“পাহাড় ভেঙ্গে,
পাথর গুঁড়িয়ে,
রাস্তা তৈরি হয়,
ইঁট রক্ত মিশিয়ে,
পরিশ্রম কার? ধনরাশি কার?
জঙ্গল কেটে,
মাটি চষে,
ফসল জন্মায়,
ঘাম ঝড়িয়ে,
ভাত কার? ফ্যান কার?”
- চেরবণ্ডারাজু
সম্মান আর অধিকারের দাবিতে সংঘর্ষের ইতিহাসকে মনে রেখে পয়লা মে সারা পৃথিবী জুড়ে মজদুর দিবস পালন করা হয়।
মে দিবসের উত্তরাধিকার কী?
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের আটজন শহীদ মজদুর নেতাকে স্মরণ করে মে দিবস পালিত হয়। তাঁদের দাবি ছিল কাজের সময়ের ঊর্ধসীমা আট ঘণ্টা করা হোক। এই দাবিতে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এঁরা এবং এই কারণেই তাঁদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি। সারা পৃথিবী আট ঘণ্টা কাজের দাবীতে কেঁপে ওঠে এরপর, এই দাবি মেনেও নেওয়া হয়। ১৯৪২ সালে, ভারতে এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেন ডাক্তার ভীমরাও আম্বেদকর। এর পরেই কাজের সময় সর্বোচ্চ আট ঘণ্টায় বেঁধে দেওয়া হয়।
কিন্তু আজ এই করোনা মহামারীর সংকটাবস্থায় ভারত সরকার এই নিয়ম বাতিল করার জন্য আটঘাট বাঁধছে। মজদুরদের ওভারটাইমের মজুরি ছাড়াই দিনে বারো ঘণ্টা কাজ করানোর নতুন আইন আনতে চাইছে সরকার। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার পুঁজিবাদী শাসকবর্গ ন্যায্য দাবীর প্রেক্ষিতে লড়াইতে শামিল মজদুর নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল, তাদের ওপর রাষ্ট্রদ্রোহ ও হত্যার মিথ্যা দায় চাপিয়েছিল। শিকাগো হে-মার্কেটের সংঘর্ষের সময় আমেরিকান পত্রপত্রিকার ভয়ানক, মজদুর-বিরোধী রূপ সবার সামনে আসে। পুঁজিপতিদের পদলেহন করে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা হয়, “যে মজদুররা বেশী মাইনে আর তাদের ভুখা বাচ্চাদের পেটের ভাত চায় তাদের গুলি করা উচিত, বোমা মারা উচিত। এদের স্বাধীন থাকার অধিকার নেই, ভোটাধিকার তো কোনমতেই নয়।”
এই ২০২০ সালেও করোনার কবলে পড়া গরিব মজদুররা তাদের ভুখা বাচ্চাদের জন্য ভাত চাইছে। ফলত পুলিশের লাঠির মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। গরিব, মজদুরদের সংঘর্ষের সাথী নেতাদের কোন না কোন কালা কানুনের আওতায় জেলে পোড়া হচ্ছে। সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মুখ খুললে ভারতের সংবাদমাধ্যম তাকে দেশদ্রোহীর অভিধা দিচ্ছে, প্রচার করছে এদের হত্যার সপক্ষে।
এমতাবস্থায় হে-মার্কেটের শহিদদের মধ্যে অন্যতম অগাস্ট স্পাইসের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়, “তোমরা যদি ভাব আমাদের ফাঁসিতে চড়িয়ে তোমরা এই লড়াইকে চুপ করিয়ে দেবে, তাহলে আমাদের ফাঁসিতে চড়িয়ে দাও। এখানে একটা স্ফুলিঙ্গ চাপা দেবে, ওখানে তোমাদের পিছনে আর তোমাদের সামনে আগুন গর্জিয়ে উঠবে। এই আগুন মনের মধ্যে জ্বলছে, তোমাদের পায়ের মাটির তলায় জ্বলছে, একে নেভাতে পারবে না তোমরা।”
একইসাথে ফৈযের একটি কবিতাও মনে পড়ে যায়,
“আমরা আমাদের ভাগ চাইবো,
একটা ক্ষেত নয়, একটা দেশ নয়,
আমরা এই গোটা পৃথিবী চাইব।”
এই পৃথিবী গোটাটাই চলে মজদুরদের খাটনির দৌলতে, এই বিপুল ধনরাশিও তৈরি করেছে শুধু তারাই। একদিন সবরকম দমন শোষণের চোখে চোখ রেখে এই পুরো দুনিয়ার ভাগ চাইবে এই মজদুররা।
আজ আমরা সবাই করোনা অতিমারীর সাথে লড়াই করার চেষ্টা করছি। কিন্তু মোদী সরকার এর জবাবে দিয়েছে শুধুই ঠাট্টা, তামাশা আর অপরিকল্পিত লকডাউন। এর ফলে সাধারণ মানুষকে অপরিসীম মুশকিলের মুখে পড়তে হচ্ছে। খেটে খাওয়া মানুষকে মারা হচ্ছে, অপমান করা হচ্ছে, হেনস্থা করা হচ্ছে, তাদের ওপর রাসায়নিক কীটনাশক ছড়ানো হচ্ছে। ঘরে ফেরার তাগিদে বহু মজদুর মাইলের পর মাইল হেঁটে প্রাণ হারাচ্ছেন। প্রথম পর্বের লকডাউনে, এসওএএন-এর এক সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, ভিনরাজ্যে আটকে পড়া ৯৬ শতাংশ পরিযায়ী মজদুর সরকারের তরফ থেকে কোন রেশন পাননি, ৮৯ শতাংশ মজদুর কোনো বেতন পাননি, ৭৪ শতাংশ মানুষের কাছে লকডাইনের বাকি সময় কাটানোর জন্য তাঁদের দৈনিক বেতনের অর্ধেক পড়ে ছিল। এরকম মানুষের সংখ্যা লকডাউনের এক একদিন বাড়ার সাথে সাথে আরও বেড়ে চলেছে। মনে রাখবেন, লকডাউন বাড়িয়ে ৪০ দিনের করা সত্ত্বেও কোনো ত্রাণপ্রকল্পের ঘোষণা করা হয়নি। বেরোজগারী আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে, কিন্তু মোদী সরকার নিত্যনতুন মজদুরবিরোধী নীতি এনেই চলেছে। এসত্ত্বেও মজদুররা লড়াই থামাননি।
আমরা করোনা, সাম্প্রদায়িকতা আর মোদী সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে লড়ব। সবার পেটে ভাত থাকবে, কারোর মাইনে কাটা চলবেনা, কারোর চাকরী কেড়ে নেওয়া চলবেনা।
আজকের এই সংঘর্ষে জার্মানীর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পুরোধা রোজা লুক্সেমবার্গের উক্তি ধ্বনিত হয়, “যতদিন শাসকবর্গ এবং পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে মজদুরদের লড়াই চলবে, যতদিন তাদের প্রত্যেক দাবি মানা হবেনা ততদিন মে দিবস এই দাবিগুলির বার্ষিক অভিব্যক্তি রূপে পালিত হবে। আর যখন ভাল দিন আসবে, যখন এই পৃথিবীর সমগ্র মজদুরবর্গ নিজেদের দাবির লড়াই জিতে যাবে, হয়ত তখনো সমগ্র মানবসমাজ মে দিবস পালন করবে – বিগত দিনের সেই দারুণ সংগ্রাম আর দুঃখের স্মৃতির সম্মানে।”