বা অস্ত্রশস্ত্রের উন্নততম প্রযুক্তি আমাদের দিয়ে দেবে? খোঁজ নিয়ে দেখুন যে আধুনিক রাফাল কেনা নিয়ে এত অহঙ্কার, তার থেকে উন্নত বিমান ওই ফ্রান্সের কাছে হয়তো বা দাসাউই তৈরি করেছে। ৭৪% বিদেশি বিনিয়োগের ফলে আমরা নির্গাত প্রতিরক্ষায় আমাদের স্বাতন্ত্র্য হারাব।  শিল্পক্ষেত্রকে পুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে দেওযার এজেন্ডাটিকে কোভিড ১৯-এর সময়কার সামাজিক দুর্বলতার সময়ে ঘোষণা করে দেওয়া হল। বিবেকবানরা অসুস্থ বা অসহায় অবস্থায় শত্রুকেও আঘাত করে না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের উদাহরণ স্মরণ করুন। কিন্তু চতুর ও বিবেকহীনরা উল্টোটাই করে। কর্ণকে হত্যার ঘটনাকে ভাবুন। এটাও তেমনি, যখন শ্রমিক কৃষক বামপন্থীরাও ঘরবন্দি বা কোভিডের ভয়াবহতার সঙ্গে লড়ছে তখন মোদিজী দেশেের পুঁজিপতিদের জন্য কাজ করে চলেছেন। শ্রম আইনকে লাঘব করে শ্রমিকদের উপর অত্যাচার নামানো হচ্ছে।

প্রশ্ন: কোভিড-১৯ তো একটি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দুর্ঘটনা, স্বাস্থ্যে কতটা বিনিয়োগের কথা এই প্যাকেজে বলা হয়এছে?

স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের গ্যাপ পূরণের জন্য ৮, ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ রাজ্য সরকার বা বেসরকারী সংস্থার বিনিয়োগের ঘাটতি পূরণের জন্য ওই টাকা দেওযা হবে। ফলে মাথাপিছু মাত্র ৬০ টাকার মতো বরাদ্দ। এছাড়া প্রত্যেক জেলা হাসপাতালে সংক্রামক রোগ চিকিৎসা বিভাগ খোলা হবে।

প্রশ্ন: অন্য সকল দেশ কীরকম খরচ করেছে?

রাজকোষ থেকে জিডিপির ১৪.৩% ইতিমধ্যেই খরচ করেছে কর্মসংস্থান বজায় রাখার জন্য বা সরাসরি খরচ করার জন্য দিয়ে।মানিটারি নীতিতে ফেড সুদের হার কমিয়ে ০.২৫%-এ নিয়ে গেছে। ঋণের সুবিধে দিয়েছে। তবে তাকে কোনো জিডিপর হিসেবে বা প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত করছে না।

চীন জিডিপির ২.৫% রাজকোষ থেকে বরাদ্দ করেছে, মনিটারি নীতি দ্বারা ঋণ সুবিধেকেও প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত করেছে যার পরিমাণ জিডিপির ৪.৯%। সুদের হারেও ১.৫% পর্যন্ত ছাটাই করেছে।

জাপান জিডিপির ২১.১% খরচ করেছে, যার মধ্যে ১৬% কর্মসংস্থান ও ব্যবসায়কে সুরক্ষিত রাখার জন্য। এছাড়া মনিটারি নীতি অনুসরণ করে ছোট ব্বসায়কে ঋণ সুবিধের গুচ্ছ দিয়েছে যা প্যাকেজের অংশ বলে ধরছে না।

জার্মানি জিডিপির ৪.৯% কর্মসংস্থান বজায় রাখার জন্য ও স্বল্পকালিন কর্ম সংস্থানের জন্য খরচ করেছে। এছাড়া ঋণ গ্যারান্টি দিয়েচে যেমন বারত দিয়েছে। কিন্তু সেগুলি খরচ নয়। মনিটারি নীতিও আছে।

প্রশ্ন: সামগ্রিকে এই আত্মনির্ভর ভারত অভিযান প্যাকেজকে কীভাবে দেখা যেতে পারে?

শ্রমিক কৃষক শোষণকারি আত্মপ্রচারক মোদিজীর স্যাঙাত পুঁজিপতিদের মুনাফার জন্য বিদেশী পুঁজি ও প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল ভারত গড়ে তোলার প্যাকেজ।

-- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-27