কৃষি-সংস্কার ও আত্মনির্ভরতার নামে কর্পোরেটমুখী পুনর্গঠন
kri

গ্রীষ্মের প্রবল তাপে, কখনো বৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টিকে মাথায় নিয়ে চাষিরা মাঠে সোনালী ধান ফলিয়েছে, উৎপাদন করেছে বিভিন্ন ধরনের সব্জি। এই করোনা মহামারী লকডাউনের মধ্যে কৃষকরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে খাদ্য যুগিয়ে গেছে। কারণ কৃষিকাজ কখনই থেমে থাকতে পারে না। এ কথা বহুল প্রচারিত যে, কৃষি নাকি আজ আর লাভজনক নয়, কৃষি থেকে আমাদের শিল্পের দিকে এগিয়ে যেতেই হবে। এভাবে কৃষির গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে অবজ্ঞা করা হয়ে থাকে। কিন্তু লকডাউনের সময়কালে খাদ্য সরবরাহের গুরুত্ব নতুন করে টের পাওয়া গেলো। বাস্তবে কৃষিক্ষেত্রই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখলো। গ্রামে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত শ্রম সৃষ্টি হওয়ার কারনে যারা ভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে গিয়েছিলো তারা এখন পুনরায় গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। ফলত গ্রামে শ্রম আরও উদ্বৃত্ত হবে, মজুরি আরও নিম্নগামী হবে, যে কোনো উপায়ে পেটের খিদে মেটানোতে নিযুক্ত থাকাই নিয়তি হয়ে উঠবে, দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হবে। এই বিপুল পরিমাণ শ্রমশক্তি কোথায় নিযুক্ত হবে তা নিয়ে কোনও চিন্তা সরকারগুলির আছে কি? এরা তো আমাদের দেশের মূল্যবান শ্রমসম্পদ! এই বিপুল শ্রমশক্তিকে কৃষি ও গ্রামীণ পরিকাঠামো নির্মাণের কাজে ব্যবহার করার কোনো পরিকল্পনা সরকার নিলো কি? দেশের অন্নদাতারা তাঁদের রক্তঘামে উৎপাদিত ফসলের লাভজনক দাম পেয়েছে কি? লকডাউনের সময়কালে চাষিদের, পোল্ট্রি বা গবাদি পশু পালকদের যে বিপুল লোকসান হয়েছে তার কোনো ক্ষতিপূরণ সরকার দিলো কি? আদৌ না। উল্টে মোদী সরকার ঢাক ঢোল পিটিয়ে কৃষি উন্নয়নের এক “প্যাকেজ” ঘোষণা করলো। এই প্যাকেজেও বাস্তবে দেখা গেলো লকডাউনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চাষিদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে চরম সর্বনাশের পথে। চাষির সর্বনাশ আর কর্পোরেটদের পৌষ মাস। বাণিজ্যিক পুঁজির প্রতিনিধিরা কৃষিজাত পণ্যের যে ফাটকা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কব্জায় চাষিদের ঠেলে দেওয়া হলো। পাইকারি ও খুচরো ব্যবসায় বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশ ও তার হাত ধরে বাণিজ্যিক পুঁজির ফাটকা কারবার ভারতে ক্রমশ বেড়েই চলছিলো। এখন করোনা হয়ে উঠেছে শাসকের কাছে একটা হাতিয়ার। এক ধাক্কায় কৃষিকে কর্পোরেটমুখী পুনর্গঠনের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। তার গাল ভরা নাম দেওয়া হলো “কৃষক কল্যাণ”। এক দিকে কৃষি উৎপাদনের খরচ বেড়েই চলেছে, অথচ ফসলের লাভজনক দাম নেই। মাঠে চাষিরা সব্জির যে দাম পাচ্ছে সেটাই সামান্য দুরের শহরে গঞ্জে বিক্রি হচ্ছে ১০ গুণ বেশি দামে! করোনা লকডাউনের শুরু থেকে লাগাতার ১৫/২০ দিন ধরে গ্রামে এক মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা গেলো, ২ টাকা ৩ টাকা দামে সব্জি বিক্রি হচ্ছে, চাষিরা ফসল বিনা পয়সায় বিলিয়ে দিচ্ছে। এই চাষিরা কোনোরকম ক্ষতিপূরণ পেলো না।

sale

 

এখন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করলেন, কৃষিকে নাকি আত্মনির্ভর করে তুলবেন। আত্মনির্ভর? নাকি বাজারের মুনাফাখোর শক্তিগুলির উপর চূড়ান্ত নির্ভরতা? তিনি ঘোষণা করলেন, কৃষক মান্ডিগুলির কর্তৃত্ব নাকি ভেঙ্গে ফেলা হবে – যাতে নিজেদের পছন্দ অনুসারে চাষিরা তাঁদের ফসল স্বাধীনভাবে বাজারে বিক্রি করতে পারবে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত মান্ডিগুলিতে চাষিরা আর ফসল বিক্রি করতে বাধ্য থাকবে না। একথার অর্থ আসলে উল্টো। আসলে বলা হচ্ছে যে সরকার আর কৃষকের ফসল কিনতে বাধ্য থাকবে না। কৃষি পণ্যের আন্তঃরাজ্য ব্যবসা এবং ই-ট্রেডিং তথা বানিজ্যের ঢালাও অনুমোদন দেওয়া হবে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুত করার সীমা তুলে দেওয়া হবে। অবাধ করা হবে কৃষি পণ্যের আমদানি রপ্তানি। তুলে দেওয়া হবে সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যদ্রব্যের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ। এজন্য সংশোধন করা হবে ১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন। ভালো ভালো কথার আড়ালে এগুলি হলো সেই অতি পরিচিত উদারীকরণ-বেসরকারীকরণের যুক্তিজাল। দেশজুড়ে কৃষকরা যখন চাইছে সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করুক। সঠিক ভাবে উৎপাদন খরচের দেড়গুন দাম হিসাব করুক। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী করে সরকার দেড়গুণ দামে ফসল কেনা সুনিশ্চিত করুক, গ্রহণ করুক ঋণমুক্তির দায়। এই দাবিগুলি আজও অধরা হয়ে আছে। এই সমস্ত দাবিতে দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলন চলছে। তা সত্বেও কাগজে কলমে কৃষকের যতটুকু অধিকার ছিলো সেটাকেও আজ সম্পূর্ণ লোপাট করে দেওয়া হবে। কালো বাজারি মজুতদারী আইনি বৈধতা পেয়ে যাবে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন গত দুই মাসে ৭৫০০ কোটি টাকা ফসলের সরকারী সংগ্রহে ব্যায় হয়েছে। বাস্তবে এই টাকার সিংহভাগই কৃষকরা পায়নি। কৃষকের থেকে কম দামে ফসল কিনে সরকারকে বিক্রি করে মহাজনরা মুনাফার টাকা পকেটে পুরেছে। এক সমীক্ষায় জানা গেছে চাষিরা সহায়ক মূল্য কুইন্টাল পিছু ৭০০-৮০০ টাকা কম পেয়েছে। এছাড়া বিপুল পরিমানে কৃষি ঋণ দেওয়া হবে বলা হয়েছে। বাস্তবে ২৫-৩০ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার প্রাতিষ্ঠানিক কৃষিঝণ নেয়। বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠরা রয়েছে মহাজন নির্ভর। এছাড়া প্রচুর প্রকল্পর কথা ঘোষণা করা হয়েছে যেগুলি পুরাতন ঘোষিত প্রকল্প।

paddy

 

কৃষি পণ্যের সরকারী সংগ্রহ ব্যবস্থা এবং ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ জরুরি কেন? কারণ তা কৃষককে অভাবী বিক্রির বিপদ থেকে খানিকটা হলেও রক্ষা করতে পারে। যদি অতিরিক্ত উৎপাদনের কারনে ফসলের দাম কমে যায় তাহলে সেটা চাষিদের ন্যূনতম লাভ করার একটা গ্যারান্টি দিতে পারে। সরকারী সংগ্রহমূল্য বাজারের দামের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করে। ৭ রকমের দানা শস্য ৫ রকমের ডাল ও ৮ রকমের তৈলবীজ- মোট ২৪ টি কৃষিপণ্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আওতায় রয়েছে। এই সরকারী সংগ্রহর ব্যবস্থাপনার সাথে গণবণ্টন তথা রেশন ব্যাবস্থা ও মিড-ডে-মিল প্রকল্প অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। শুধু তাই নয় এটা ফসলের দাম না পাওয়ার ঝুঁকির হাত থেকে চাষিদের বাঁচানোর জন্য এক ধরনের বীমা বা সুরক্ষাও বটে। এই গোটা বিষয়টা গ্রাম শহরের দরিদ্র মানুষের জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এছাড়া চাষিরা যদি লাভজনক দাম পায় সেটা কৃষি উৎপাদনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। এখন যে কেন্দ্রীয় নীতি ঘোষণা করা হলো সেটা অতিমারীজনিত আর্থিক ও শিল্প ক্ষেত্রের মন্দা কাটাতে কৃষিকে লুঠ করার নীল নকশা ছাড়া আর কিছু নয়। পূঁজিপতিদের অতিমুনাফা সৃষ্টির জন্য সমগ্র কৃষক সমাজকেই বলি দেওয়া হলো। কৃষি ক্ষেত্রে বরাদ্দ অর্থ বিগত বাজেটেই ৭৪ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এখন ভর্তুকিশূন্য কৃষি এবং গণবণ্টন ব্যবস্থাকে ধাপে ধাপে তুলে দেওয়ার পথে সরকার এগিয়ে গেলো। ফলে গ্রামীণ মহাজন ফড়ে দালাল মিল মালিক থেকে শুরু করে মনসান্টো, কার্গিল, ওয়ালমার্ট, রিলায়েন্সের মতো কোম্পানিরা কৃষি ও কৃষকদের লুঠ করার অবাধ স্বাধীনতা পাবে। ইতিপূর্বেই চাষের উপকরণের বাজারে ওদের একচেটিয়া দখলদারী কায়েম হয়ে আছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কৃষিজমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নীতিতে পরিবর্তনের কথা মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। এতে চুক্তিচাষকে আইনি পরিধির মধ্যে আনা হবে। ফলে দেশী বিদেশী পুঁজিপতিদের স্বার্থে জমি অধিগ্রহণ বৈধতা পাবে। কৃষক পরিণত হবে চুক্তি চাষিতে। বলা হচ্ছে সংস্কারের ফলে কৃষক নাকি স্বাধীনভাবে ফসলের লাভজনক বাজার পাবে। কিন্তু কৃষি পণ্যের অবাধ আমদানী দেশের কৃষককে প্রতিযোগিতায় ছিটকে দূরে ফেলে দেবে। দূধ মাংস চামড়ার ব্যবসা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশ এবং তাদের সাথে গাটছড়া বাঁধা দেশীয় পূঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। দেশের চাষি ফসলের যে দাম পায় তার ডবল দামে বিদেশ থেকে কৃষিপণ্য আমদানী করা চলতে থাকবে। এসবের ফলে চূড়ান্ত অভাবী বিক্রি-ঋণফাঁদে কৃষকের আত্মহত্যার মিছিল বাড়তেই থাকবে। এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারও কৃষি বিপনন আইন সংশোধন করে কৃষিপণ্য ব্যবসায় বড় পুঁজিপতিদের অনুপ্রবেশের রাস্তা খুলে দিয়েছে। বড় বড় কথার আড়ালে চলছে কৃষকের প্রতি বঞ্চনা আর অবহেলা।

কিন্তু না। বিজেপির লুঠতন্ত্রের এই অশ্বমেধের ঘোড়াকে রুখে দিতে গড়ে উঠবেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকের পাল্টা প্রতিরোধ। এই হৃদয়হীন, অবিসংবেদী, চরম নির্মম সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেই মোকাবিলা করে বাঁচাতে হবে দেশটাকে।

-- জয়তু দেশমুখ

খণ্ড-27