খেলার মাঠের জিনিয়াস খেলোয়াড় চুনী গোস্বামী
chuni

৩০ এপ্রিল ২০২০, ক্রীড়া ইতিহাসের এক অত্যন্ত বেদনাদায়ক দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকল। করোনাগ্রাসের ভয়াবহতার মধ্যে এক অত্যন্ত বেদনাদায়ক খবর এল চুনী (সুবিমল) গোস্বামীর মৃত্যুতে। প্রায় একমাস আগে এরকমই আরেক শোকবহ খবর এসেছিল ২০ মার্চ, প্রদীপ কুমার ব্যানার্জীর জীবনাবসানে। ভারতীয় ফুটবলের দুই মহাতারকা, যাঁরা দেশের জার্সি গায়ে একসময় পাশাপাশি খেলেছিলেন এবং ভারতীয় ফুটবলকে তুলেছিলেন খ্যাতির শিখরে সেই দু’জন আজ প্রয়াত, শুধু পড়ে থাকল তাঁদের সৃষ্টি করা গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

চুনী গোস্বামীর জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার সুবিখ্যাত কিশোরগঞ্জে (এখানেই ছিল বাংলার সুবিখ্যাত রায় বংশের আদি বাড়ি, যে বাড়ির কৃতি সন্তানরা ছিলেন সারদারঞ্জন রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ)। ১৯৩৮ সালের ১৫ই জানুয়ারী। বাঙাল পরিবারে জন্ম হলেও চুনী গোস্বামীর ফুটবল জীবন পুরোটাই অতিবাহিত হয় সবুজ-মেরুন জার্সিতে গঙ্গাপারের ক্লাবে। চুনী এবং তাঁর দাদা মানিক (সুনির্মল) গোস্বামী মোহনবাগানের জার্সিতে একসঙ্গে দীর্ঘদিন খেলেছেন। ১৯৪৬ সালে মাত্র আট বছর বয়সে মোহনবাগানের জুনিয়র টিমে চুনী গোস্বামীর ফুটবল কেরিয়ারের সূচনা। ১৯৫৪ সাল থেকে খেলতে শুরু করেন মোহনবাগানের সিনিয়র টিমে। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত এই একই জার্সিতে ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে বহু অনন্য নজির সৃষ্টি করেন তিনি। তবে চুনী গোস্বামীর কাছে একসময় টটেনহ্যাম হটস্পারের মত ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের দলের অফারও ছিল। কিন্তু তিনি কোনওদিন সবুজ-মেরুন জার্সিকে ত্যাগ করেননি। মোহনবাগানের জার্সি গায়ে পূর্ব আফ্রিকা ও দূর প্রাচ্য সফরেও যথেষ্ঠ কৃতিত্বের পরিচয় দেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফরোয়ার্ড। ভারতের ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ফুটবলেও মোহনাবাগানের বহু ট্রফি জয়ের কান্ডারী ছিলেন তিনি। এর মধ্যে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন চুনী গোস্বামী।

দেশের জার্সিতে ভারতীয় ফুটবল দলে চুনী গোস্বামীর আবির্ভাব ঘটে ১৯৫৬ সালে চিনের অলিম্পিক ফুটবল দলের বিরুদ্ধে। ১৯৫৮-র টোকিও এশিয়াডে তিনি ভারতীয় ফুটবল দলের নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড হয়ে ওঠেন। ১৯৬০-র রোম অলিম্পিকেও তিনি ভারতীয় ফুটবল দলের নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড ছিলেন। তবে তাঁর ফুটবল কেরিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় ছিল ১৯৬২ সাল। ঐবছর প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জাকার্তা এশিয়ান গেমসে ফুটবলে রহিম সাহেবের প্রশিক্ষণে ও চুনী গোস্বামীর অধিনায়কত্বে দ্বিতীয়বার (প্রথমবার ১৯৫১ সালে শৈলেন মান্নার অধিনায়কত্বে দিল্লীর প্রথম এশিয়ান গেমসে) এবং এখনও পর্যন্ত শেষবারের মত সোনার পদক জয় করে ভারতীয় ফুটবল দল, ফাইনালে ফেভারিট দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে। (ভারত এশিয়ান গেমসের ফুটবলে এখন পর্যন্ত শেষ পদক পায় ১৯৭০ সালে ব্রোঞ্জ জয় করে।) সেমিফাইনালে ভারত কঠিন লড়াই করে দক্ষিণ ভিয়েতনামেকে ৩-২ গোলে হারিয়ে। এই ম্যাচে ভারতের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন চুনী গোস্বামী। ভারতের ৩টি গোলের মধ্যে ২টি গোলই করেন তিনি। এই সময় ভারতীয় ফুটবলের তিন প্রধান স্তম্ভ ছিলেন চুনী-পিকে-বলরাম। এই তিনটি নাম এইসময়ে প্রায় সম্মুচ্চারিত হত। ১৯৬২ সালে চুনী গোস্বামী এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ফরোয়ার্ডের সম্মান লাভ করেন। ১৯৬১ সালে অর্জুন পুরস্কার চালু হওয়ার পর প্রথম বছর ফুটবলে অর্জুন পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রদীপ কুমার ব্যানার্জী। ১৯৬৩ সালে দ্বিতীয় বাঙালি ফুটবলার হিসাবে অর্জুন হলেন চুনী গোস্বামী। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ৪৩টি ম্যাচে ভারতের জার্সি গায়ে অবতীর্ণ হয়ে মোট ১১টি গোল করেছিলেন তিনি। ১৯৬৪-র মারডেকা কাপের পর আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।

চুনী গোস্বামী ছিলেন সত্যিকারের জিনিয়াস খেলোয়াড়। ফুটবলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর ভারতের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও বাংলার ও পূর্বাঞ্চলের হয়ে বিশেষ কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন তিনি। ছাত্রাবস্থায় রোহিংটন বারিয়া টুর্নামেন্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ১৯৬২-৬৩-র রঞ্জি মরশুমে বাংলার হয়ে ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ করেন ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাট এবং মিডিয়াম ফাস্ট বোলার চুনী গোস্বামী। ইডেনে রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনালে হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে রয় গিলক্রিস্টের আগুনে ফাস্ট বোলিং সামলে প্রথম ইনিংসে করেছিলেন মূল্যবান ৪১ রান (এই ম্যাচে জয়সীমার নেতৃত্বাধীন হায়দ্রাবাদের দুর্ধর্ষ বোলিং-এর বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করে বাংলার জয় নিশ্চিত করেছিলেন বাংলার আরেক কৃতি ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব পঙ্কজ রায়, যিনি আবার স্পোর্টিং ইউনানের হয়ে ফুটবল খেলেছিলেন নিজের প্রথম যৌবনে এবং ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে খেলায় তাজ মহম্মদের ট্যাকেলে ভয়ানক চোট পেয়ে ফুটবল ছেড়ে ক্রিকেটে চূড়ান্ত মনসংযোগ করে ১৯৫০-র দশকে হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের নির্ভরযোগ্য ওপেনার।)। এই ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে মোট তিনটি উইকেটও অর্জন করেছিলেন চুনী গোস্বামী।

১৯৬৬ সালের ২৬ থেকে ২৮ ডিসেম্বর ইন্দোরে আয়োজিত প্রথম শ্রেণীর ট্যুর ম্যাচে সফররত কানহাই, লয়েড, হল, গ্রিফিথ, কলিমোর প্রমুখ সমৃদ্ধ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে ইনিংসে হারিয়ে দিয়েছিল পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চল-এর মিলিত একাদশ। এই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে শেষ করে দিয়েছিলেন দুই বাঙালি ক্রিকেটার সুব্রত গুহ ও চুনী গোস্বামী। ব্যাটে ২৫ রান করার পাশাপাশি বলে এই ম্যাচে মোট আট উইকেট নিয়েছিলেন চুনী গোস্বামী (প্রথম ইনিংসে ৫ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৩), সুব্রত গুহ নিয়েছিলেন ম্যাচে এগারো উইকেট। ১৯৭১-৭২-এর রঞ্জি মরশুমে চুনী গোস্বামীর অধিনায়কত্বেই বাংলা ফাইনালে উঠেছিল। কিন্তু বোম্বের কাছে হেরে সেবার রানার্স হয়েই বাংলাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৯৬২-৬৩ মরশুম থেকে ১৯৭২-৭৩ মরশুম পর্যন্ত খেলেছেন চুনী গোস্বামী। ৪৬টি প্রথম শ্রেণীর খেলায় ২৮.৪২ গড়ে ১টি শতরান ও ৭টি অর্ধশতরানসহ মোট করেছেন ১৫৯২ রান এবং মিডিয়াম পেস বলে ২৪.০৮ গড়ে অর্জন করেছেন মোট ৪৭টি উইকেট।

ফুটবল-ক্রিকেটের পাশাপাশি জাতীয় স্তরে টেনিসেও যথেষ্ঠ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন তিনি। সাউথ ক্লাবের অন্যতম নিয়মিত টেনিস তারকা ছিলেন তিনি। খেলা ছাড়ার পরও যুক্ত ছিলেন খেলার সঙ্গে। তিনি ও পিকে একইসঙ্গে ডেটমার ফেইফারের প্রশিক্ষণাধীনে কোচিং ডিগ্রি অর্জন করে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন টাটা ফুটবল একাডেমীর ডিরেক্টর। খেলার পাশাপাশি তাঁর লেখনীও ছিল ভীষণ সাবলীল। যা তাঁর লেখা বই ‘খেলতে খেলতে’ সহজেই প্রমাণ করে। ব্যবহারে অমায়িক হলেও নিজের ক্রীড়ারীতি ও প্রতিভা সম্পর্কে যথেষ্ঠ উচ্চ ধারণা ছিল তাঁর এবং সেকথা তিনি বহু সাংবাদিককে বহু সময়ে খোলাখুলি বলেছেন। ২০০৫ সাল তাঁর জীবনের এক উল্লেখযোগ্য বছর। এই বছর একদিকে তিনি কলকাতার শেরিফের সম্মানীয় পদ অলঙ্কৃত করেন আবার এই বছরই তাঁর প্রিয় ক্লাব মোহনবাগান তাঁকে ‘মোহনবাগানরত্ন’ সম্মানে ভূষিত করে। ২০১০ সালের মোহনবাগান দিবসের অনুষ্ঠানে বহু বছর পর নিবিড় আলাপচারিতায় দেখা গিয়েছিল ভারতীয় ফুটবলের চারস্তম্ভ শৈলেন মান্না, পি কে ব্যানার্জী, চুনী গোস্বামী ও অমল দত্তকে। সারাজীবন ভীষণ কর্মদ্যোমী থাকার পর বিগত কিছু সময় শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে কষ্ট দিচ্ছিল। অবশেষে ৩০ এপ্রিল বিকেল পাঁচটায় হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দিল ভারতীয় ক্রীড়া জগতের হৃদয় জয় করা এই মানুষটির।

খণ্ড-27