সব আতংকের অবসান ঘটিয়ে সুপার সাইক্লোন আম্পান কিছুটা দুর্বল হয়ে বাংলাদেশকে আঘাত করেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমরা ভাবলাম, যাক বাবা! এবারের মতো বেঁচে গেলাম। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেকে বললেন, এবারও সুন্দরবন বুক দিয়ে আগলে রাখলো বাংলাদেশকে। বাস্তবেও তাই। সুন্দরবন বার বার ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন থেকে রক্ষা করে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলকে। সাম্প্রতিক সময়ে যেমন করে রক্ষা করেছিলো বুলবুল, ফনী, আইলা, সিডর-এর আঘাত থেকে। এবার বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ৪০০ কিলোমিটার ব্যাসের সাইক্লোন আম্পানের গতিবেগ ২২৫ কিলোমিটারের বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রমের সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার। গতি কমে যাওয়ার কারণ সুন্দরবন। ভারতের সমুদ্র উপকূল দিঘা, কাকদ্বীপ ও সুন্দরবন অংশে তাণ্ডব চালিয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকা দিয়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে আম্পান। সুন্দরবনের ভারতীয় অংশ আর বাংলাদেশের অংশ রাজনৈতিক ভূগোল বিবেচনা করেনি, অনুসরণ করেছে প্রাকৃতিক নিয়ম। বাতাসের ঝড়ো গতি আর দমকা হাওয়াকে ঠেকিয়ে দিয়েছে ঘন অরন্যের গোলপাতা, কেওড়া, সুন্দরী গাছেরা মিলে। আর দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতিকে বুঝতে হলে দেখতে হবে ভাল করে আর জানতে হবে তার নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম না বুঝে প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট করলে তার ফল ভাল হয় না। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে মুনাফার পিছনে ছুটতে ছুটতে মানুষকে পিছনে ফেলে দিলে তাঁকে উন্নয়ন বলে কিনা সে প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে আজ।
সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় প্রকৃতির শক্তিশালী নিয়ামকগুলোর মধ্যে অন্যতম। একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় যে পরিমাণ শক্তির জন্ম দেয় ও নির্গত করে তা পারমাণবিক বোমার চাইতেও বহুগুণ শক্তিশালী। সমুদ্রের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয়ে ঘূর্ণিঝড় অগ্রসর হতে থাকে স্থলভাগের দিকে এবং আছড়ে পরে। উৎপত্তিস্থল অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়কে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্টি হলে একে বলে টাইফুন। ভারত মহাসাগর ও অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে সৃষ্টি হলে সেটাকে বলা হয় সাইক্লোন। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিকে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়কে বলে হারিকেন। বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর গড়ে ৩০ টি করে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয় যা সাইক্লোন বলে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি মাঝারি শক্তির এবং দু-একটি প্রচণ্ড শক্তির হয়ে থাকে।প্রকৃতিতে ঘূর্ণিঝড় স্বাভাবিক ঘটনা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানিরা বলছেন, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা যত বাড়ছে, ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এবং শক্তিও ততই বাড়ছে। আবার উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা, ফলে অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বার বার সতর্ক করছেন এই বলে যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ভবিষ্যতে লাগামহীন হয়ে পড়বে। আর বঙ্গোপসাগরের আশেপাশের অঞ্চল হবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলগুলোর একটি। বৈশ্বিক উষ্ণতার লাগাম টেনে ধরতে হবে তাই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে। কিন্তু কে বা শোনে সে কথা!
সুন্দরবন যে মায়ের মতো আগলে রাখে, রক্ষা করে সমুদ্রের রুদ্র রুপের আক্রমণ থেকে তা আমরা দেখি কিন্তু মনে রাখি না। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মৃত্যু বরণ করেছিল প্রায় ৫ লাখ মানুষ। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সমুদ্র উপকূলে। মৃত্যু বরণ করে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। প্রায় সমান শক্তি নিয়ে ২০০৭ সালে সিডর আঘাত হানে খুলনা সাতক্ষীরা বাগেরহাট বরগুনা অঞ্চলে। এতে মৃত্যু বরণ করে সাড়ে তিনহাজার মানুষ। মৃত্যুর সংখ্যার পার্থক্যের কারণ হল, চট্টগ্রাম নোয়াখালী হাতিয়া সন্দীপ অঞ্চলে সুন্দরবন নেই, বাতাসের এবং জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা ঠেকাবার মতো কোনো প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়াল নেই সে অঞ্চলে। সে কারনেই সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে এই যুক্তি করা হয়েছিল যে সুন্দরবন থেকে হিসেব করা যায় এমন দৃশ্যমান আয় শুধু হয় না, ক্ষয় ক্ষতির হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে তার হিসাবটাও করা দরকার। তাহলে বুঝতে কষ্ট হবে না সে আমাদের কতখানি এবং কী দেয়। সুন্দরবন সংলগ্ন জেলা উপজেলাগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫ লাখ শ্রমজীবী, বনজীবী সুন্দরবনে যায় গোলপাতা, মাছ, কাঠ, মধু আহরণের জন্য। দিনে গড়ে ৫০০ টাকার সম্পদ নিয়ে এলেও তার বাজার মূল্য দাঁড়ায় দিনে ২৫ কোটি আর বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা। এতো গেল সাধারণ দরিদ্র মানুষের আয়ের কথা, অসাধারণ এবং বড় ব্যবসায়ীদের আয় কত? পর্যটন থেকে আয় কত? এসব হিসেবের সঙ্গে প্রাকৃতিক প্রহরী হিসেবে সম্পদ রক্ষা করে কত, তা যুক্ত করলে সুন্দরবন কে ধংসের যে কোন কর্মকাণ্ড প্রতিহত করা সবার দায়িত্ব হয়ে পড়া উচিত।
রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ওরিয়নের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সুন্দরবন ঘিরে ১৫০টির বেশি শিল্প স্থাপনা নিয়ে প্রতিবাদের একটাই লক্ষ্য ছিল সাময়িক মুনাফার জন্য প্রকৃতির এবং মানুষের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বন্ধ করা। নির্বিচারে বন উজাড়, বসতি স্থাপন, দখল, নদী ভরাট, দিন রাত পণ্যবাহী নৌযান চলাচল প্রভৃতি কারনে সুন্দরবন আয়তনে শুধু ছোট হয়ে যাচ্ছে তাই নয়, এর প্রকৃতিতেও পরিবর্তন আসছে। কমে যাচ্ছে মাছ, গাছ, বাঘ, কুমির, ডলফিন। বন্য প্রাণির অবস্থা দেখে বোঝা যায় বনের অবস্থা কেমন! প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের পর ভেঙ্গে যাওয়া বেড়ি বাঁধ নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতা, গাফিলতি এবং দুর্নীতি হলেও মহাপ্রাণ সুন্দরবন যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে এবং পরবর্তী ঝড়ের মোকাবিলা করে। কিন্তু মানুষের নির্বিচার হামলা ও আক্রমণের সামনে সে হয়ে পড়ে অসহায়। এবারও আম্পানের ছোবল থেকে আমাদেরকে রক্ষার পর সুন্দরবনকে রক্ষার ব্যাপারে কী সরকার ও বন দুর্বৃত্তদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে না?
আম্পানের মতো করোনার সংক্রমণ কি আমাদের উন্নয়নের আড়ালে চাপা পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্গতির ব্যাপারে সচেতন করবে? করোনা দুর্যোগে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী, হাসপাতাল, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর এসবের স্বল্পতার চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দের স্বল্পতাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। জনগণের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার দিন দিন সংকুচিত হতে হতে কী অবস্থায় উপনীত হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা, বিক্ষোভ, আন্দোলন হলেও কর্ণপাত করেনি রাষ্ট্র পরিচালকরা। বরং স্বাস্থ্য বাণিজ্যের অমানবিক চেহারা দেখেছে জনসাধারণ। ১০০ টাকা চিকিৎসার খরচ হলে তার ৭০ টাকাই দিতে হয় মানুষের নিজের পকেট থেকে। আর বেসরকারী বাণিজ্যিক হাসপাতাল দেখে বুঝতে অসুবিধা হতো এসব কি হাসপাতাল না পাঁচ তারকা হোটেল। বিলাসিতার সব আয়োজন থাকলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা যে সহজলভ্য ছিল না অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো বিখ্যাত মানুষের মৃত্যুতে তা অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাজেটের মূল টাকার যোগানদার সাধারণ মানুষ। তাদের চিকিৎসার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ে না দীর্ঘদিন ধরে। দেশের ক্ষমতাসীন ব্যক্তি আর ধনবান ব্যাক্তিদের চিকিৎসার কেন্দ্র ছিল বিদেশের বিখ্যাত হাসপাতালগুলো। ফলে দেশের মানুষের চিকিৎসা নিয়ে ভাবনা তাদের ছিল না বরং এটাকে ব্যবসায়ীদের অনিয়ন্ত্রিত মুনাফা অর্জনের খাতে পরিণত করার আগ্রহ ও উদ্যোগ ছিল প্রবল। গত কয়েক বছর ধরে বাজেটে ৫ শতাংশের নিচে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, আবার যা বরাদ্দ করা হতো তার অনেকটা দুর্নীতি অপচয়ের খাল দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ফলাফল দেখা গেল। কর্তা ব্যক্তিদের ৩৭ লাখ টাকার পর্দা কেনার আগ্রহ যতটা, ভেন্টিলেটর কেনার বা সংগ্রহ করার উদ্যোগ ততটা ছিল না। বর্তমান বাজার দরেও পর্দার বাজেট দিয়ে ১৫টা ভেন্টিলেটর কেনা যেত আর দেশে বানালে ৩৫টা সংগ্রহ করা যেত। মানুষ বাঁচাতে কোনটা বেশি প্রয়োজন আর মুনাফা বাড়াতে কী পরিকল্পনা করা দরকার এই বিরোধে মানুষ পরাস্ত হয়েছে এতদিন।
তাহলে এখন কী হবে বা কী করা হবে? কিছু কি শিখলাম করোনা সৃষ্ট বিপর্যয়ে বা আম্পানের আঘাতে? ব্যক্তিকে সব কিছুর জন্য দায়ী করে বা ব্যক্তিকে মহিমান্বিত করে ব্যবস্থার ত্রুটিকে আড়াল করে সমস্যার সমাধান হবে না। গ্রামাঞ্চলে একটি বহুল প্রচলিত গল্প আছে। একজন নৌকার মাঝি নদী পারাপারে বেশি আয়ের আশায় ধারণক্ষমতার চাইতে বেশি যাত্রী তুলেছে নৌকায়। নদী পার হওয়ার সময় মাঝামাঝি এসে হঠাৎ ঝড়ে নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম। নৌকার বোঝা হালকা করার জন্য মালপত্র ফেলে বাঁচার আশায় সবাই যখন হায় হায় করছে তখন মাঝি দেবীর উদ্দেশে বলল, মা জননী আমার অপরাধ হয়েছে, এবারের মতো মাফ করে দাও। আমি তোমার জন্য জোড়া পাঁঠা বলি দেব। যাক! একসময় ঝড় থেমে গেল। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এর কিছুদিন পরে সেদিনের এক যাত্রী জিজ্ঞেস করলো, মাঝি পাঁঠা বলি দিয়েছিলে? মাঝি বলল, না। যাত্রী বলল, কী ব্যাপার! তুমি মানত করে তা আবার ভঙ্গ করলে? নির্বিকার মুখে মাঝি বলল, “দেবী, ঝড় পাঠাইয়া ডর দেখাইছিল আমি লোভ দেখাইয়া তারে শান্ত করছি। কাটাকাটি হইয়া গেছে।”
প্রকৃতি নাকি সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কী শিখলাম আমরা করোনা ও আম্পানের কাছ থেকে। করোনা ও আম্পানের ভয় কি তেমনি প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসে কাটাকাটি হয়ে যাবে? মুনাফার সমাজে মানুষ উপেক্ষিত হতেই থাকবে এবং প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগে হাতের সম্বল হারিয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে।
-- রাজেকুজ্জামান রতন