৪ মে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল রাজ্য প্রশাসনকে দেওয়া চিঠিতে জানিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গে কোভিড-১৯ সংক্রমণে মৃত্যুর হার অর্থাৎ কেস ফ্যাটালিটি রেট (সিএফআর) দেশের মধ্যে সর্বাধিক। এই সিএফআর হল মোট আক্রান্তে মোট মৃত্যুর অনুপাত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ৪ মে পর্যন্ত রাজ্যে মোট আক্রান্ত ১২৫৯, কো-মর্বিডিটি সহ মোট মৃত্যু ১৩৩, অর্থাৎ সিএফআর ১০.৫%। ভারতের যে রাজ্যগুলিতে করোনা সংক্রমণ সব থেকে বেশি, সেই মহারাষ্ট্রে যখন সিএফআর ৪%, গুজরাটে ৫.৫%, মধ্যপ্রদেশে ৫.৬%, তখন পশ্চিমবঙ্গে ১০%-র বেশি কেন?
গোটা বিশ্বে গড় সিএফআর এখন পর্যন্ত ৭.১%। সব থেকে বেশি মাত্রায় আক্রান্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫.৮%। ভারতের জাতীয় গড় ৩.২%। তাহলে কি পশ্চিমবঙ্গে করোনা মহামারীতে ব্রিটেন, ইতালি, স্পেনের মতন মড়ক লেগে গেছে? বাস্তব চিত্রটা কিন্তু আসলে এতটা ভয়াবহ নয়।
মৃত্যুহার বেশি হওয়ার প্রধান কারণ পশ্চিমবঙ্গ কোভিড-১৯ পরীক্ষা বা টেস্টিং-এর হিসেবে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। গতকাল অবধি গোটা দেশে স্যাম্পেল টেস্ট হয়েছে ১১ লক্ষ ৯১ হাজার। এর মধ্যে কোভিড-১৯ পজিটিভ ৪৬ হাজার ৪৩৩। অর্থাৎ প্রতি ১০০টি টেস্ট পিছু ৪ জন পজিটিভ বেরিয়েছে। মহারাষ্ট্রে এবং গুজরাটে এখন পর্যন্ত প্রতি ১০০টি টেস্ট পিছু ৭ জন পজিটিভ বেরিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে গতকাল অবধি টেস্ট হয়েছে মাত্র ২৫১১৬, করোনা পজিটিভ ১২৫৯। অর্থাৎ ১০০ টি টেস্ট পিছু ৫ জন পজিটিভ বেরিয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় যে পশ্চিমবঙ্গে করোনা সংক্রমণের হার জাতীয় হারের থেকে একটু বেশি হলেও মহারাষ্ট্র বা গুজরাটের মতন সর্বাধিক আক্রান্ত রাজ্যগুলির তুলনায় কম।
আসলে পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে বড় সমস্যা কোভিড-১৯ পরীক্ষা বা টেস্টিং-এর অত্যন্ত মন্থর হার। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যার ৭%। অথচ গোটা দেশের মোট কোভিড-১৯ পরীক্ষার তুলনায় এখন অবধি পশ্চিমবঙ্গে পরীক্ষার অনুপাত মাত্র ২%।
সারা দেশে যেখানে গত কয়েকদিনে গড়ে প্রতিদিন ৭০ হাজার কোভিড-১৯ পরীক্ষা হচ্ছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে হচ্ছে মাত্র ২০০০ করে। এর ফলে সমস্ত করোনা আক্রান্তদের সময় মতন চিহ্নিত করা হচ্ছে না। অথচ রাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী রাজ্যে কোভিড-১৯-এর জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল বেডের মাত্র ১৩% গতকাল অবধি ভর্তি হয়েছে। তাহলে পরীক্ষার হার বাড়ানোয় বাধাটা কোথায়। পরীক্ষার মন্থর হার নিয়ে ১৭ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে যুদ্ধকালীন তৎপরতা দেখাতে নির্দেশ দেয়। তা সত্ত্বেও পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হয়নি। রাজ্য প্রশাসন ‘কো-মর্বিডিটি’ মাপার জন্য অডিট কমিটি বসিয়ে সময় নষ্ট করেছে, প্রকৃত তথ্য গোপন করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এই জন্যেই আজ কেন্দ্রীয় দলের কাছে রাজ্য প্রশাসনকে সিএফআর নিয়ে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে।
দেশের বেশ কয়েকটি বড় রাজ্যে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় সরকারও এই বিষয়ে যে আত্মশ্লাঘা দেখিয়ে চলেছে সেটা বিপজ্জনক। এখন পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশে তুরস্ক, ইরান এবং চীনের পরে করোনা সংক্রমণে সব থেকে বেশি আক্রান্ত দেশ ভারত। দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ইত্যাদি বেশ কিছু এশিয়ার দেশ ইতিমধ্যেই সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। এতদিনের লকডাউন সত্ত্বেও ভারত সেটা পারেনি, মূলত বড় রাজ্যগুলির জন্য (কয়েকটি রাজ্য অবশ্য পেরেছে, যেমন কেরালা বা ওড়িশা)। এখন সংক্রমণ বৃদ্ধির মধ্যেই সর্বত্র লকডাউন শিথিল করতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি কোভিড-১৯ পরীক্ষার হার বাড়িয়ে প্রতিদিন অন্তত ৫০০০ টেস্ট না করতে পারে, তাহলে আগামীদিনে পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমণ অনেক বাড়বে। মৃত্যুর হার বা সিএফআর-এরও কোনো উন্নতি হবে না। টেস্টিং-এর হার আরও বাড়ানো নিয়ে দলমত নির্বিশেষে সকলেরই সোচ্চার হওয়া উচিৎ। নাহলে পরিস্থিতির অবনতি অনিবার্য।
তথ্যসূত্রঃ https://ourworldindata.org/coronavirus; https://www.wbhealth.gov.in/pages/corona/bulletin; https://www.mohfw.gov.in/
পশ্চিমবঙ্গে করোনা রোগে মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কে হেলথ সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন, পশ্চিমবঙ্গের বক্তব্য
বিশ্বজুড়ে করোনা অতিমারিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে চলেছে। আমাদের দেশেও তার ব্যতিক্রম নয়, আশঙ্কা এই অতিমারি দীর্ঘায়িত হবে। এই সঙ্কট মোকাবেলায় প্রয়োজন সঠিক বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা ও তার সার্থক প্রয়োগ। পরিকল্পনা ও প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও পরিসংখ্যান প্রস্তুতি। সেখানে ভুলভ্রান্তি থেকে গেলে কোনো মতেই সঠিক বিজ্ঞানসম্মত স্বাস্থ্য প্রকৌশল নির্মিত হতে পারে না। তথ্য ও পরিসংখ্যানের মধ্যে রয়েছে আক্রান্তের সংখ্যা, আক্রান্তের হার, মৃত্যুর সংখ্যা ও মৃত্যুর হার, মোট কত জনের পরীক্ষা হল, কতজন রোগাক্রান্ত চিহ্নিত হল, কতজনের কি কি চিকিৎসার প্রয়োজন হল বা হল না, কতজন সুস্থ হল, সুস্থ হতে কতদিন সময় লাগল, রোগমুক্ত ঘোষণা করতে কতজনকে কতবার পরীক্ষা করতে হল, কতজন পুনরায় রোগাক্রান্ত হল ইত্যাদি প্রভৃতি। তথ্য সংগ্রহ ও পরিসংখ্যান প্রস্তুতি যত সঠিক হবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল নির্মাণ তত বাস্তবসম্মত ও প্রায়োগিক হবে। এর ব্যতয় সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর, একান্তই অবাঞ্ছিত।
সারা বিশ্বেই করোনা রোগে বয়স্ক মানুষ বিশেষ করে যাদের বয়সজনিত রোগ যেমন ডায়াবেটিস, কিডনী, লিভার, হৃদরোগ আছে পরিভাষায় যাকে কো-মর্বিডিটি বলা হয় তাদের রোগ গুরুতর ও জটিল হয়ে যায় ও বহুক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটে। এসব রোগ যাদের থাকে তারা বিভিন্ন চিকিৎসা ও পরিবর্তিত জীবন শৈলীর নিয়ম মেনে দীর্ঘকাল প্রায় স্বাভাবিক, সার্থক ও উপার্জনশীল জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু করোনার আকস্মিক আক্রমণ এদের শরীরের প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা শক্তি বিপর্যস্ত হয়ে গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করে জীবনহানি ঘটায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এদের মৃত্যুকে করোনা সংক্রমণের কারণে মৃত্যু বলে চিহ্নিত করাটাই স্বাভাবিক রীতি ও পদ্ধতি। আ-বিশ্ব এটাই স্বীকৃত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ তাদের সাম্প্রতিক নথিতে করোনা রোগীর মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারিত করেছে। যে কোনো চিকিৎসাগত অসুখে মৃত্যু, যেক্ষেত্রে সম্ভাব্য অথবা নিশ্চিত রূপে করোনা ভাইরাসের প্রভাব রয়েছে, সে সব ক্ষেত্রেই করোনা রোগে মৃত্যু হিসাবে বিবেচিত হবে, যদি না কোনো স্পষ্ট বিকল্প কারণ (যেমন দুর্ঘটনা জনিত আঘাত ইত্যাদি) নিশ্চিত রূপে উপস্থিত থাকে। প্রতিটি মৃত্যুর শংসাপত্রেও আন্তর্জাতিক রোগ শ্রেণীবিভাগ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট ও সার্বজনীন কোডিং পদ্বতি (International Classification of Disease-10), অনুসরণ করা আবশ্যিক ও বাধ্যতামূলক। এই আন্তর্জাতিক নিয়মকে অস্বীকার করে অমান্য করে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও অসত্য তথ্য পরিবেশিত হতে দেখতে পেলাম আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে। করোনা আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যায় অবমূল্যায়ন ঘটানোর উদ্দেশ্যে মৃত্যুর সংখ্যায় কো-মরবিটির তত্ত্ব আমদানি করে করোনা সংক্রান্ত মৃত্যুকে কো-মরবিডিটি বা সংশ্লিষ্ট রোগে মৃত্যু হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে।
এ কথা ঠিক যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো পুরানো ও ক্রনিক অসুখে (ক্যান্সার ইত্যাদি) মৃত মানুষের করোনা টেস্ট পসিটিভ এলে মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ নির্ণয়নে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। সে সব ক্ষেত্রেও মৃত্যুর কার্যকারণে করোনা ভাইরাসের কোনরূপ প্রভাব থাকলে তা করোনা রোগে মৃত্যু হিসাবে বিবেচিত হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। আমরা মনে করি মহামারীর সময় সন্দেহসূচক ক্ষেত্রে, মৃত্যু হারের অবমূল্যায়নের থেকে কিছুটা সম্ভাব্য অতিমুল্যায়ন বরং বাঞ্ছনীয়। এবং এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা প্রয়োজন।
দুঃখের বিষয়, অতিমারীর এই চূড়ান্ত সংকটকালে, করোনা মৃত্যুর হারের অবমুল্যায়নের যে প্রবৃত্তি ও প্রবণতা প্রশাসনের তরফে দেখা যাচ্ছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বিষয়টির সাথে আমাদের রাজ্য, দেশ তথা সমগ্র মানবসমাজের সামগ্রিক কল্যাণ ও অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত; যা একই সঙ্গে প্রকাশ করে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, রুচি ও সংস্কৃতির পরিচয়কে। এছাড়াও মৃত্যুর সঠিক ও যথাযথ কারণ নির্ধারণ ও তার প্রত্যায়িত পঞ্জিকরণ মৃতের পরিবারের পরবর্তী জীবনযাপনের বহু সংশ্লিষ্ট বিষয়কে প্রভাবিত করে।
১) রোগ মহামারীর যথাযোগ্য নিয়ন্ত্রণকল্পে উপযুক্ত পরিকল্পনায় সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও তার নিরপেক্ষ ও নির্মোহ বিশ্লেষণ একান্ত প্রয়োজন। এর সাথে যুক্ত হয়ে আছে অসংখ্য মানুষের জীবন, জীবিকা এবং দেশ তথা সমগ্র মানব সমাজের ভবিষ্যৎ। মহামারীর তীব্রতা ও ভয়াবহতাকে কৃত্রিম ভাবে অবমূল্যায়ন করে সাময়িক স্বস্তি হতে পারে, কিন্তু তা সমাজের পক্ষে ভয়ঙ্কর বিপদের সম্ভাবনা তৈরি করে।
২) মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে মৃতের পরিবার বীমার ক্ষতিপূরণে অসুবিধায় পড়তে পারেন, যা একেবারেই কাম্য নয়।
৩) করোনা চিকিৎসায় সামনের সারিতে যেসব চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী ও অন্যান্য কর্মচারিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলেছেন; তাদের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ বীমার প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। এদের মধ্যে চল্লিশ ঊর্ধ্ব প্রচুর ব্যক্তি রয়েছেন, যারা প্রকৃতই অত্যন্ত বিপদের সম্মুখীন। কর্তব্যরত অবস্থায় এদের অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক মৃত্যুতে, মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে বীমা রাশির থেকে এদের পরিবার বঞ্চিত হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
আমরা অতীতেও দেখেছি মানুষের অকাল ও অনভিপ্রেত মৃত্যু নিয়ে সরকারী দায় ও দায়িত্ব অস্বীকার এবং প্রকৃত পরিস্থিতিকে লঘু করে দেখানোর অনেক উদাহরণ। দেশ ও রাজ্যে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনাগুলি তার মধ্যে অন্যতম। আমরা আশা করবো, পশ্চিমবঙ্গ সরকার উপরিউক্ত বিষয়গুলি গুরুত্বের সাথে বিচার বিবেচনা করবেন এবং এই মহামারীর মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি ও সহানুভূতির নিদর্শন রাখবেন।