মারণ রোগ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার খবর এসেছিল ২০১৮ সালেই। একটানা চিকিৎসা চলেছিল লন্ডনে। তারপর আবার ফেরেন অভিনয় জগতে। করোনা সংক্রমণে গোটা দেশে লকডাউন ঘোষণার সময় সিনেমা হলে চলছিল তাঁর অভিনীত কামব্যাক ফিল্ম আংরেজি মিডিয়াম। কিন্তু লকডাউন চলতে চলতেই আবারো অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। ভর্তি হলেন হাসপাতালে। আর কামব্যাক করা সম্ভব হল না। ২৯ এপ্রিল সকালেই চলে গেলেন নিতান্ত অল্পবয়সে। তাঁর প্রয়াণে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে হাহাকার ও শোকের ছাপ, সেটাই বলে দেয় অভিনয় দিয়ে কীভাবে মানুষের মন জিতে নিয়েছিলেন তিনি।
মনে করা যাক ইরফান অভিনীত পিকু ছবির রানা চরিত্রটিকে। অমিতাভ বচ্চন বা দীপিকা পাডুকনের মতো স্টার কাস্টদের পাশেও কি অসম্ভব উজ্জ্বল ইরফান। কথা রাখতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন, কিন্তু তার মধ্যেই হাল্কা আড়চোখে মজার চোখে দেখতে চাইছেন পরিস্থিতিটা। ছোট্ট ছোট্ট মোচড়ে, অল্প কথায় বা নীরব চাহনিতে, মুখভঙ্গীতে অভিনয়কে কোন উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাওয়া যায় – ইরফান ছিলেন তার আদর্শ উদাহরণ। ইরফান খান এর অভিনয়ের মধ্যে আদ্যন্ত পাওয়া যায় একটা অসামান্য সেন্স অফ হিউমার, পিকু সিনেমার রানা চরিত্রটির রূপদানে এর প্রমাণ দর্শক পাবেন।
ইরফান খানের অসামান্য অভিনয়ের কথা বলতে শুরু করলেই চলে আসে লাঞ্চ বক্স সিনেমাটির কথা। ঘটনার জাল এড়িয়ে সামান্য উপাদান দিয়ে টানটান সিনেমটিক এক্সপেরিয়েন্স কীভাবে তৈরি করতে হয়, এটি তার একটি দৃষ্টান্ত। মুম্বাইয়ের এক সরকারী অফিসে মধ্যবয়সী বিপত্নীক ইরফান কাজ করেন। ভুলক্রমে তার নিজের লাঞ্চবক্সের বদলে অন্য একটি লাঞ্চবক্স তাকে দিয়ে যায় ডাব্বাওয়ালা। তারপর রোজই চলতে থাকে এই ভুল। কোথা থেকে আসছে লাঞ্চবক্স একটি চিরকুট পাঠিয়ে তাও জানা হয়ে যায়। যে গৃহিণীর তৈরি খাবার এসে পৌঁছতে থাকে তার সাথে চিরকূট বিনিময় চলতে থাকে। ছোট ছোট চিরকুট আর খাবারের সুঘ্রাণ মিলেমিশে তৈরি হয় এক অস্পষ্ট সম্পর্করেখা। তা ভালোবাসা নাকি চল্লিশোর্ধ বিপত্নীক আর ত্রিশের কোঠার একলা গৃহবধূর একাকিত্ব কাটানোর মরীয়া চেষ্টা – আমরা তা জানতে পারি না। তবে এটা জেনে যাই ইরফানের অভিনয় দক্ষতা কোন তুঙ্গ শিখর স্পর্শ করতে সক্ষম।
নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয়ের সময়েও ইরফান ছিলেন অসামান্য। মকবুল সিনেমাটির কথা এই প্রসঙ্গে মনে করা যায়। অথবা দ্য গ্রেট মারাঠায় নাজিবউদ্দৌল্লার চরিত্রে ইরফানের অভিনয়। ক্রুর বাচনভঙ্গী কোথায় নিয়ে যেতে পারে অভিনয়কে, ইরফান এখানে তার প্রমাণ রেখেছেন।
চরিত্রকে বুঝে ফেলা ও তার মর্মস্থলটিকে অভিনয়ে নিয়ে আসার দক্ষতা ইরফান দেখিয়েছিলেন একেবারে অভিনয় জীবনের প্রথম পর্ব ভারত এক খোঁজ-এ অভিনয়ের সময়েই। চাণক্য চরিত্রের রূপায়ণে বা চন্দ্রকান্ত সিরিয়ালে তাঁর অসামান্য অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিল দর্শক। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ইরফান দূরদর্শনের জন্য তোলা বেশ কিছু নাটকেও অভিনয় করেছিলেন। ন্যাশানাল স্কুল অব ড্রামাতে অভিনয় শিখে আসা ইরফানের এই ধরনের অভিনয়ে দক্ষতা স্বাভাবিকভাবেই ছিল অনায়াস। এখানে যেগুলিতে তিনি অভিনয় করেন তার মধ্যে একটি ছিল ‘লাল ঘাস পর নীল ঘোড়ে’। এখানে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ভূমিকায় অভিনয় করে ছিলেন ইরফান।
সালাম বোম্বেতে একটি ছোট ভূমিকায় অভিনয় করলেও সেটি পরে আর সিনেমায় ব্যবহার করেন নি পরিচালক। তাই বিশ শতকের গোড়ায়, ২০০১ সালে রাজস্থান আর হিমালয়ের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ব্রিটেন প্রবাসী ভারতীয় পরিচালক আসিফ কাপাডিয়ার The Warrior ছবিটি দিয়েই সিনেমা জগতে ইরফানের পথ চলার সূত্রপাত বলা যায়। তবে ২০০৪ সালে শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ অবলম্বনে নির্মিত মকবুল চরিত্রের নাম ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় থেকেই ভিন্ন ঘরানার অভিনেতা হিসেবে তিনি সাধারণ দর্শক ও ফিল্ম ক্রিটিক – উভয় গোত্রের মন একসাথে জয় করে নেন। ২০০৮ এ আলোড়ন তোলা স্লামডগ মিলিওনেয়ার ছবিতে পুলিশ ইনসপেক্টর চরিত্রে তাঁর অসামান্য অভিনয় দর্শক ভুলবেন না।
একইসঙ্গে শিল্প সম্মত ছবির স্বীকৃতি ও বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছে ইরফানের ছবিগুলি – এটা একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যাপার।
বলিউডের পাশাপাশি ইংরাজি ছবির ভিন্ন ঘরানাতে অভিনয় করেও তিনি অত্যন্ত সফল হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে মনে করা যায় তাঁর টোকিও ট্রায়াল ছবিটির কথা। বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল চরিত্রে এখানে অসামান্য অভিনয় করেন ইরফান। এখানে তাঁর অসামান্য অভিনয় দক্ষতা এখনো আন্তর্জাতিক স্তরে চর্চিত হয়।
অনেক সিনেমাতেই তিনি মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন, কোথাও বা পার্শ্ব চরিত্রে। প্রথাগত নায়কের ভূমিকায় সেভাবে নামেননি। মূলত চরিত্রাভিনেতা হিসেবেই খ্যাত ছিলেন। এই সময়ের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চরিত্র অভিনেতাদের মধ্যে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, রণদীপ হুদা বা মনোজ বাজপাই-এর নামও উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ইরফান খান ছিলেন এই অসামান্যদের মধ্যেও অতি বিশেষ।
অকালে চলে যাওয়াটা খুব খুব বড় একটা ক্ষতি। এ শোকের সান্ত্বনা হয় না। আপনার অভিনয় মনে থেকে যাবে ইরফান। বিদায় ...