গ্যাদগ্যাদে আবেগে চাপা পড়ে যাচ্ছে করোনা ভ্যাক্সিনের সত্যিটা
gad

লেখক কোষ ও আণবিক জীববিদ্যা গবেষক , ক্যালিফোর্ণিয়া, USA

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি COVID-19 র জন্য দায়ী SARS-COV-2 করোনা ভাইরাস প্রতিষেধক ভ্যাক্সিন বানাচ্ছে আমরা সবাই এতদিনে জেনে গেছি। এ সংক্রান্ত একটা Post খুব ভাইরাল হচ্ছে, করোনা ভাইরাসের মতই, যে এলিসা গ্রানাতে বলে একজনকে SARS-COV-2 করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। এবং এর পরে ওঁর শরীরে করোনা ভাইরাস ইঞ্জেক্ট করা হবে। যদি ভ্যাক্সিন কাজ না করে, ওঁর মৃত্যুও হতে পারে। মাত্র ৩২ বছর বয়েসে এলিসা মানবতার স্বার্থে এতবড় জীবনের ঝুঁকি নিলেন। ভ্যাক্সিন সফল হলে বিজ্ঞানীকে লোকে মনে রাখবে, এঁকে লোকে ভুলে যাবে। স্যালুট ইত্যাদি।

এতগুলো কথার মধ্যে এলিসাকে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে, এই কথাটাই খালি সত্যি। বাকি যা লেখা আছে, তা বাংলা সিরিয়ালের গ্যাদগ্যাদে সংলাপ মাত্র। খালি তাই না, তা চরম মিথ্যা, ভুল এবং মারাত্মক অপবিজ্ঞান। ভ্যাক্সিনের কার্য্যকারীতা এভাবে পরীক্ষা করা হয়না। হ্যাঁ, স্মল পক্স নিয়ে ডাক্তার এডোয়ার্ড জেনার এরকম পরীক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তা ১৭৯৬ সালে। তারপর আর কেউ করেছেন বলে শুনিনি। সেই গপ্প ভাঙ্গিয়ে লোকে ২০২০-তে বসে এরকম গল্প সোশ্যাল মিডিয়ার বাজারে ছাড়ছে!

প্রথমত, ভ্যাক্সিন কোনো একজনের ওপর পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। বিরাট সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর ওপর পরীক্ষা করা হয়। সেরকম এই করোনা ভ্যাক্সিনও প্রথম ধাপে ১১০২ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর প্রয়োগ করা হবে।এলিসা একা নন, ওঁর পরেও আরও ১১০০ জন আছেন। ১১০২-১=১১০১ আমি জানি। অঙ্কে কাঁচা হলেও, এতটাও না!! তাহলে ১১০০ কেন বললাম? কারণ, সেদিন মাইক্রোবায়োলিজিস্ট এলিসার সাথে এডোয়ার্ড ও’নীল বলেও একজন ক্যান্সার গবেষককেও করোনা ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছিল। এলিসাই কি করে বিখ্যাত হয়ে গেলেন জানিনা !

covid

 

দ্বিতীয়ত, এলিসাকে হয়তো করোনা ভ্যাক্সিন দেওয়াই হয়নি। অবাক হলেন? বিজ্ঞাপনী হিন্দিতে, চক গ্যায়ে? হবেন না!কারণ, যে কোনa ওষুধ বা ভ্যাক্সিন যখন পরীক্ষা করা হয়, তখন একদলকে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়, আরেকদলকে নুনজল ইত্যাদি মিছিমিছি ওষুধ দিয়ে, ভ্যাক্সিন দেবার ভান করা হয়। আর কাকে আসল ভ্যাক্সিন দেওয়া হচ্ছে আর কে মিছিমিছি, সেটা একমাত্র গবেষক জানেন। যিনি ইঞ্জেক্ট করছেন, তিনিও হয়তো জানেননা, যে তাকে “দিদি, কি দিলে গো?’ ভ্যাক্সিন না নুনজল?” বলে জেনে নেবেন!

এবার দু’দলকে বেশ কয়েকমাস নজরে রেখে দেখা হয়, যাদের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছিল, মিছিমিছি দলের সাথে রোগ প্রতিরোধে তাদের কোন পার্থক্য আছে কিনা! যদি থাকে তবে কত বেশি পার্থক্য!

সে জন্য ১১০২ জনকে দুভাগে ভাগ করে একদলকে করোনা ভ্যাক্সিন আর একদলকে মিছিমিছি হিসেবে মেনিনজাইটিসের ভ্যাক্সিন দেওয়া হবে। মেনিনজাইটিস ভ্যাক্সিনের সাথে করোনার কোনো সম্পর্ক নেই। এটা meningococcus ব্যাক্টিরিয়ার ভ্যাক্সিন। নুন জলের বদলে মিছিমিছি হিসেবে মেনিনজাইটিস ভ্যাক্সিন কেন দেওয়া হল? কারণ, করোনা ভ্যাক্সিন দিলে, সাময়িক ভাবে জ্বর আসতে পারে, ছুঁচ ফোটানোর বাহুতে ব্যাথা ইত্যাদি হতে পারে। নুন জল দিলে তা হবে না। তাই যাকে দেওয়া হল, তিনি বুঝে যাবেন তাঁকে করোনা ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। মেনিনজাইটিস ভ্যাক্সিনেও যেহেতু একই রকম জ্বর, ব্যাথা হতে পারে, তাই নুন জলের বদলে এই ভ্যাক্সিন। অবশ্যই জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যে “আপনাকে করোনা বা মেনিনজাইটিস, যে কোন একটা ভ্যাক্সিন দেওয়া হচ্ছে”! কিন্তু কোনটা সেটা বলা হয় না। তাই হতেই পারে এলিসাকে হয়তো মেনিনজাইটিস ভ্যাক্সিন, যা করোনার ক্ষেত্রে মিছিমিছি আর এডোয়ার্ডকে আসল করোনা ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। সেটা ওই ভ্যাক্সিন টিমের প্রথম সারির লোকজন ছাড়া কেউ জানেননা। এত লুকোছাপা কেন? কারণ বলে দিলে তো যাঁকে দেওয়া হয়েছে, তিনি ভাববেন আমি এখন করোনা প্রতিরোধ করতে পারব, বলে বেশি সাহসী হইয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু ভ্যাক্সিন হয়তো কাজই করলনা, এদিকে তিনি আক্রান্ত হলেন। উল্টোদিকে যিনি জানেন, তিনি মিছিমিছি ভ্যাক্সিন পেয়েছেন, তিনি এত সাবধানী হয়ে গেলেন, করোনা সংক্রমণ তাঁর এমনিই হল না। দুক্ষেত্রেই প্রকৃত সমীক্ষা কখনোই হবে না। ভুলভাল ফল আসবে।এটাই কারণ। এছাড়া আরও না না কারণে, যে কোনো ওষুধ বা ভ্যাক্সিনের মানবদেহে পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।

marin

 

তৃতীয়ত, ৩২ বছর বয়সী এলিসা বা তরুণ এডোয়ার্ড এত বড় প্রাণের ঝুঁকি নিলেন কেন? এডোয়ার্ডের আবার ছোট বাচ্চাও আছে। এরপর তো ওঁদের দেহে করোনা পুরে দেওয়া হবে! যদি ভ্যাক্সিন কাজ করে, তাহলে একজন বাঁচবেন আর না কাজ করলে দুজনেই মরবেন! তাই তো? শুনুন মশাই, ওভাবে কোনো ভ্যাক্সিন পরীক্ষা হয় না। আর একটা কথা, করোনা মানেই মৃত্যু এটা বারবার বলছি, একেবারেই নয়। রোগলক্ষণহীন Asymptomatic-দের ধরলে মৃত্যুহার মাত্র ১%। যাই হোক, ১% হলেও কারো দেহে কোনো করোনা পুরে দেওয়া হবে না, meningococcus ও ভরে দেওয়া হবে না। ১১০২ জন যে যেখানে আছেন, তেমনই থাকবেন, যেমন জীবন যাপন করছেন, তাই করবেন। করোনা সংক্রমণ সারা পৃথিবীর লোকের যেমন করে হচ্ছে তেমনি হবে। কয়েকমাস বাদে দেখা হবে, করোনার এই প্রকোপের মধ্যেও ভ্যাক্সিন আর মিছিমিছি দু’দলের মধ্যে ভ্যক্সিন-দল কতটা সুরক্ষিত ছিলেন। তারপর Statistician বা রাশিবিজ্ঞানীরা চশমা এঁটে, নাকে নস্যি নিয়ে, অনেক জটিল অঙ্ক কষে জানাবেন ভ্যাক্সিন কতটা কার্য্যকারী বা সফল হল। যদি কাজ না করে, দু’দলই করোনা আক্রান্ত হতে পারেন। স্বেচ্ছাসেবীদের বয়েস সবার ১৮-৫৫। এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বা অধিকারিণীকেই এই পরীক্ষায় নেওয়া হচ্ছে, তাই ভ্যাক্সিনে কাজ না হলেও মরার কোনো সম্ভাবনাই প্রায় নেই। নেহাত মারা গেলেও অন্তত ভাক্সিনের কাজ করা বা না করায় তাতে কোনো ভূমিকা নেই। আর ভ্যাক্সিনের জন্য বড়জোর দুদিন জ্বর, গা ব্যাথা হতে পারে। মারা যাবার কোনো প্রশ্নই নেই! তাই দোহাই, গ্যাদগ্যাদে সংলাপের আড়ালে বিজ্ঞানটাকে হারিয়ে ফেলবেন না।

এখন ভ্যাক্সিনটি কতটা কার্যকরী হল, তার সম্পূর্ণ হিসেব পেতে আগামী কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।

খণ্ড-27