আবেদন
বিধ্বংসী আমপান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলার ত্রাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ জরুরি – অবিলম্বে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা কর
 
pg

আমাদের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাতন্ত্রের বয়স নয় নয় করে ৭২-৭৩ বছর হয়ে গেল। কিন্তু এক আজব রীতি আমাদের পিছু ছাড়েনি। দেশের যেকোনো প্রান্তে ভূমিকম্প হোক, সুপার সাইক্লোন হোক, বন্যা হোক, বা আমপানের মতো বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় হোক, তা দেখতে আকাশপথে দিল্লির নর্থ বা সাউথ ব্লকের কোনো সর্বোচ্চ পদাধিকারী পরিদর্শনে আসেন। অবশ্য কবে আসবেন বা আদৌ আসবেন কিনা তা নির্ভর করবে, “এটা পলিটিক্যালি কারেক্ট হবে কিনা”, সহজ ভাষায় বললে, এতে রাজনৈতিক লাভ কতটা হবে তার উপর। রাজ্যের প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিবর্গ তখন বিপর্যস্ত মানুষের কথা ছেড়ে ‌কখন ও কোথায় তিনি নামবেন, কে কে তাঁকে স্বাগত জানাতে ফুলের তোড়া ও উত্তরীয় নিয়ে হাজির থাকবেন, হ্যালিপ্যাড কোথায় তৈরি হবে ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে দান, অনুদান ও খয়রাতির ব্যাপার-স্যাপার। এই এলাহি আয়োজনের খরচপত্রের কথা সরিয়ে রেখেও প্রশ্ন জাগে এই দৃষ্টিকটু রীতির অবসান কবে হবে, কীভাবে হবে??

আমফান দুর্গত রাজ্যবাসীর পাশে থাকুন। বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে আপনাদের সাহায্য পাঠাতে পারেন নীচের...

Posted by CPIML Liberation, West Bengal সি পি আই এম-এল লিবারেশন, পশ্চিমবঙ্গ on Sunday, 24 May 2020

 

আমপান বিধ্বংসী ঝড়ও রাষ্ট্র, প্রশাসন, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, বিপর্যয় মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, উদ্যোগ কী ধরনের, কতটা কার্যকরী তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। পুঁজির মুনাফা প্রধান যে উন্নয়নের নীতি নিয়ে আমাদের সরকার ও ব্যবস্থাগুলো চলছে তা কতটা অকার্যকারী শুধু সেটুকুই নয়, তা কত নিষ্ঠুর ও মিথ্যা ‌প্রতিশ্রুতিতে ভরা আমপান তাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আমপান বিধস্ত হিঙ্গলগঞ্জের সেই স্কুল ছাত্রীর মর্মস্পর্শী উক্তি, ঝড়ের মুখে সপরিবারে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম শৌচাগারে। কারণ সেটিই আমাদের গৃহের একমাত্র পাকাঘর। এই উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতা কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। এক বিরাট অংশের জনগণের বাৎসরিক উপলব্ধি।

women

 

সে কথাই শোনা গেল সাগরদ্বীপের গৃহহারা মহিলাদের কন্ঠে, প্রতি বছর আমাদের ঘর ভাঙবে, তারপর বেঁচে থাকলে ঘর মেরামত। অথচ কত না প্রকল্প হল, ইন্দিরা আবাস যোজনা, নাম পাল্টে সেটাই হল, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা।গত ৫/৭ বছরে গ্রাম ও শহরে স্বল্পবিত্ত মানুষদের ঘর জুগাইবার প্রকল্পগুলির নামের বদলে হইলেও ঘর কত মিলেছে, আমপান তার হিসাব জানিয়ে দিল। একই কথা রাজ্যের জন্যও সত্য। আমার ঠিকানা নাম বদলিয়ে হল গীতাঞ্জলি, তাহারই অন্য নাম বাংলা আবাস যোজনা। আর ২০১১ সালের গৃহস্থালি গণনার থেকে জানা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ঘাস-খড়-বাঁশ দিয়ে নির্মিত ছাদ যুক্ত গৃহ ১৯ শতাংশ, আরও সকল উপকরণে নির্মিত দেয়াল যুক্ত গৃহ ৬২ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে ছিলেন, ২০২২ সালের মধ্যে সকল দেশবাসীর জন্য পাকা বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হবে। আমপান বিদ্ধস্ত মানুষের মুখে ক্লান্ত হাসির কোন ছবি দেখবেন না। তাঁরা এখন আস্ত টালি, বাঁশ, ত্রিপল বা পলিথিন শিট খোঁজায় ব্যস্ত!!

map

 

এবার শুরু হবে ক্ষয়ক্ষতির মাপজোক ও হিসাবপত্র। সাহায্য বা অনুদান বা ঋণের টাকায় যাতে কোনো অপচয় বা বেহিসাবী খরচ না হয় তা নিয়ে আমলাতান্ত্রিক দড়ি টানাটানি। ২০০৯ সালের‌‌ আয়লার ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও আসেনি। কারণ এতে “রাজনৈতিক লাভ” তেমন আর নেই। আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের টাকা কবে মিলবে, কত মিলবে তা নিয়ে রাজনৈতিক বোঝাপড়া হলে তখন বোঝা যাবে। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বন্যা, মহামারী, দুর্ভিক্ষের ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের জন্য একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা কেন থাকবে না, সেটাই মূল প্রশ্ন। কত কমিশন হল (সারকারিয়া কমিশন ও তার সুপারিশ বহুল চর্চিত) এদেশে তারপরও কোনো পরিবর্তন হয় না।

একদিকে দেশজুড়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে, মৃত্যুর সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সরকারের মনোভাব স্পষ্ট হলো গুজরাট হাইকোর্টে রাজ্যের এ্যাডভোকেট জেনারেলের কথায়, “আমরা আর তেমন টেষ্টের উপর জোর দিচ্ছি না, তাহলে ৭০ শতাংশ পজিটিভ বেরোবে”।

man

 

এটা শুধু গুজরাটের কথা নয়, এর প্রতিধ্বনি সব রাজ্যেই পাওয়া যাবে। কাজ হারা মানুষের সংখ্যা শহর ও গ্রামে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পরিযায়ী শ্রমিকরা কি অবস্থায় ঘরে ফিরছে সকলেই অবগত‌। ফিরে আসার গোটা পথে হাতে শুধু চার পাঁচটা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট। জ্বর হলে খেয়ে নেবেন; ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরীক্ষা নেই, খাবার জলটুকু পর্যন্ত কেউ দেয়নি। ফিরে আসার পর সরকার জানিয়ে দিয়েছে ঘরে থাকাই ভালো। ঘর কোথায়? সে তো আমপানে উড়ে গেছে, নয়ত মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সরকার কোনো দায় নিতেই রাজি নয়। কেন্দ্র দায় নেয়নি, রাজ্য অপারগ। মাটির কাছে ফিরে আসার পরও বিশ্বাসভঙ্গ। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চারমাস ধরে একই ওষুধ চলছে। রোগের কোনো উপশম নেই, মৃত্যুর মিছিল লম্বা চওড়ায় বড় হচ্ছে। শুধু লকডাউনের বটিকায় যে কোনো কাজ হচ্ছে না, তাতো স্পষ্ট। ইতিমধ্যেই বিশ্বের প্রথম দশের তালিকায় আমাদের নাম এসে গেছে।

আমপানের ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য সকলেই জেনে গেছেন। শতাধিক মানুষের প্রাণ আর দেড়-দু কোটি মানুষের জীবন যন্ত্রণার থেকেও যদি আমরা শিক্ষা নিতে না পারি, তবে আরও বিপর্যয় হয়ত আমার, আপনার ও আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। নদীগুলোর সংস্কার থেকে সুন্দরবন রক্ষার কাজে সরকারের নজর ফেরাতে এখন থেকেই সোচ্চার হতে হবে।

padd

 

শুধু সরকার ও প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থাকলে এই বিপন্ন, বিপর্যস্ত সহ নাগরিকদের উঠে দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। যে চাষির ধান ও ফসলের ক্ষেতের উপর দিয়ে সমুদ্রের নোনা জল বয়ে যাচ্ছে, তাঁকেও সমান হারে বিদ্যুতের মাশুল গুণতে হবে, সার ও বীজ চড়া দামে কিনতে হবে যেমন শহরবাসীর ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে চরম অকর্মণ্যতার পরও দেশের মধ্যে সবচেয়ে চড়া দামে বিদ্যুৎ বিক্রেতা (ইতিমধ্যে ১৪ বার মাসুল বাড়িয়েছে) শিল্পায়ন ও উন্নয়নের প্রধান পরামর্শদাতাই থেকে যাবেন। সময় এসে গেছে বলার এনাফ ইজ এনাফ।

ration

 

এরকম এক পরিস্থিতিতে বামপন্থী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ও সংগঠনগুলো বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, ছাত্র-যুব এবং নাগরিক সমাজকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। অন্যথায় ত্রাণের নামে, সহায়তার নামে বিভাজনের শক্তিগুলো শিকড় বিস্তারের চেষ্টা চালাবে। ২০০০ সালের গুজরাট ভূমিকম্প ও ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যার গভীর সম্পর্ক এবং আদানি-আম্বানিদের উত্থান রহস্য সকলের জানা। বাংলার মানুষ ২০০২ সালের গুজরাট দেখতে রাজি নয়। বাংলা এই বিপর্যয়ের পরও নতুন প্রভাতের স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন সফল কাজে অনেকেই নেমে পড়েছে, আমাদেরও কাঁধ মেলাতে হবে।

- পার্থ ঘোষ  

খণ্ড-27