গত ২৭ এপ্রিল, ২০২০ দিল্লি পুলিশ দিল্লির আইসা সভাপতি কাওয়ালপ্রীত কাউরের মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করেছে। সরকারের কাছে যে ছাত্র-ছাত্রী এবং রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মীদের বিপজ্জনক বলে মনে হবে তাদের এবং আইসাকে আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেয়ার যে ষড়যন্ত্রের চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে এ তারই অঙ্গ।
একের পর এক ছাত্রকর্মীদের গ্রেফতারি ও ভীতি প্রদর্শন করার যে পুলিশি সক্রিয়তা চলছে তারই অংশ হিসাবে, দিল্লি পুলিশ ২৭ এপ্রিল কমরেড কাওয়ালপ্রীত কাউরের দিল্লির বাড়িতে যায়। দিল্লিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক গণহত্যার তদন্ত করার নামে তার মোবাইল ফোনটি বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। তাকে দেওয়া রসিদে একটি এফআইআরের কথা রয়েছে, তাতে একগুচ্ছ ধারার সাথে ইউএপিএ-র মতো কালা-কানুনও রয়েছে যা আসলে সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং সরকারের সমালোচনা করা ছাত্র-ছাত্রী, রাজনৈতিক ও সমাজকর্মীদের আটক রাখার অজুহাত হিসেবে তা ব্যবহার করছে। বিরোধী কন্ঠকে বিনা বিচারে, বিনা জামিনে, সারাজীবন কয়েদ করে রাখার অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে।
এরকম ভয় দেখানো গ্রেপ্তারি দীর্ঘদিন চলছে। বিশেষত, দরিদ্র ও সংখ্যালঘু ভারতীয়দের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়ার জোড়া প্রকল্প এনআরসি ও সিএএ-র বিরুদ্ধে সংবিধান বাঁচাও আন্দোলনের প্রথম সারির কর্মীদের আক্রমণের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
আসামে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের কর্মী অখিল গোগোই এখনও কারাগারে বন্দী। দিল্লিতে জামিয়া এবং জেএনইউ-এর ছাত্র-ছাত্রী সহ সিএএ-বিরোধী নেতাকর্মীদের এই কালা কানুনে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে রাখা হয়েছে। একইভাবে উত্তরপ্রদেশের ছাত্রকর্মীদেরও সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদিকে, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ১১ জন শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং আন্দোলন কর্মীরা এখন ইউএপিএ আইনে কারাগারের অন্তরালে। সম্প্রতি, কান্নন গোপিনাথন, যিনি আইএএস-এর চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের এক বিশিষ্ট মুখ ও স্পষ্টবাক তরুণ কন্ঠ হয়ে উঠেছেন, আইএএস সার্ভিসে পুনরায় যোগদান করতে অস্বীকার করার অভিযোগে দমন ও দিউতে তার নামে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে, অজুহাতগুলি আলাদা আলাদা হলেও লক্ষ্যটা অভিন্ন-ভিন্নমত পোষণকারীদের গ্রেফতারি, সংবিধান রক্ষার সমর্থনে কথা বলার সাহস দেখানোর জন্যে শায়েস্তা করা। ২৫ এপ্রিল, ২০২০ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর নজরে আসে যে দিল্লী আইসা সভাপতি কাওয়ালপ্রীত কাউরকে দিল্লী পুলিশ নিশানা বানিয়েছে। সেই প্রতিবেদনে দিল্লী পুলিশ দাবি করে যে নয় জন ব্যক্তির হোয়াটস্যাপ কথোপকথন তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে তারা যা তথ্য প্রমাণ পেয়েছে তার ভিত্তিতেই বিভিন্ন শিক্ষার্থী ও আন্দোলন কর্মীদের ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি পপুলার ফ্রন্ট অব ইণ্ডিয়া (পিএফআই), জামিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটি(জেসিসি), পিঞ্জরা তোড়, অল ইণ্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা)-এর কিছু সদস্য ও তৎসহ দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় ও জেএনইউ-এর কিছু প্রাক্তনীর বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে।
আইসা কর্মী সহ অন্যান্য ছাত্র আন্দোলনকারীদের পশ্চাদ্ধাবন তাদের তদন্ত(?)’র উপর ভিত্তি করেই হচ্ছে – দিল্লী পুলিশের এই দাবি কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? আসুন দেখা যাক :
১) এক মাসেরও বেশি সময় আগে, ২০২০ সালের ৭ ও ৮ মার্চ এএনআই, রাজস্থান পত্রিকা এবং আরো কিছু সংবাদ সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর উদ্ধৃতি প্রকাশ করে যে “আইসা সহ আরো কিছু সংগঠন উত্তর পূর্ব দিল্লির দাঙ্গার মূল চক্রী”। ১২ মার্চ আইসা রাজস্থান পত্রিকায় একটি চিঠি পাঠিয়ে এই মিথ্যাগুলির নিন্দা করে ও এই সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করে। পরে এই চিঠিটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়।
২) ১১ মার্চ, ২০২০-তে, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের একটি দল এবিভিপি-র দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদের প্রাক্তন সভাপতি, দিল্লী বিধানসভার প্রাক্তন বিজেপি প্রার্থী এবং বিজেপির পক্ষে বহু আইনি লড়াইতে আইনজীবীর ভূমিকা পালনকারী মনিকা অরোরার নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিষেন রেড্ডির সাথে দেখা করে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। এই প্রতিবেদনের বিস্তৃত কাহিনী আরএসএসের দলীয় মুখপত্র “অর্গানাইজার” থেকে নেয়া হয়েছে। এই তথাকথিত “প্রতিবেদন”, যা আসলে এক মনগড়া কাহিনি, ঠারেঠোরে জানিয়েছে যে “সিএএ বিরোধী বিক্ষোভগুলিতে পিএফআই-আইসার হাত রয়েছে।” স্পষ্টতই এটি আইসার বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যান তৈরির চেষ্টা।
সংক্ষিপ্তসার : ২৫ এপ্রিল, ২০২০ দিল্লী পুলিশ দাবি করে যে অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পন্ন তদন্ত এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই আইসা এবং অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করেছে পুলিশ। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হলো দিল্লী পুলিশের তথাকথিত তদন্তের একমাসেরও বেশি সময় আগে আরএসএস-বিজেপি ব্রিগেডের তৈরি করা চিত্রনাট্যকে মনিকা অরোরার মতো সমর্থকদের সহায়তায় চড়া সুরে বাধার প্রক্রিয়ার পর দিল্লী পুলিশ সেই চিত্রনাট্য অনুযায়ী অভিনয় করছে মাত্র। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দিল্লি পুলিশের, ডানপন্থী জালিয়াতিকে তাদের নিজস্ব “প্রমাণ” বলে দাখিল করার এটাই প্রথম ঘটনা নয়। জেএনইউ-তে মুখোশধারী এবিভিপি দুষ্কৃতিদের দ্বারা সহিংসতার পরে দিল্লি পুলিশ একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিল। সেখানে বিজেপি-এবিভিপি অনুমোদিত সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলিতে প্রচারিত ছবি এবং ভিডিওগুলিকে তারা “পুলিশি তদন্তের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য প্রমাণ” হিসেবে দাখিল করেছিল!
আমরা এখানে ভীমা কোরেগাঁও গ্রেফতারির বিষয়টি স্মরণ করতে পারি, সেক্ষেত্রেও একই ধরণের চিত্রনাট্য তৈরি করে রিপাবলিক টিভি স্টুডিওতে তা প্রথম অভিনীত হয় এবং তারপরে পুণে পুলিশ তা অনুসরণ করে এবং এখন জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) সেই চিত্রনাট্যকে অনুসরণ করছে। অন্যদিকে, আমরা স্মরণ করতে পারি, উত্তর-পূর্ব দিল্লির একটা বিস্তৃত অংশে ছড়িয়ে পড়া পরিকল্পিত হিংসা ও দাঙ্গাতে কপিল মিশ্রের মতো বিজেপি নেতাদের ইন্ধন জোগানোর স্পষ্ট প্রমান থাকা সত্বেও দিল্লী পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম আইনি ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করে। দিল্লী নির্বাচনের প্রচার করা কালীন অনুরাগ ঠাকুর এবং প্রবেশ ভার্মার উগ্র বিষাক্ত আহ্বান স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরিতে মদত জুগিয়েছিল, কিন্তু একইভাবে দিল্লী পুলিশ এখনো তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। দিল্লি পুলিশ এমন প্রমাণও এড়িয়ে গেছে যে, এবিভিপি নেত্রী কোমল শর্মা এবং এবিভিপির খুনে বাহিনী মুখোশ পরে জেএনইউ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছিল এবং ব্যাপক হিংসা চালিয়েছিল যা শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের প্রাণসংশয় ঘটিয়েছিল। একইভাবে জাতীয় তদন্ত সংস্থা ভীমা কোরেগাঁওয়ে সম্ভাজি ভীড়ে এবং মিলিন্দ একবোটের নেতৃত্বে দলিতদের ওপর হামলায় ডানপন্থী গুণ্ডাবাহিনীর জড়িত থাকার প্রমাণ উপেক্ষা করেছে। দিল্লি দাঙ্গা, পাশাপাশি ভীমা কোরেগাঁও ও জেএনইউ – এই সমস্ত ক্ষেত্রেই যারা হিংস্র হামলার শিকার তারা এবং তাদের সহযোগী এবং প্রতিবাদী স্বরের ব্যক্তিদেরই লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে, আর সহিংসতাকারী প্রকৃত অপরাধীরা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কমরেড কাওয়ালপ্রীত সহ সমগ্র ভারতবর্ষের আইসা কর্মীদের সাথে সিএএ-এনআরসি-এনপিআরের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী যোগ দিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীরা প্রকাশ্যে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করেছিলেন। যখন ক্ষমতাসীন শক্তি ধর্মের ভিত্তিতে দেশকে বিভক্ত করার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা করে চলেছে তখন আইসা কর্মীরা আমাদের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি রক্ষার জন্য শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিচ্ছে। উত্তরপূর্ব দিল্লির দাঙ্গার পরে আইসা কর্মীরা দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্যে ত্রাণ কর্মসূচীর আয়োজন করেছে। আর এখন, আরএসএস এবং বিজেপির নির্দেশে পুলিশ দেশের সংবিধান রক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা এই শিক্ষার্থীদের পেছনে লেগেছে, তাদের হয়রান করছে!
আজ আমরা আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছি সরকার যাদের অনাহারে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখেছে। ক্ষুধার গ্রাস থেকে মুক্তির লক্ষ্যে গরিব ও শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ট্রেড ইউনিয়নগুলির হাতে হাত মিলিয়ে আমরা লড়াইয়ের আওয়াজ তুলছি। আমাদের আজকের প্রচেষ্টায় আমরা জানি, যে শ্রমিক ও দরিদ্ররা রেশন বা আধার কার্ডের অভাবে আজ অনাহারে, এনআরসি কার্যকরী হলে সেই তালিকা থেকে তাদের ছেঁটে ফেলা হবে।
ভারতের সংবিধান এবং গণতন্ত্রের রক্ষায় যারা লড়াই করছেন তাদের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশ এবং ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মহামারী ছড়ানোর গল্প কাহিনি রচনা করে পরিবেশন করতে পারে। কিন্তু আমরা দেশের নাগরিকেরা অধিকার ও মর্যাদার দাবিতে দরিদ্র ও দুর্বলদের পাশে দাঁড়িয়ে, ক্ষমতাসীন শক্তির শাসন পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জবাবদিহি চেয়ে আমাদের কর্তব্য পালনে অবিচল থাকবো। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবো, নির্ভীকভাবে লড়াই করবো। সরকার বাহাদুর যত আমাদের চুপ করানোর চেষ্টা করবে, শত শত স্বর ততই আরও জোরে প্রতিবাদী চিৎকারে ফুঁসে উঠবে।