এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে একমাত্র আলোচ্য বিষয় করোনা। একদিকে যেমন ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য কর্মীরা চেষ্টা করছেন করোনায় আক্রান্ত মানুষদের সারিয়ে তুলতে অন্যদিকে তেমনি বিজ্ঞানীরাও চেষ্টা করছেন কী করে প্রতিষেধক তৈরি করা যায়। এর পাশাপাশি প্রযুক্তিবিদেরাও নিজেদের মতো করে ভাবছেন কী করে কোনও প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা যায় যা দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কিছুদিন আগে বলা হয়েছে যে নাগরিকদের একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তাঁদের ফোনে ডাউনলোড করতে হবে তাহলে নাকি বোঝা যাবে কোথায় কোথায় করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিলেন সেখানেও তিনি বিশেষ করে উল্লেখ করলেন এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন সম্পর্কে যার নাম সরকারীভাবে রাখা হয়েছে – আরোগ্য সেতু। এই সেতু বন্ধনের মধ্যে দিয়ে নাকি করোনা সংক্রমণ রোখা যাবে। তৃতীয় দফায় যে লকডাউন ঘোষিত হয়েছে তাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফ থেকে বলা হয়েছে যে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারি নয়, বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার কর্মীদেরও বাধ্যতামূলক ভাবে নিজেদের ফোনে আরোগ্য সেতু নিতে হবে। বিরোধী দলেরা স্বভাবতই এর বিরোধিতা করেছেন। বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই বিষয়ে চিঠিও গেছে। একদল বলা শুরু করেছেন সেই একই যুক্তি দেখিয়ে যে কারুর যদি লুকোনোর মতো কিছু না থাকে তাহলে আপত্তি কোথায়? এই একই যুক্তি দেখানো হয়েছিল আধারের সময়ে, একই যুক্তি দেখানো হয়েছিল নোটবন্দীর সময়ে, কিন্তু সবকটি ক্ষেত্রেই কি এটা প্রমাণিত হয়নি যে আসলে ওগুলো দিয়ে দুর্নীতি কমে না। আরোগ্য সেতুর ক্ষেত্রেও যখন এক যুক্তি দাঁড় করানো হচ্ছে তখন কি এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলাটা সময়ের দাবি হয়ে উঠছে না?
বিতর্কটি বুঝতে গেলে প্রথমে বুঝতে হবে কি ভাবে আরোগ্য সেতু কাজ করবে সেই বিষয়টিকে। সরকার বলছে যে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ‘জিওফেন্সিং’ পদ্ধতির সাহায্যে পৃথকীকরণ করতে হবে, তাই এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন দেশের সমস্ত নাগরিকদের নাকি নিজেদের ফোনে এই আরোগ্য সেতু রাখাটা জরুরি। যদিও দক্ষিণ কোরিয়া এবং বেশ কিছু দেশ এই পদ্ধতি মেনেই কিছুটা সংক্রমণ প্রশমিত করেছে, কিন্তু ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে এই পদ্ধতি কি খুব কার্যকর হবে? নাগরিকেরা কেন এই প্রশ্নটা করছেন না, যে এই অ্যাপ্লিকেশন কি করোনা পরীক্ষার বিকল্প হতে পারে? এটা কি আসলে বিতর্কটিকে অন্যদিকে চালনা করার জন্য কোনও পদ্ধতি? যেই দেশে স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা সারা দেশের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশের কাছাকাছি সেখানে এই ধরনের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন কতটা ভালো কাজ করবে সেটা কি প্রশ্নাতীত?
প্রথমত যারা এই অ্যাপটি নিজেদের মোবাইলে স্থাপন করবেন, তাঁদের নাম, বয়স, লিঙ্গ এবং ফোন নম্বর দিয়ে নিজেকে নথিভুক্ত করতে হবে। সেই মানুষটির যদি কোনও শারীরিক অসুবিধা থাকে, ধরা যাক তিনি হার্টের রুগী বা ডায়াবেটিক বা অন্য কোনও সমস্যা আছে, সেগুলোও জানাতে হবে। তারপর বলা হবে যে তাঁর ফোনকে চালু রাখতে হবে সারাক্ষণ, যাতে এটা বোঝা সম্ভব হয় যে সেই মানুষটি কোথায় কোথায় যাতায়াত করছেন। অনেকেই বলছেন যে এই আরোগ্য সেতু দিয়ে মানুষকে নজরদারি করা হবে, ফরাসি একজন হ্যাকার দেখিয়ে দিয়েছেন যে এই আরোগ্য সেতুতে নেওয়া নাগরিকদের তথ্য আদৌ সুরক্ষিত নয়, কিন্তু সরকার কোনও কিছুই মানতে রাজি নয়। তাঁরা বিবৃতি দিয়ে চলেছেন যে সমস্ত কিছু সুরক্ষিত। ঠিক যেমন ভাবে তাঁরা বলেছিলেন যে নোটবন্দীতে কালো টাকা ফিরে আসবে, আধার দিয়ে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হবে ইত্যাদি আজও একইভাবে বলে চলেছেন যে আরোগ্য সেতু নিলেই নাকি মানুষ করোনাকে ঠেকাতে সক্ষম হবে। কিন্তু ঘটনাটা কি সত্যিই তাই? এর পাশাপাশি যেভাবে বেশিরভাগ মানুষ এই আরোগ্য সেতু নিজেদের ফোনে ডাউনলোড করছেন তাতে কি আদৌ মনে হচ্ছে যে মানুষেরা নজরদারি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত? আমাদের মতো দেশে কোনও নাগরিকের কোনও তথ্য যদি কেউ জেনে নেয় বা সেগুলো চুরি হয় এগুলো নিয়ে হয়তো বেশির ভাগ মানুষ চিন্তিতই নন। কিন্তু সত্যিই কি চিন্তার কোনও কারণ নেই? অবশ্যই আছে। ধরা যাক কোনও একজন মানুষ আরোগ্য সেতু ডাউনলোড করার সময়ে জানালেন যে তিনি বিভিন্ন রোগে এমনিতেই আক্রান্ত। কিংবা ধরা যাক কিছুদিন পরে আক্রান্ত হলেন তাহলে এই আরোগ্য সেতু দিয়ে সরকারের কাছে কিংবা ওই বেসরকারী সংস্থা যদি সেই তথ্য হেলথ ইনশিউরেন্স কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয় তাহলে সেই কোম্পানি নাগরিকদের কাছ থেকে কম প্রিমিয়াম নেবে না বেশি নেবে? এখনকার সময়ে কোনও নাগরিক সাধারণভাবে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সুস্থ হয়ে বাইরে আসার পর দেখলেন তাঁর শরীরে মধুমেহ বেড়েছে, এবং এর পর থেকে তাঁকে নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। তাহলে কি ইনশিউরেন্স কোম্পানি তার পরের বছরের প্রিমিয়াম সেই ব্যক্তির থেকে বেশি নেবে? এখনকার সময় হলে না, কিন্তু আরোগ্য সেতু থাকা অবস্থায় সমস্ত তথ্য তো ওদের হাতে তখন কি তাঁরা ছেড়ে দেবেন? কিংবা ধরা যাক একজন নাগরিক কী কী ওষুধ নিয়মিত খান সেটা যদি এই আরোগ্য সেতুর মাধ্যমে জানা যায় তাহলে কি সেই মানুষটি কোনো রোগে আক্রান্ত সেটা বোঝা খুব কঠিন ব্যাপার?
সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টি নিয়ে অনেকেই কথা বলেননি, তা হল এই অ্যাপটি একটি সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি। আমাদের মতো দেশে যেখানে শুধু করোনা আক্রান্ত এই সন্দেহে একেক জন মানুষকে গ্রাম ছাড়া করা হয়, বা অবসাদে কোনও কোনও মানুষ আত্মহত্যাও করছেন এই খবরও পাওয়া যাচ্ছে সেখানে এই ‘আরোগ্য সেতু’ অ্যাপটি কি মানুষে মানুষে আরও দূরত্ব বাড়াবে না? একজন মানুষ যদি জানতে পারেন তাঁর পাশের মানুষটি করোনা আক্রান্ত তাহলে কি মব লিঞ্চিঙ বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটবে না সেই নিশ্চয়তা দেওয়া যায়? যে দেশে শুধু খাদ্যাভাসের কারণে একের পর এক গণহত্যা ঘটে, সেখানে কে করোনায় আক্রান্ত, কে সংখ্যালঘুদের কোন সমাবেশে হাজির ছিল সেটাও যদি বোঝা যায় তাহলে একজন নাগরিকের জীবন কি অসুবিধায় পড়তে পারে না?
তাহলে এই প্রযুক্তি দিয়ে যে নজরদারি হবে না সেই কথাটা কি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়? যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে স্বাস্থ্য যৌথ তালিকাভুক্ত, কিন্তু এক্ষেত্রে রাজ্যগুলোও সম্পূর্ণ অন্ধকারে। রাজ্য সরকারগুলি এখনও এরকম কোনও নির্দেশিকা পায়নি যে এই আরোগ্য সেতু সবাইকে নিতে হবে, তাই তাঁরা কি করবে সেটাও এখনও স্বচ্ছ নয়। তাহলে কি এটা বলা অতিশয়োক্তি হবে যে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য একটি কেন্দ্রীভুত তথ্য ভান্ডার বানানো যার মধ্যে দিয়ে সে শুধু নাগরিকদের নজরদারি করবে আর কিছু নয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কি কোনও নাগরিককে বাধ্য করতে পারে এই ধরনের কোনও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নিতে? জাতীয় বিপর্যয় আইন ২০০৫-এর যে আইনকে দেখিয়ে এই কথা বলা হচ্ছে যে সতর্কতা মূলক অঞ্চলে বা লাল অঞ্চলে প্রত্যেকটি নাগরিকের যেন আরোগ্য সেতু থাকে সেটা কি এই আইনে বলা যায়? এক কথায় উত্তর না, বলা যায় না। কারণ এই জাতীয় বিপর্যয় আইনও সংবিধানের যৌথ তালিকায় পড়ে, অর্থাৎ কেন্দ্র আইন বলবৎ করতেই পারে, কিন্তু রাজ্যগুলোকে তাঁকে অনুরোধ করতে হবে যাতে রাজ্যগুলো তা মেনে চলে। এক্ষেত্রে আরও একটি বক্তব্য থেকে যায় যে কোনও সরকার কোনও নাগরিককে এই অত্যন্ত ব্যক্তিগত তথ্য সরকারকে দিতে বলতে পারে না আইনত, এবং কর্মক্ষেত্রেও কোনও কোম্পানির মালিক এই তথ্য চাইতে পারেন না। শুধুমাত্র বেতন সংক্রান্ত কোনও তথ্য ছাড়া অন্য যে কোনও তথ্য কোনও সংস্থার মালিক চাইতে পারেন না। কারণ ২০১৭ সালের যে প্রাইভেসি বিল আনার কথা হয়েছিল, যা আপাতত যৌথ সংসদীয় কমিটির বিবেচনাধীন আছে সেই অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি নাগরিকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য একান্তই গোপনীয় এবং ব্যক্তিগত তথ্য। ইচ্ছে করলে যে কোনও নাগরিক তাঁর মালিককে কোর্টে নিয়ে যেতে পারে শুধু মালিক যদি দেখতে চান যে তাঁর কর্মচারির মোবাইল ফোনে আরোগ্য সেতু আছে কি না। ২০১৭ সালে ৯ সদস্যের যে বেঞ্চ প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার রায় দিয়েছিলেন সেই বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। তিনি বলেছিলেন যে কোনও আপৎকালীন বা জরুরি পরিস্থিতিতে সরকার তথ্য চাইলেও তাঁকে আগে বলতে হবে যে এই তথ্য তাঁরা অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করবেন না, এবং কোনও নাগরিকের কোনও তথ্য যে তাঁরই তথ্য সেটা তাঁরা বাইরে প্রকাশ করবেন না।
মানবজাতি এই মুহূর্তে একটা সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলছে। হয়তো বা এই শতকের সবচেয়ে বড় সংকট। শুধু এই দেশের মানুষ নন, বিভিন্ন দেশের মানুষেরা এবং সরকারেরা যে সিদ্ধান্ত নেবেন এই মুহূর্তে তা আগামীদিনে তাঁদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে সাহায্য করবে। শুধুমাত্র আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নয়, আগামীদিনে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি কি হতে চলেছে তা হয়তো এই সময়ে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে। একদিন হয়তো এই ‘ঝড় থেমে যাবে পৃথিবী আবার শান্ত হবে’, কিন্তু এখন যে বিকল্পগুলো আমরা বেছে নেবো তার ওপরেই নির্ভর করবে আগামীর সকাল কেমন হবে? বহু আপতকালীন ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যা হয়তো অন্যান্য সময়ে নিতে যথেষ্ট আলাপ আলোচনার প্রয়োজন হতো। অপরিণত এবং ভয়ঙ্কর কিছু প্রযুক্তিকে হয়তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করানোর চেষ্টা হবে। প্রতিটি মানুষ যেন পরীক্ষার জন্য বলি প্রদত্ত গিনি পিগ কিংবা ইঁদুর। এটা কি কেউ কল্পনা করেছিলেন আজ থেকে কিছুদিন আগেও যে বেশিরভাগ মানুষকে ঘরে থেকে কাজ করতে হবে, বা সমস্ত স্কুল কলেজ অনলাইন হয়ে যাবে? কিন্তু এটাই আপাতত সত্যি।
এবার আসা যাক আধারের প্রশ্নে। যখন সর্বোচ্চ আদালতে আধার নিয়ে মামলা হয়েছিল তখন অনেকেই এই মামলাটিকে দেখেছিলেন নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য বাইরে যাওয়া বা গোপনীয়তা দিয়ে, কিন্তু আদপে এই মামলাটিকে যদি লড়া যেত পরিচয় দিয়ে, মানে আদৌ আধার কোনও অভিন্ন পরিচয়পত্র নয়, তাহলে হয়তো লড়াইটা জেতা যেত, কিন্তু তা না করে যারা এটার বিরুদ্ধে লড়লেন তাঁরা নিয়ে গেলেন এটিকে গোপনীয়তার দিকে, ফলে সরকারের বিরোধিতা করতেও সুবিধা হল, তাঁরা বললেন যে এই গোপনীয়তার বিষয়টি শুধুমাত্র সমাজের ওপরের স্তরের মানুষদের মাথা ব্যাথা, ফলত এটা নিয়ে সমাজে যাঁদের সত্যি কোনও পরিচয়পত্র নেই তাঁদের এটি প্রয়োজন। কিন্তু সত্যিটা কি তাই? যখন আধার আনা হয়েছিল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তখন মাত্র দশমিক ০৩ শতাংশ মানুষের কোনও পরিচয়পত্র ছিল না, আর সকলের কোনও না কোনও পরিচয়পত্র ছিল। আদালতে তাই গোপনীয়তার বিষয়টি দাঁড় করানো যায়নি। ওদিকে সরকার থেকে বলা হয় যে গোপনীয়তার বিষয়টি পরে দেখা যাবে। তারপর যখন একে একে রেশন, থেকে ব্যঙ্ক হয়ে মোবাইল ফোনে আধার সংযোগের কথা সামনে আসে তখনও একই যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে যদি কোনও কিছু লুকোনোর নাই থাকে তাহলে এতো ভয় কিসের? সেদিনও যে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল আজো একই যুক্তি দেওয়া জরুরি যে ‘আধার কোনও ভাবেই অভিন্ন পরিচয়পত্র নয়, আধার নকল করা সম্ভব সুতরাং কোনোভাবেই কোনও কেন্দ্রীভূত তথ্য ভান্ডার তৈরি করতে আমি একজন ব্যক্তি নাগরিক সাহায্য করবো না যা দিয়ে আমাকে ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে’। আরোগ্য সেতুর ক্ষেত্রেও একই উত্তর দেওয়া জরুরি।
আসলে ভয় পাওয়ানোটা খুব জরুরি, মানুষ এমনিতেই আতঙ্কিত। করোনা নিয়ে সে ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে আছে, তাঁর চাকরি-বাকরি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে এখন যদি ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের ভয় দেখিয়ে বেশিরভাগ মানুষকে এই আরোগ্য সেতু ডাউনলোড করিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে এই সরকারের কাছে একটা তথ্য ভান্ডার তৈরি হয়ে যাবে যেটার সঙ্গে যদি আধারের তথ্য মিলিয়ে একটা তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা যায়, তাহলে যে বা যারা ওই তথ্যভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ পাবে তাঁরা কতটা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে সেটা কি সহজেই অনুমেয় নয়? যদি খেয়াল করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে প্যান কার্ডের সঙ্গে আধার সংযোগ না করালে প্যান বাতিল হয়ে যাবে, এই ভয় দেখিয়ে বহু মানুষকে আধার করিয়েছে এই সরকার, ঠিক একই রকম ভয় দেখিয়ে চাকরি চলে যেতে পারে এই আরোগ্য সেতু মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নেওয়াবে। অথচ কোনও নাগরিক কি প্রশ্ন করবেন না যে এই সরকার হোয়াটস অ্যাপে একটি সফটওয়ার যার নাম পেগাসাস ঢুকিয়েছিল, এই সরকার বিভিন্ন মানুষের ই-মেল হ্যাক করেছিল, এই সরকার কি করে বলে যে এই আরোগ্য সেতু নজরদারির জন্য নয়? অনেকে বলছেন যে সরকার যদি প্রত্যেক নাগরিককে স্মার্ট ফোন দেয় তাহলে আরোগ্য সেতু নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু এই সরকার খাবার দিতে পারুক ছাই না পারুক, সকলের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি করতে পারুক ছাই না পারুক এই স্মার্ট ফোন দিয়েও দিতে পারে, এবং তারপর যদি আরোগ্য সেতু নেওয়ার পাশাপাশি সকলের মোবাইলের হোয়াটস অ্যাপে অনবরত মিথ্যা খবর আসতে থাকে তখন সেটা মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের আছে তো?
এই মুহূর্তে মানুষের কাছে দু-ধরনের বিকল্প সামনে আছে।
সর্বগ্রাসী নজরদারি বনাম নাগরিকদের আরও ক্ষমতায়ন।
প্রত্যেকটি দেশ নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করবে না সারা বিশ্বব্যাপী একটা সৌভাতৃত্ব তৈরি হবে।
কিন্তু আমরা কি সত্যিই দেখতে চাই এই বিকল্পগুলো নাকি গা ভাসিয়ে দিতে চাই এই গড্ডালিকা প্রবাহে? যদি প্রতিটি মানুষ মনে করেন যে তাঁরা এই নজরদারির আওতায় থাকবেন না, এবং এই বেশ কিছু অভ্যেস থেকে নিজেদের মুক্ত করবেন, তাহলে এটাই কি সেই সময় নয়, যে আমরা অনেক কিছু থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারি? করোনায় গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে থাকতে অনেকেই হয়তো অনেক কিছু ছেড়েছেন আগামীতে হয়তো আরও অনেক কিছু ছাড়তে হবে, হয়তো রোজ ভাত নাও জুটতে পারে কারুর কারুর, এখনও যেমন বহু মানুষ খেতে পাচ্ছেন না দুবেলা। সবাই যার যার মতো করে লড়ছেন। এই সাধারণ স্মার্ট ফোনের অভ্যাস কি আমরা ছাড়তে পারবো না? আরোগ্য সেতুর মতো বা আধারের মতো নজরদারির অস্ত্রকে পরাজিত করতে এখন আমাদের কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে শুধু। আসলে যতদিন না এটা পারবো ততদিন আমরা রোজ হারবো, কারণ বিপক্ষের মাঠে বিপক্ষের তৈরি করা খেলার নিয়ম মেনে আজ অবধি কোনোদিন প্রতিপক্ষকে হারানো যায়নি, এই সময়ের ক্ষমতাসীন শক্তিকে তো নয়ই।
-- সুমন সেনগুপ্ত