কোবিডের পর আমপান, পরের পর বিধ্বংসী সংক্রমণ ও দুর্যোগের ঘনঘটা। একে চলছে চূড়ান্ত অপরিকল্পিত লকডাউন চাপানো দুর্বিষহ অবস্থা, এর মধ্যেই তার ওপর ধেয়ে এল বিধ্বংসী ঘূর্ণীঝড়। সব মিলে বাংলার জনজীবন এককথায় বর্ণনাতীত বিধ্বস্ত। একদিকে আয় নেই, কাজ নেই, ঘরবন্দী হয়ে থাকার যন্ত্রণা; সরকারী পর্যাপ্ত খাদ্যত্রাণ নেই, নগদ আর্থিক অনুদান নেই; জুটছে কেবল নির্দয় উপেক্ষা, নয়তো ন্যক্কারজনক পুলিশী উৎপীড়ন; অন্যদিকে ঝড়-জলের ঘূর্ণী তুফানে ঘর-গেরস্থালি, মাঠের ফসল, সবকিছু শেষ হয়ে গেল। জীবন গেছে ঠিকমতো হিসাব করলে কম-বেশি একশ। দক্ষিণবঙ্গে এক বিশাল অংশে নগরজীবন থেকে গ্রামজীবনে নেমে এল কল্পনাতীত শিউরে ওঠা অন্ধকার। একদিকে লাগাতার বিদ্যুৎ নেই, জলের জন্য হাহাকার, অন্যদিকে জলোচ্ছাসে বানভাসি বসতে-শিবিরে এক মুঠো চিড়ে-মুড়ি জোটা জীবন নিয়ে ভেসে থাকা, এমন অবস্থাতেই নিশিদিন কেটেছে, কাটছে। আমপানের ক্ষত থেকে দেরীতে হলেও নগর-শহরকে ধীরে ধীরে সারিয়ে তোলা শুরু হয়েছে, কিন্তু গ্রামীণ ক্ষতের যে ব্যাপকতা বিভীষিকা যে ব্যাপক মাত্রায় প্রতিকারের পদক্ষেপ করার জরুরি গুরুত্ব দাবি করে তার কণামাত্র এখনও নেওয়া শুরু হয়নি। গত দুমাস ধরে সরকারী ফরমান জারী রয়েছে করোনার হাত থেকে জীবন ও দেশকে বাঁচাতে থাকতে হবে ঘরে। আমপানের ঝড়ে সব হারিয়ে সেই ঘর-ছাড়া হওয়াই হল পরিণতি! নগর-শহরে বিদ্যুৎ ও জল বিহীন ঘরে থাকাই হয়ে উঠেছিল দুঃসহ, আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে আমজনতা নেমে আসে রাস্তায়, প্রতিবাদে অবরোধে। এই সবই নজীরবিহীন।
নজীরবিহীন দৃশ্য এটাও যে, আমপানের ধ্বংসলীলা পরিমাপে আকাশপথে যুগল পরিক্রমা সারলেন প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী। একে ঠিক কি বললে যথার্থ গণ্য করা হবে, ‘জাতীয় বিপর্যয়’ নাকি ‘বিরল বিপর্যয়’, তা নিয়ে মতবৈচিত্র থাকুক, কিন্তু এহেন নজীরবিহীন বিপর্যয় ও তার পরিণতিতে ক্ষয়ক্ষতির বিশালতাকে এতটুকু কমিয়ে দেখানো বরদাস্ত করা যায় না। ক্ষতিপূরণের আর্থিক প্যাকেজের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের দায় যে পঁচাত্তর শতাংশ, এর অন্যথা হতে দেওয়া চলবে না। এ নিয়ে আইনি বা নিয়মরীতির কূটকচালি চলতে দেওয়া যায় না। মুখ্যমন্ত্রীর প্রাথমিক হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক লক্ষ কোটি টাকার মতো। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক কথা দিয়েছেন মাত্র এক হাজার কোটি টাকার অর্থ সাহায্যের! এ নিয়ে একমাত্র বিজেপি ছাড়া ক্ষোভে ফেটে পড়েছে প্রায় সমস্ত বিরোধী দল। বোধহয় প্রতিক্রিয়ার এই আঁচ পেয়ে ইতিমধ্যে পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল, ধ্বংসাবস্থা মাপতে। রাজ্যের মুখ্যসচিব অবশেষে দাবি করেছেন আমপানের ক্ষতি কবলিত হয়েছে ষোলটি জেলা। তার মধ্যে বলাবাহুল্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চারটি জেলা – উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, পূর্ব মেদিনীপুর এবং কলকাতা। আক্রান্ত জনসংখ্যা আনুমানিক প্রায় ছয় কোটি। তবে ব্লকের সংখ্যা অস্পষ্ট। ত্রাণ বাবদ রাজ্য সরকার গঠন করেছে এক হাজার কোটি টাকার তহবিল। কেন্দ্র-রাজ্যের প্রাথমিক প্যাকেজ সমান-সমান।
সে তো জানা গেল। কিন্তু আমপানের ধাক্কা সামলানোর পরিকল্পনা-প্রস্তুতির প্রশ্নে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হল। বিপদের আঁচ ও খবর বেশ কিছুদিন আগে থাকতেই ছিল, কিন্তু বোঝা গেল সরকার সময় থাকতে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। সর্বার্থেই পোষণ করা হয়েছিল সহজে সামলে দেওয়ার আত্মদম্ভী মনোভাব। ধ্বংসভূমিতে দাঁড়িয়ে সাফাই গাওয়া হচ্ছে, বিপদ যে এমন মারাত্মক হবে আগে কল্পনা করা যায়নি। গলদের প্রকৃত কারণ হল, ভাবার সেই চেষ্টাই ছিল না। যে সরকারের নিজের ভাবনাই কূয়োর ব্যাঙের মতো সে আবার বিপদ থেকে রক্ষা করবে কী করে? সরকারের ভাবনা যদি নাগরিকের ভাবনাকে ছাপিয়ে ভাবতে না চায় তাহলে আর কী নিরাপত্তা দেবে? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিভিন্ন জেলায় প্রায় তিন লক্ষ মানুষকে নিরাপদ স্থানান্তরিত করা হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-বাড়ির সংখ্যা দশ লক্ষাধিক। কোবিড পরিস্থিতি যখন উপরন্তু আমপান দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত হল তখন তার মোকাবিলায় সরকারী ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট অফিসার ও কর্মচারিদের উপস্থিতি একশ শতাংশ করা হল না কেন? উড়িষ্যা থেকে গাছ কাটার লোকের বা সেনার সাহায্য আরও আগে চাওয়ার কথা ভাবা যায়নি কেন? চিন্তার ক্ষেত্রে এই ব্যর্থতার মূলে রয়েছে, ‘সর্বোপরি রয়েছেন ‘মাননীয়া’, ঠিক মেলাবেন তিনি, মেলাবেন’ গোছের দায়সারা অবস্থান নিয়ে চলার আচার।
কলকাতার বিপর্যয়ের জন্য তৃণমূল দুষছে সিইএসসি-কে, সিইএসসি দোষ দিচ্ছে রাজ্য প্রশাসনকে। ঘটনা হল, রাজ্য সরকার নিজে ছিল অপ্রস্তুত, তাই সিইএসসি-র প্রস্তুতি প্রসঙ্গেও বিশেষ মাথাব্যথা দেখায়নি, যা বুঝিয়েছে তাইই বুঝে বসেছিল। সিইএসসি-র গ্রাহক সংখ্যা তেত্রিশ লক্ষ। একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হলেও তার ওপর সরকারের তত্ত্বাবধান থাকবে না! এই চাপান-উতোরের আঁচ ওঠার পাশাপাশি অন্য একটা বিতর্কের আঁচও উঠছে। রক্তচোষার মতো একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে বিদ্যুৎ ক্ষমতা থাকাই কি কাল হল না? যে বিদ্যুৎ কিনা অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রের বিষয়। তৃণমূল দায়টা চালান করছে বিগত বাম আমলের দিকে। যেহেতু হস্তান্তর করা হয়েছিল সেই সময়ে। কিন্তু এ দায় মমতা সরকার অস্বীকার করবে কী করে? যেহেতু এই আমল সিইএসসি-র প্রতি একই অবস্থান বজায় রেখে আসছে, শুধু তাই নয়, গোয়েঙ্কা কর্তৃপক্ষকে বিভূষিতও করেছে। এখন সংকটে পড়ে সরকার ও সিইএসসি লিপ্ত হচ্ছে দায় না নেওয়ার পারস্পরিক খেয়োখেয়িতে। ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছে রাজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতাপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটিও। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে কর্মচারিদের কোনও দোষ নেই, তারা চেষ্টা চালিয়েছেন যথাসাধ্য, কিন্তু সংখ্যায় তারা আর কত, খুবই সীমিত, প্রতিষ্ঠান পাল্লা দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে কর্মী সংকোচনের পলিসি। তার পরিণামে পরিকাঠামো ও প্রস্তুতি প্রক্রিয়া ভেঙ্গে পড়াই ছিল অনিবার্য এবং সেটাই ঘটেছে। আর সরকারের নজরদারী ঠেকেছে প্রতিষ্ঠানের কানাগলিতে।
মাঝখান থেকে রাজ্য বিজেপি বলছে, 'সি ই এস সি-কে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে'। আশ্চর্যের কিছু নয়। বেসরকারীকরণের সবচেয়ে কট্টর প্রবক্তা বিজেপির পক্ষে এমনটাই বলা স্বাভাবিক। আরও এই কারণে যে, ওত্ পেতে আছে পরের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে। আমপান ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হওয়া নিয়ে বিজেপি বাজার গরম করছে খুব, কিন্তু আদৌ তুলছে না এই প্রসঙ্গ যে, ক্ষতিপূরণও করা উচিত ব্যাপকভাবে, এর সিংহভাগ দায়দায়িত্ব পালন করা উচিত কেন্দ্রীয় সরকারেরই, তার টাকার অঙ্কটা মোটেই এক হাজার কোটি টাকায় আটকে থাকতে পারে না, রাজ্য সরকারের নির্ণয় অনুযায়ী অর্থের পরিমাণ মিটিয়ে দেওয়া উচিত। শুধু তাই নয়, বাংলার এই দুঃসময়ে আর বিলম্ব না করে কোবিড, রাজস্ব এবং জি এস টি বাবদ রাজ্যের সমস্ত পাওনা দিয়ে দেওয়া উচিত।