এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছে ইন্ডিয়া আর ভারত। ইন্ডিয়ার জনসাধারণ সবাইকে মুখ বেঁধে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর নিরন্ন ভারতের অনশনক্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়ে, সহায় সম্বল আশ্রয় হারিয়ে শতশত মাইল পদব্রজে অতিক্রম করতে পথে নেমেছেন নিজেদের ঘরে ফেরার আশায়। মরলে সেখানেই শান্তিতে মরবেন, স্বভূমিতে স্বজনের উপস্থিতিতে মরবেন। পথে তাঁরা তৃষ্ণার্ত হয়েছেন, ক্ষুধার্ত হয়েছেন। অবুঝ শিশুরা কাঁদছে ক্ষুধার তাড়নায়। কখনো পথে কেউ সহৃদয় হয়ে একটু জল দিয়েছন, খাবার দিয়েছেন। তারপর আবার তাঁদের পথচলা। এই পথেই বারবার জুটেছে পুলিশের মার। তাঁরা রক্তাক্ত হয়েছেন, যন্ত্রণাতুর হয়েছেন। তাঁদের সেই সকরুণ আর্তনাদে পুলিশের হৃদয় করুণার্দ্র হয়নি, রাষ্ট্রযন্ত্রের টনক নড়েনি। এমন দৃশ্য মাসকয়েক আগেও ছিল চিন্তাভাবনার অতীত। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর এই প্রথম মানুষ এইভাবে আশ্রয়চ্যুত হয়ে, কর্মচ্যুত হয়ে, ঘরে ফেরার জন্যে কাতর হয়ে পথে নেমেছেন। তাঁদের ছায়ায় আসন্ন দুর্ভিক্ষের গন্ধ। আসন্ন এক অসহায় ভারতের ছবি।
এই অসহায় মানুষগুলোই হচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবার, যাঁরা ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যেই অন্য রাজ্যে, বিদেশ বিভূঁইয়ে, গিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে। সেখানে যে যার মতো কাজে লিপ্ত হয়ে দিনাতিপাত করছিলেন। গত মার্চ মাসের চব্বিশ তারিখে সহসা পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই সারাদেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় তাঁদের বর্তমান বিপন্ন, ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে।
সাড়ে আঠাশ কোটি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ভারতের সর্বত্র ব্যাপৃত এই লংমার্চের রাস্তা থেকে যদি পাড়ায়, এলাকায়, সন্নিহিত অঞ্চলে চোখ ফেরানো যায় তাহলে দেখা যাবে এই চিত্রই একটু অন্যরকমভাবে আমাদের আশপাশে সচল রয়েছে। বাড়ির কাজের মাসি-বোনেদের এই করোনাক্রান্ত সময়ে কাজে আসা নিষেধ। তাঁরা গালে হাত দিয়ে অসহায়ভাবে অশ্রুপাত করছেন। যাঁরা রাস্তার ভিখিরি, ভিক্ষে করে দিন গুজরান করে থাকেন, তাঁরা এখন অসহায়। ভিক্ষা মিলছে না। তাঁরা পথে বেরোতে পারছেন না। যাঁরা ট্রেনে-বাসে হকারি করে দিনযাপন করেন, তাঁদের এখন কাজ নেই। বাড়ির মিস্ত্রির এখন কাজ নেই। ছোট দোকানদার দোকান খুললেই পুলিশের মার জুটছে। বাজারে ভিড় এড়াবার একমাত্র সহজ পদ্ধতি হিসেবে বাজার সিল করে দেওয়া হয়েছে। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্যে বেরিয়ে পুলিশের লাঠির শিকার হচ্ছেন। একদিকে করোনাজনিত লকডাউনের সৃষ্ট সন্ত্রাস, অপরদিকে মূর্তিমান যমসদৃশ পুলিশি সন্ত্রাস।
মূলত এই ঘটমান বর্তমানের প্রেক্ষাপটেই শিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত তাঁর সংবেদনশীল মানসিকতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তাঁর বাহান্ন পৃষ্ঠার কৃশকায় গ্রন্থ নিরন্ন কর্মহীন –এর পৃষ্ঠায়। এই করোনাক্রান্ত, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি নিনাদিত তমসাকীর্ণ সময়ে শিল্পী তাঁর প্রথাগত দৃষ্টিনন্দিত ভুবন থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকিয়েছেন এইসব আশপাশের কর্মহীন অসহায় মানুষগুলোর প্রতি। তাঁর হৃদয়ে এই চিত্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি এই সময়কে অবশ্য এক ‘অসুখ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, এখন মানুষের কর্মহীনতা এবং গৃহবন্দিত্ব আসলে একটা অসুখ। একে নিছক অসুখ বলে মান্যতা দিলে তো এর জন্যে কারও বিন্দুমাত্র দায়দায়িত্বের অস্বীকরণ প্রতিষ্ঠা পায়। সঠিক সময়ে বিপন্নের সঠিক সাহায্যপ্রাপ্তির অধিকারও অস্বীকৃত হয়ে যায়। রাষ্ট্রের নির্বিবেক ভূমিকা, নিয়োগকর্তার অমানবিকতা কোনও অপরাধ বলে আর গণ্য হয়না।
তবে শিল্পী কৃষ্ণজিৎ স্বীকার করেছেন : তিনি এতকাল ‘অনায়াস উপেক্ষায়’ এইসব মানুষজন থেকে তাঁর চোখ সরিয়ে রেখেছিলেন, ‘এইবার নিরন্ন কর্মহীন মানুষের মুখ’ তাঁর স্কেচের খাতায় এসে ভিড় করেছে, তবে তাঁদের মুখে কোনও ‘মাস্ক’ নেই। কারণ তিনি মনে করেন মাস্কের ‘শাক দিয়ে আতঙ্কের মাছ’ ঢেকে রাখা এক অসম্ভবের শিল্পচর্চা। এইখানেই শিল্পীর বিদ্রোহ, শিল্পীর নবজন্ম ।
এই গ্রন্থ জুড়ে তাঁর স্কেচের ভুবনে ভিড় করেছে রাজমিস্ত্রি, রিকশাঅলা, ভ্যানচালক, নাপিত, ছুতোর, বাড়ির কাজের মাসি, হকার প্রমুখের অসহায়, আতঙ্কগ্রস্ত মুখ। কবিবন্ধু বিপুল চক্রবর্তী একবার তাঁর এক ছোট্ট একটি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘মুখোশের আড়ালে নয়, তোর মুখ দেখতে চাই পোড়ামুখী’। এখানে শিল্পী কৃষ্ণজিৎ-ও মুখোশের আড়াল থেকে নয়, সরাসরি সেইসব ক্লীন্ন, অসহায়, আতঙ্কগ্রস্ত মুখগুলো দেখতে এবং দেখাতে চেয়েছেন। তিনি আরও একটি কথা অকপটে জানিয়েছেন, তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ করা সেইসব বিপন্ন মানুষগুলোর মুখচ্ছবি ‘হুবহু’ আঁকেননি, তবে বোঝাই যাবে তিনি কাদের মুখ আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। এই করোনাবিধ্বস্ত, আতঙ্কগ্রস্ত, অসহায় কর্মহীন মানুষগুলোর অঙ্কিত মুখগুলর বলিরেখায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে এই কালবেলার তাঁদের প্রকৃত মুখের আদল।
শিল্পীকে অভিনন্দন। এই প্রপীড়িত মানবাত্মার প্রতি তাঁর সশ্রদ্ধ নতচিত্ততার জন্যে তিনি অবশ্যই পাঠকের শ্রদ্ধা এবং সমীহ আদায় করে নেবেন।
কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত : নিরন্ন কর্মহীন। উদ্ভাস। বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ। প্রথম ডিজিটাল সংস্করণ, এপ্রিল ২০২০। বিনিময় : আশি টাকা