লড়াই চালিয়ে যেতে হবে উভয় ফ্রন্টেই
struggle

ভারত আবার কবে গৃহবন্দী দশা থেকে মুক্ত হবে তা এক অনিশ্চিত আশা হয়েই থাকছে, কোনও রূপোলী রেখার দেখা এখনও মিলছে না। গোটা দেশকে এখন রোজ সরকার নির্দেশিত তিন রকমের ‘জোন’-রেখাচিত্রের ওঠানামার পাঠ বুঝে কোবিড আর লক ডাউনের বর্তমান-ভবিষ্যৎ আত্মস্থ করতে হচ্ছে।

বিপরীতে, যে বিপদ ভয়াবহ আকারে বাড়তে শুরু করেছে তা হল একদিকে কাজ উধাও ও ছিন্নমূল হয়ে যাওয়া অন্যদিকে কপর্দকশূন্য ও ক্ষুধা কবলিত জনতার ভিড়। এই বিপজ্জনক রেখচিত্রে কোনো ওঠানামা নেই। বরং তা তীব্র গতিতে কেবলই ঊর্ধ্বগামী, সর্বগ্রাসী হচ্ছে। সরকারী পরিভাষায় নাগরিক জনতার অনেক রকম বর্গ ভাগ রয়েছে, মাঝেমধ্যে তার যাচাই অভিযানে নামকরণে অদল-বদল হয়, সে যাইই হয় মোদ্দা প্রবণতা হল সরকারের খাতায় অভাবী জনতার কেবল সংখ্যাগত সংকোচনই হয়ে আসছে। বাস্তবে ক্ষুধার ভারতের দারিদ্রের ভারতের মাথা-মানচিত্র যে কেবলই বেড়ে চলেছে সেটা শাসকশ্রেণীর কোনও অংশই মানতে চায়না। বিগত একমাসের লক ডাউনের পরিস্থিতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকৃত দুর্বিষহ অবস্থাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এক ধাক্কায় কেন্দ্র-রাজ্যের নানারঙের সরকারগুলোর সমস্ত রকমের পরিসংখ্যানগত অর্ধসত্যের কারসাজি উন্মোচিত হয়ে গেল। গ্রামীণ দিনমজুর ও শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে সামাজিক মাধ্যম নির্ভর এক সাম্প্রতিকতম নমুনা সমীক্ষায় খাদ্য-ত্রাণ না মেলার যে তথ্যচিত্র ধরা পড়েছে তা শিউড়ে ওঠার মতোই। তাতে এটাই নজরে এসেছে বিহার, ঝাড়খন্ড ও মধ্যপ্রদেশে গ্রামীণ মজুরদের যে অংশে সমীক্ষা চালানো হয় তাদের মধ্যে এই সময়ে সরকারী/বেসরকারী কোনোভাবেই খাদ্য সরবরাহের মুখ দেখেননি যথাক্রমে ৭৯, ৫৫ ও ৬৭ শতাংশ, আর বিনামূল্যে রেশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত যথাক্রমে ৮৮, ৬৩ ও ৬৯ শতাংশ। তিরুপুর, গুরগাঁও, আমেদাবাদ, দিল্লীর মতো শিল্পশ্রমিকদের মধ্যে চালানো নমুনা সমীক্ষাও অনুরূপ তথ্যের জানান দিয়েছে। এ হল দৃশ্যমান বিভীষিকার শিলাখন্ড মাত্র। সারা দেশে সমীক্ষা চালালে গ্রাম-শহরে একই প্রবণতার ছবি প্রকাশ হয়ে যাবে। মোদী সরকার কেবল করোনার কামড় নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে, যদিও তা নিয়েও উঠছে অজস্র প্রশ্ন; পাশাপাশি অনাহার ও নগদ অর্থের হাহাকার অবস্থা সম্পর্কে কিন্তু কোনও তথ্য সংগ্রহের নাম নেই, হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না চেয়েই সব এড়িয়ে যাচ্ছে। শাসকশ্রেণী কি দিয়ে আর কি ধামাচাপা দেবে! করোনার বিপদকে যেন ছাপিয়ে যেতে বাড়ছে অনাহারে অর্ধাহারে পাইকারীহারে শেষ হয়ে যাওয়ার বিপদ।

poor

 

প্রধানমন্ত্রী নিরন্ন ও অভাবগ্রস্ত জনতার এই আপতকালীন সময়ে বিশেষ জরুরি যে দু’টি প্রয়োজন, খাদ্য ও নগদ অর্থ যোগানের দায় পালন না করে কথার ফুলঝুরিতে নাম ফাটাতে লিপ্ত। মোদী এই সেদিন ‘জাতীয় পঞ্চায়েত দিবসে’ পঞ্চায়েত প্রধানদের সঙ্গে মেতেছিলেন ভিডিও কথোপকথনে। তাতে পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের কোন কথা তিনি শুনলেন কিনা জানা গেল না, শুনতে চেয়েছিলেন কিনা সেটাও জানাননি। বরং জানা গেল তিনি শুনিয়েছেন করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার অভিযানে দেশকে, বিশেষত গ্রাম ভারতকে পরদেশ নির্ভরতা থেকে মুক্ত থাকার তথা আত্মনির্ভর হওয়ার বাণী। এখন এসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করাই অবান্তর, রাষ্ট্রীয় দায় এড়িয়ে থাকার জন্য কথার চালবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন গ্রাম ভারতের সামনে জ্বলন্ত সমস্যা খাদ্য-অর্থ-কাজ-মজুরি- চাষ-পুঁজি-ঋণমুক্তির, তখন মোদী শোনালেন স্বনির্ভর গ্রাম সমাজ তৈরীর নজীর হিসাবে গত পাঁচ বছরে সওয়া এক লক্ষ পঞ্চায়েতকে ব্রড ব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় নিয়ে আসা ও পরবর্তী লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লক্ষে নিয়ে যাওয়ার কথা। গ্রাম ভারতের দাবিগুচ্ছ একরকম, মোদীর নজর ঘোরানোর উদ্দেশ্য আরেকরকম। পরন্তু তিনি বলতে ছাড়েননি আত্মনির্ভরতাকে আঁকড়ে গ্রামসমাজে তৃণমূল স্তর থেকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে শক্তিশালী করার কথা। কিন্তু এই কঠিন চরমতম দুঃসময়েও একেবারেই চুপ থাকলেন কৃষক সমাজকে ঋণ থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রশ্নে। তাছাড়া এখন রবিশস্যের ফসল তোলার মরশুম। এখন তো মনরেগা প্রকল্পে গ্রামীণ মজুরদের আগাম দু-তিন মাসের মজুুুরি দিয়ে একশ দিনের কাজকে ফসল কাটার কাজে যুক্ত করা যায়, তাতে মজুরদেরও কাজ ও মজুরির নিশ্চয়তা মেলে, আর নিখরচায় মজুর পেয়ে প্রাধান্যমূলক অবস্থায় থাকা ক্ষুদ্র জোতের চাষিদেরও একটু আর্থিক সুরাহা হয়। কিন্তু না, সেকথা নেই। শস্যের ভান্ডার উপচে পড়ছে। সরকার নিজেই এই খাদ্য সংবাদ জানিয়েছে। তার ওপর সরকার জানাচ্ছে লক ডাউনের পরিস্থিতিতেও রবি ফসল তোলার প্রথম দশ দিনের মধ্যে নাকি উত্তর ও মধ্য ভারতের চার রাজ্য পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে নব্বই শতাংশ গম সংগ্রহ ও গোলায় মজুত সারা। এফ সি আই মান্ডিগুলো জমাকৃত গমে ভরা। আর দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও নাকি চাষিরা দুশ্চিন্তায় নেই, কারণ সরকারী এজেন্সীগুলোর ধান সংগ্রহ অভিযান নাকি সারা! সরকারী গণ বন্টণ ব্যবস্থার জন্য মজুত খাদ্যশস্যের নাকি উদ্বৃত্ত্বই থাকছে, গত ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে সংগৃহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল যেখানে ৩৫ মিলিয়ন টন, সেখানে ২০২০-২১ বর্ষে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা হল ৪০ মিলিয়ন টন। সরকারপক্ষের নিজেকে জাহির করার সত্য-মিথ্যা নিয়ে তর্ক এযাত্রা নাহয় তোলা থাক, তবু সরকারের দাবি মোতাবেক পাল্টা দাবি হল, তবে সরকার ভিক্ষা দেওয়ার মতো মাসে পাঁচ-দশ কেজি চাল-গম দিয়ে ক্ষান্ত থাকবে কেন? পরিবারপিছু ন্যূনতম পঞ্চাশ কেজি খাদ্যশস্য কেন দেবেনা? উত্তর মেলে না।

daly

 

মোদী সরকার করোনা সংকটের পরিস্থিতিতে আর্থিক ত্রাণ প্যাকেজ যা ঘোষণা করেছে তা জিডিপি-র এক শতাংশেরও কম। বরাদ্দ করা উচিত ছিল অন্তত ছয় শতাংশ। সে কথা কানেই তুলছে না। অন্যদিকে অতিরিক্ত উপায়েও টাকা তুলছে বিস্তর। আর এস এস নির্দেশিত ‘স্বদেশী’ মডেলে স্বনির্ভর হওয়ার নামে হরেক জন অধিকার হরণের পদক্ষেপ করছে। ব্যাঙ্কে সমস্ত ধরনের আমানতের ১.১ সুদ হ্রাস, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারিদের মহার্ঘভাতা কর্তন, পেনশনগ্রহীতাদের প্রাপ্যে থাবা বসানো, এমনকি প্রতিরক্ষা কর্মী এবং কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের টাকা কেটে নেওয়ার একতরফা পলিসি-পদক্ষেপ করা হচ্ছে। এছাড়া আসছে কমবেশি ‘কর্পোরেট অনুদানে’র অর্থ, যা অবশ্য না নিয়ে কর্পোরেট পুঁজির ওপর ন্যূনতম ১০-২০ শতাংশ ‘করোনা কর’ চাপানো উচিত ছিল। কিন্তু মোদী সরকার ওপথে চলার নয় শুধু নয়, ভীষণভাবেই অনিচ্ছুক বা বিরোধী। তার আঁচ পাওয়া গেল খোদ আয়কর অফিসারদের একাংশের তরফে সর্বোচ্চ ধনীদের ওপর ৪০ শতাংশ করোনা কর ও অন্যান্য সেস বসানোর সুপারিশের প্রতিক্রিয়ায় তুরন্ত সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের দিক থেকে তদন্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদক্ষেপে। সরকারের দিক থেকে বরং কর্পোরেট অনুদান নেওয়ার পিছনে উত্তরোত্তর কর্পোরেট লুন্ঠণ চালাতে দিতে আরও উদার হওয়ার বিপজ্জনক উদ্দেশ্যই থাকবে। যাই হোক, সরকারের হাতে যখন ঘোষিত করোনা প্যাকেজের টাকা আছে, তাছাড়া করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে নানা খাত থেকে নানা সূত্রে প্রচুর টাকা আসছে, তখন করোনা চিকিৎসা ক্ষেত্রে আরও ব্যয়বৃদ্ধি সহ অভাবী জনগণের বিভিন্ন অংশের দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনা সাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য মাথা পিছু খাদ্যশস্যের পরিমাণগত যোগান বৃদ্ধি এবং কয়েকমাসের জন্য আর্থিক অনুদান বাড়ানো হবে না কেন? সাংসদদের তহবিল থেকে উন্নয়নকাজে অর্থব্যয় স্থগিত রাখার নির্দেশ জারি হয়েছে, কিন্তু চূড়ান্ত অপ্রয়োজনীয় দিল্লীর সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প ও বুলেট ট্রেন তৈরির সিদ্ধান্ত রদ হবে না কেন? তাহলেও তো আরও হাজার লক্ষ কোটি টাকা বেঁচে যায়। সেই টাকাও কাজে লাগানো হবে না কেন আজকের জনস্বার্থের প্রয়োজনে? মোদী সরকার একমুখে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই বলছে, অন্যমুখে রাজ্য সরকারগুলোকে – বিশেষত বিরোধী দলের সরকারকে প্রাপ্য অর্থ মেটাচ্ছে না, রাজ্য সরকারগুলোর জন্য শুধু নির্দেশিকা তৈরি করছে আর সিংহভাগ আর্থিক দায় চালান করে দিচ্ছে। কেন্দ্রের মোদী সরকার এভাবে অর্থনৈতিক ক্ষমতার চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারীতা, কেন্দ্রীকরণ, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা ও পীড়ন চালাচ্ছে।

রাজ্য সরকারগুলোও, তা বিজেপি ও তার বন্ধু সরকার, কিংবা ভিন্ন ভিন্ন দল পরিচালিত কেরলের বিজয়ন সরকার বা বাংলার মমতা সরকার, কেউই সমালোচনা-কঠিন সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কেরল সরকার করোনা মোকাবিলায় যেমন কিছু ভালো কাজ করেছে, কিন্তু রাজ্য সরকারী কর্মচারিদের বেতন থেকে একটা অংশ টাকা কেটে নেওয়ার পদক্ষেপও শুরু করেছে, যেটা নিন্দনীয়। আর, বাংলার তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে তো উঠছে ভুরি ভুরি অভিযোগ। বিশেষত করোনা মোকাবিলায় বিভিন্ন তথ্য গোপন এবং ঢালাও রেশন দুর্নীতি-দলতন্ত্র-স্বজনপোষণ ক্রমবর্দ্ধমান ধিক্কারের সম্মুখীন হলেও মমতা সরকার নিজেকে সংশোধনের কোনও সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না। তাই লক ডাউনের পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে উভয় ফ্রন্টেই। লড়ে যেতে হবে করোনা থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কেন্দ্র-রাজ্যের সরকারের জনস্বার্থবিমুখতা থেকে জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য।

খণ্ড-27