মার্ক্সের ২০২ তম জন্মবার্ষিকী
marx

মার্ক্স ছিলেন আপাদমস্তক একজন বিপ্লবী বাস্তববাদী। তাঁর এই বাস্তববাদের মূলে রয়েছে বস্তু, এবং গতিময়তা হল বস্তুর অস্তিত্বের রূপ। সামাজিক বাস্তবতার উপর দৃঢ় ভিত্তি করে মার্ক্স দাঁড়িয়ে, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতাকে স্বীকার করা মানে যথাস্থিতিকে মেনে নেওয়া নয়, বরং সেই বাস্তবতাকে বদলে দেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সবরকমের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের সংগ্রাম। তাঁর ২০২তম জন্মবার্ষিকীর সময়কালে, চারিদিক যখন থমকে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়, যখন প্রায় গোটা দুনিয়া লকডাউন মোডে চলে গেছে, যখন দূরত্ব বজায় রাখাই আচার হয়ে উঠেছে আর অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাভাবিক রূপ হয়ে উঠেছে ডিজিটাল, তখন মার্ক্সকে আমরা কীভাবে স্মরণ করতে পারি?

মার্ক্সের কাছ থেকেই ইঙ্গিত নিয়ে আসুন আমরা জীবনের বাস্তব অবস্থার উপর, পরিবর্তনশীল বাস্তব পরিস্থিতির উপর নজর কেন্দ্রীভূত করি। এই বাস্তবতা মোটেই একপেশে নয় বরং বহুমাত্রিক, সোজা-সাপটা নয় বরং জটিল। আপাত স্তব্ধতার বাহ্যিক আবরণ ভেদ করে আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে পরস্থিতির অন্তর্নিহিত গতিধারার উপর। আর এই গতি সরলরৈখিক নয়, বরং বহুমুখী টানাপোড়েন ও ঘাত প্রতিঘাতের নীট যোগ।

বিশ্বব্যাপী মহামারির চিকিৎসা সংক্রান্ত দিকটির চর্চা আমরা জীবানুবিদ ও মহামারী বিশারদদের জন্য ছেড়ে রাখছি। আমরা মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করব সামাজিক বাস্তবতার দিকটিতে। যেহেতু এই মড়ক সারা বিশ্বে ব্যাপ্ত তাই আমরা বরং মহামারীর এই প্রাদুর্ভাবকালে বিশ্বজোড়া পুঁজিবাদী বাস্তবতাকেই নজরে রাখি। প্রথমেই যা আমাদের সামনে প্রকট চেহারায় হাজির হয় তা হল বিশ্বায়নের সঞ্চারপথের সাথে ভাইরাসের সংক্রমণপথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ভাইরাসটি বিশ্ব অর্থনীতির পাওয়ার হাউস চীন দেশে প্রথম দেখা দিল ও দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত বিশটি দেশের প্রায় সকলেই জি-২০ ভুক্ত দেশ। আর এই দেশগুলির মধ্যেও বিশেষভাবে বিপর্যস্ত এলাকাগুলির দিকে তাকালে দেখা যাবে কোনো স্থানের বৈশ্বিক সংযোগের মাত্রা তথা পুঁজির সঞ্চয়নের মাত্রার সাথে ঐ স্থানের বিপর্যয়ের গভীরতা প্রায় সমানুপাতিক। আমাদের অবশ্য স্পষ্ট ভাবে বুঝে নিতে হবে যে এই ধাক্কা ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ভেতরে এবং বিশ্বজুড়ে বর্তমানে বিদ্যমান অসাম্যকেই অবশেষে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

মানুষের জীবনের প্রয়োজন আর কর্পোরেটদের লালসার মধ্যে মৌলিক সংঘাতকে বর্তমান সংকট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। প্রায় সমস্ত পুঁজিবাদী দেশেই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবার মুনাফার স্বার্থে সুপরিকল্পিতভাবে বড় বড় ঔষধ কোম্পানি, বিপুলাকার বীমা সংস্থা ও বেসরকারী হাসপাতালের আঁতাতের অধীনস্থ করে ফেলা হয়েছে। কর্পোরেট উন্নয়ন মডেলে প্রকৃতি পরিবেশের অবনমন ও জলবায়ু পরিবর্তনও বিপদসীমা ছাপিয়ে অস্থির মাত্রায় পৌঁছে গেছে।

জানুয়ারীর শেষ দিকে যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত জরুরি সতর্কতা জারি করল, যখন পর্যন্ত চীনের বাইরে আর কোথাও কোনও মৃত্যুর খবরও সামনে আসেনি, তখন পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ বাদে আর কোনও দেশ তেমন পাত্তাই দেয়নি। অনেক পরে তাদের ঘুম ভাঙল। আর অনেক দেরীতে তারা চীনের কায়দায় লকডাউনের পথ বেছে নিল। কিন্তু তা নেওয়া হল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় ও অনেক কম দক্ষতার সাথে। এই প্রক্রিয়ায় অর্থনীতি ব্যাপক ধাক্কা খেয়েছে। এরকম ধাক্কা বোধহয় আমরা আগে কখনই দেখিনি, অন্ততপক্ষে এই মাত্রায় ও এতটা লম্বা সময় জুড়ে।

marx png

 

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বহুবিধ পণ্যের ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ও বিক্রয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। লকডাউন এই বুনিয়াদী প্রক্রিয়াকেই ব্যাহত করেছে। পরিষেবা শিল্পের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ও শিক্ষার মতো কিছু ক্ষেত্রের কাজকর্ম ‘বাড়িতে বসে কাজ’ হিসেবে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন বা বিমান চলাচল কার্যত স্তব্ধ। সর্বত্রই কর্মী ছাঁটাই ও মজুরি ছাঁটাই ইতিমধ্যেই ঘোষিত হতে শুরু করেছে। এখান থেকে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করাটা মোটেই সহজ হবে না এবং রীতিমতো এক উথাল-পাথাল বা আলোড়নের মধ্য দিয়েই আমাদের যেতে হবে।

আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এক বহুস্তরীয় জটিল দানব যার মূলে রয়েছে তার নিপীড়নকারী কেন্দ্র, কিন্তু সেই নিপীড়নকারী যন্ত্রের উপর চাপানো থাকে রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক প্রণালী এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকের বহুমাত্রিক আন্তঃসম্পর্ক। কিন্তু এই মহামারী ও তার প্রশাসনিক পরিপূরক হিসেবে এই লকডাউন আবার একবার রাষ্ট্রের বুনিয়াদী চরিত্রকে প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে। প্রশাসন, সুরক্ষা প্রদান ও সুশাসনের প্রশ্নে কোনো রকম তৎপরতা প্রদর্শনের বদলে কেবল নিপীড়ন ও নজরদারির হাতিয়ার হিসেবেই রাষ্ট্র আজ আমাদের সামনে উপস্থিত।

আজ জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা ও বিশৃঙ্খলা চরম আকার নিয়েছে। এই মাত্রার সংকট ধর্মীয় বিশ্বাস এমনকি বিভিন্ন কুসংস্কার ও বুজরুকি চিন্তা অনেকটা বাড়িয়ে তুলেছে। যুক্তিব্যাখ্যা ও অনুসন্ধিৎসায় অভ্যস্ত আধুনিক মননের কাছে এই পরিস্থিতি বেদনাদায়ী, কিন্তু মার্ক্স ধর্ম সম্পর্কে আমাদের যা বলেছিলেন তা এখানে স্মরণে আনা দরকার : “ধর্মীয় কৃচ্ছসাধন হল একাধারে বাস্তব দুর্দশার প্রকাশ ও সেই দুর্দশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ধর্ম হল নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন দুনিয়ার হৃদয়, আত্মহীন অবস্থার আশ্রয়”। এত নৃশংসতা আর বিশৃঙ্খলার মাঝে এই হৃদয়হীন দুনিয়ায় সামান্য সান্তনার আশ্রয় খুঁজতে ধর্মকে আঁকড়ে ধরা দেখে আমাদের তো অবাক হওয়ার কিছু নেই।

মার্ক্স থেকে সাহায্য নিয়ে ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকা এই বিশ্ব-সংকটকে আমাদের বুঝতে হবে, আর অবশ্যই বিশেষ নজর দিতে হবে ভারতের বুকে আমাদের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার উপর। মোদী সরকার ও সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী তাদের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট এজেণ্ডা আগ্রাসীভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ফ্যাসিস্ট প্রকল্পকে ত্বরান্বিত করতে ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় করতে এই সংকটকে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওরা। নাগরিকত্বের ধারণাকে নতুন করে নির্মাণ করতে শুরু করেছে তারা, যেখানে অধিকারসম্পন্ন নাগরিককে অনুগত প্রজায় পর্যবসিত করা হচ্ছে। ওদের জাতীয়তাবাদী ছক অনুযায়ী সমগ্র সমাজকে যূথবদ্ধ করার নয়া মওকা হিসেবে এই স্বাস্থ্য সংকটকে কাজে লাগাতে চাইছে ওরা।

করোনা ভাইরাসকে ওদের সাম্প্রদায়িক ছকের সাথে সেট করে দেওয়ার কোনও সুযোগ ওরা হাতছাড়া করছে না। স্যাঙাতি মিডিয়ার সহযোগিতায় তারা যাবতীয় দায় চাপিয়ে দিয়েছে চীন আর তবলিগি জামাতের ঘাড়ে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাকে যখন সতর্কতার প্রধান রূপ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে তখন ওরা তাকে বদলে দিয়েছে অস্পৃশ্যতা ও সামাজিক বহিষ্কার চাপিয়ে দেওয়ার হাতিয়ারে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুব্যবস্থিত সামাজিক ও আর্থিক বয়কটের সূচনা ঘটিয়েছে এবং এখন তো আমরা কোভিড-১৯ সংকটকে ঘিরে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক ভাইরাস, তীব্র ইসলাম-বিদ্বেষ ও সামাজিক অস্পৃশ্যতার রমরমা দেখতে পাচ্ছি।

marx2

 

লকডাউন তো সব স্বৈরাচারিরই স্বপ্নের পথ। এবং মোদি সরকার দুহাত দিয়ে সেই স্বপ্নকে লুফে নিয়েছে।  লকডাউনের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে সরকার তাকে ব্যবহার করেছে ক্ষমতা ও সমস্ত সংসাধন আরও বেশি কেন্দ্রীকরণ করতে (পিএম কেয়ার্স যার একটি নির্লজ্জ উদাহরণ), নজরদারি বাড়াতে (আরোগ্য সেতু অ্যাপকে ক্রমশ বাধ্যতামূলক করে), গণতন্ত্রকে সংকুচিত করতে (পুলিশ ও আমলাতন্ত্র সবকিছু নির্ধারণ করে দিচ্ছে, বিরোধী দল সমূহ, গণ সংগঠনগুলি, নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলি, বিশেষজ্ঞগণ বা বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি - সকলকেই একদম প্রান্তে ঠেলে দেয়া হয়েছে এবং প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবি, শিক্ষাবিদ বা আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে কদর্য দমন অভিযান চালান হচ্ছে) এবং মোদি-ভক্তিকে আরও বেশি ছড়িয়ে দিতে (মোদিকে সমস্ত দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে এক ত্রাতা হিসেবে স্থাপন করা হচ্ছে)।

কিন্তু ইতিহাস আমাদের বলে যে স্বৈরাচারী ও সম্রাটেরা চিরদিন রাজ করে না এবং জনগণই শেষ কথা বলে। মোদী জমানা কোভিড-১৯ মহামারি ও চলমান লকডাউনকে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করার যতই চেষ্টা চালাক না কেন, সরকারের সমস্ত ব্যর্থতা, অবিচার, নৃশংসতা এবং রাষ্ট্র ও এই ব্যবস্থার নিপীড়ক শ্রেণী চরিত্র এখনকার মত এত সুস্পষ্ট রূপে আগে বোধহয় কখনও উন্মোচিত হয়নি। লকডাউন সৃষ্ট সামাজিক সংকটের বিস্ফোরক চেহারা ভারতকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। পরিযায়ি শ্রমিক ও ক্ষুধার্ত মানুষ আজকের সংকটের সবচেয়ে মূর্ত সামাজিক প্রতিচ্ছবি। সরকার দাবি করছে জনতাকে বাঁচাতে নাকি সে অর্থনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করে নিয়েছে, অথচ আসল সত্য হল, করোনা ভাইরাস থেকে ছাড় পেলেও কর্মহীন নিঃসম্বল অসহায় ব্যাপক মানুষ আজ আর্থিক কারণেই চূড়ান্ত বিপদের মুখোমুখি।

মার্ক্স বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করতেন সেই বাস্তবতার সাথে আরও ভালোভাবে যুঝতে, তাকে বৈধতা দানের জন্য নয়,  বরং সর্বদাই তার পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে। তিনি সব সময় বৈপ্লবিক ধ্যানধারণা ও বিপ্লবী উদ্যোগ ছড়িয়ে দেওয়ার এবং সম্মিলিত সক্রিয়তা শক্তিশালী করার পথ খুঁজেছেন। আজ বিশ্ব পুঁজিবাদ যখন অভূতপূর্ব সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে এবং মোদী সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা ও বিশ্বাসঘাতকতা যখন উত্তরোত্তর স্পষ্ট হয়ে উঠছে তখন আমাদের বিপ্লবী মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এই ঘনীভূত সংকট ও বিকাশমান বাস্তবতাকে যুঝতে হবে।

কোভিড-১৯ এক নিদারুণ ভাঙ্গনের মুহূর্ত। বিশ্ব পুঁজিবাদ আর পুরনো পথে চলতে পারবে না। ভারতেও পুরনো নীতিপদ্ধতিগুলি আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় বেশি উন্মোচিত। এখনই সময় গতিপথ পাল্টানোর লক্ষ্যে উদ্যোগ বাড়ানোর, জনস্বাস্থ্য, গণবন্টন ও গণপরিবহন ব্যবস্থাকে প্রকৃত অর্থেই গণ ও সার্বিক করতে লড়াই গড়ে তোলার। এই লকডাউনের মাঝেও আমরা ‘বাড়িতে থাকুন’-কে ‘বাড়িতে থেকে কাজ করুন, বাড়িতে থেকে প্রতিবাদ গড়ুন’-এ বদলে দিয়েছি। আমরা শারীরিক দূরত্বকে সংযুক্ত করেছি সামাজিক সহমর্মিতা ও সংহতির সাথে। সংকটের সুযোগে মোদি সরকার আমাদের যৌথ সম্পদ ও অধিকারগুলি কেড়ে নিতে চাইছে। আমরা তা করতে দেব না। ওদের ফ্যাসিবাদী ছককে রুখে দিতে পাল্টা লড়াই গড়ে তুলব, এগিয়ে যাব মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক পরিবর্তনের পথে।

– দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
সাধারণ সম্পাদক
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন

খণ্ড-27