করোনা সংক্রমণের মতো নজিরবিহীন সংকটময় পরিস্থিতিতেও উন্মোচিত হয়ে চলেছে কেন্দ্রের মোদী সরকারের আচরণ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। মুখে যাইই বলুক মোদী জমানা ন্যূনতম যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ধার মাড়ায় না। তার বদলে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, কর্তৃত্বকরণ, একচেটিয়াকরণই তার গন্তব্য। কোনো রাজনৈতিক ধারা যে প্রকৃতপক্ষে কী তার সবচেয়ে পরিস্কার প্রমাণ মেলে সংকটের পরিস্থিতিতে। এখন বিশ্বময় পরিস্থিতি কোবিড-১৯ কবলিত সর্বাত্বক সংকটের। এই সংকটে কাঁপছে ভারতও। প্রচণ্ড নড়বড়ে করে দেওয়া এই সংকটের সময়ে ঘরে-বাইরে সমস্ত বিপদকে মোকাবিলা করার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রীয় অবস্থান মেনে চলার ব্যাপারে মোদী সরকারের ভূমিকা জঘন্য, ন্যক্কারজনক।
মোদীকে সামনে রেখে বিজেপি ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের ইস্তেহারে ‘সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রবাদে’র প্রতি আনুগত্য রেখে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যদিও এই বিষয়ে শাসনের প্রথম পাঁচটি বছরে কেমন কথা রেখেছিল তা জনগণ হাড়েহাড়ে টের পায়। ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে নিয়ে আসা হয় অন্য মাত্রা – মোদীর নেতৃত্বে চাই ‘এক দেশ, এক আইন, এক পার্টির শাসন’ ইত্যাদি! সমস্ত ক্ষমতা চাই ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতিওয়ালা এক সর্বেসর্বার হাতে! তার বছরদুয়েক আগে ছড়িয়ে গিয়েছিল ফ্যাসিবাদী মোদী হটাও দেশ বাঁচাও আন্দোলন। একের পর এক আন্দোলনের জেরে মোদী-কেন্দ্র পর্যবসিত হয় প্রায় পতনোন্মুখ খাদের কিনারায়। সেখান থেকে ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনে কিভাবে বিজেপির কেন্দ্রের কুর্সিতে প্রত্যাবর্তন ঘটে, তা যে ‘পুলুওয়ামা’ ও ‘বালাকোট কান্ডে’র ডানায় ভর করে ‘সন্ত্রাসবাদে’র হাত থেকে ‘দেশ রক্ষা’র জিগির তুলে, সেও মানুষ পরে বুঝতে পেরেছে। সেই থেকেই মোদী সরকার আরও ঔদ্ধত্যের সাথে গণতন্ত্র, যাবতীয় বিরোধী মতামত ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে মানতে অস্বীকার করে আসছে। আর, এই প্রবণতা এখন চরম উৎকটভাবে প্রকাশ হচ্ছে কোবিড-১৯ সঞ্জাত সংকট সৃষ্টির পরিস্থিতিতে। কেন্দ্রে মোদীর দ্বিতীয় পর্বের শাসন সর্বনাশ ডেকে নিয়ে আসার উদাসীনতা, অবহেলা, গাফিলতি, ক্ষমাহীন অপরাধ করেই চলেছে।
বিজেপির কেন্দ্রের মন্ত্রীরা ও বাংলার রাজ্য নেতারা অনেক গলা ফাটাচ্ছেন। কেন্দ্র নাকি রাজ্যকে করোনা বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিল ২০২০-র ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে। কিন্তু কেন্দ্রের শাসকরা তখন নিজেরা কী করছিল? কোনও সতর্ক পরিকলল্পনা-প্রস্তুতি নিয়েছিল কি? নেয়নি। কেন্দ্র তখন ব্যগ্র ছিল অন্য অন্য বিষয়ে। একদিকে ‘বেনাগরিককরণে’র বেলাগাম বিতর্কে-পদক্ষেপে, অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্বর্ধনায় ভাসতে-ভাসাতে। অনতিবিলম্বে করোনার হানা অতিমারীতে পরিণত হওয়ার বিপদবার্তা জানান দিতে শুরু করে। আর তখন কেন্দ্রের আগে তৎপর হয় কয়েকটি অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য। কেন্দ্র কসরত দেখাতে শুরু করে কেবল তারপর থেকে।
প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবিলায় ভারতের সাফল্য অর্জনের গরিমা বোঝাতে ইতিমধ্যে দফায় দফায় অনেক খেল তামাশা দেখিয়েছেন। তালি দেওয়া, থালি বাজানো, প্রদীপ জ্বালানো এবং বায়ুসেনার বিমান থেকে পুস্পবৃষ্টি, বহু কিছু প্রদর্শিত হল। যারা দেড় মাস জেগে ঘুমিয়ে ছিলেন তারা মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে মধ্যরাত থেকে গোটা দেশকে লক ডাউনে গৃহবন্দী করে ফেললেন। এতে কোটি কোটি দেশবাসীর দ্রুত কি দুরবস্থা ঘনিয়ে আসবে তা নিয়ে একবারও ভাবা হল না, কোনো জনমত যাচাই করা হল না। বিজেপির কেন্দ্র-ভজা রাজ্য সরকারগুলো আশ্চর্যের কিছু নেই চুপ মেরে গেল। কিন্তু বিরোধী দলের রাজ্য সরকারগুলো একগুচ্ছ দাবি তুলেছিল, সেই দাবিগুলো যে সব সর্বাঙ্গীণ ছিল তা নয়, দাবিগুচ্ছের মধ্যে অনেক অসম্পূর্ণতা ছিল, হয়ত কিছু কিছু ফাঁক-ফাঁকিও ছিল, তবু তো প্রাথমিক পর্যায়ে কেন্দ্রের কাছে কম-বেশি যুক্তিসঙ্গত যুক্তরাষ্ট্রীয় আবেদন পেশ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ঘটা করে মুখ্যমন্ত্রীদের সাথে ভিডিও কনফারেন্স করলেন। কিন্তু দাবি মেটানোর ব্যাপারে ছিটেফোঁটা বরাদ্দ ঘোষণা করেই দায় এড়ানোর কায়দা নিলেন। সেই থেকে ব্যাপক জনতাকে দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। এর সবচেয়ে অমানবিক শিকার হয়েছেন লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকরা। একইসাথে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে কারখানা শ্রমিকের, ব্যাপক অসংগঠিত ক্ষেত্রের মজুর মেহনতিদের মায় গ্রামীণ গরিব শ্রেণীর জীবন-জীবিকা। মোদী সরকার বিপদের শুধুমাত্র একটি দিক ‘করোনা’ দেখিয়ে সকলের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছে, বিপদের অন্য দিকগুলি অর্থাৎ মানুষের নিদারুণ খাদ্য ও অর্থের অভাব, বেতন ও মজুরি বকেয়া থাকা, ঘরে ফেরার সমস্যা, শরীর-স্বাস্থ্যের পরীক্ষা ইত্যাদি প্রশ্নে মূলত মুখ বন্ধ রেখে চলছে। ‘লক ডাউন হয়েছে বলেই ভারত বেঁচে গেছে’ গলাবাজিটা মোদী করছেন ইউরোপ-আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতির সাথে তুলনা টেনে। পক্ষান্তরে, করোনা মোকাবিলায় এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাফল্যের তুলনায় ভারত এখনও কত ব্যর্থতা ও অজানা বিপদের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে, সেই পর্যালোচনার নাম নেই। বিজেপির ঘোড়েল বুদ্ধিজীবীরা তুবড়ি ছোটাচ্ছেন এই বিশ্বাস গেলাতে যেন ‘মোদী অবিসম্বাদী, ভারতকে টেনে তুলতে পারেন একমাত্র মোদী’। অক্সফোর্ড অতীত থাকা অধুনা রাজ্যসভায় বিজেপির সদস্যপদের পুরস্কার পাওয়া এক ঝানু সাংবাদিক দেদার কলমবাজি করছেন। বলেছেন, মোদীর কড়া লক ডাউনের ব্যবস্থাগ্রহণ ‘ভারতের জনজীবন সস্তা’ – বাইরের দুনিয়ায় পোষণ করা এই বিশ্বাসটা উল্টে দিয়েছে। ভাবলেন তুড়ি মেরে সব অভিযাগ উড়িয়ে দেওয়া গেল। কিন্তু না, মিথ্যাচার করে করোনার মোকাবিলায় কেন্দ্রের ভূমিকা যে কত যন্ত্রণার সেটা মানুষ দুর্দশার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝছেন, যুঝছেন।
ভারতের জনজীবনের শোচনীয় অবস্থা বুঝতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাহায্য নেওয়াই শ্রেয়। ‘হু’-র রিপোর্ট অনুসারে ভারতে একদিকে যক্ষায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বছরে গড়ে ২ কোটি ৫০ লক্ষ, অন্যদিকে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লক্ষের মতো; আর যক্ষায় ও ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় বছরে যথাক্রমে ৪ লক্ষ ৪০ হাজার ও ২০ হাজার। যক্ষায় মৃত্যুর পেছনে কারণ প্রথমত অনাহার-অর্ধাহার-অপুষ্টি, আর এই রোগভোগের পরিণামে মৃত্যুমিছিলের পেছনে অভিন্ন কারণ হল, সুলভ পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাব বা বিনা চিকিৎসা। তার পেছনে আরও কারণ হল, জনস্বাস্থ্য ও দরকারী চিকিৎসার প্রশ্নে ক্রমবর্দ্ধমান সরকারি অবহেলা, সরকারি ব্যবস্থাপনার শম্বুকগতি, বেসরকারীকরণ, বাজারিকরণ। করোনার মোকাবিলায় সরকারি ব্যয়বরাদ্দের তুলনামূলক নমুনাও ভারত সরকারের অবস্থান ও মনোভাব যে বেদরদী জনবিরোধী তার প্রমাণ দেয়। যখন জাপান বরাদ্দ করেছে জিডিপি-র ২০ শতাংশ, আমেরিকা করেছে দুদফায় মোট ১৬ শতাংশ, তখন ভারতে মোদী সরকার জিডিপি-র ১ শতাংশেরও কম বরাদ্দ করে সাফল্য জাহির করছে! অথচ জাপান-আমেরিকার তুলনায় ভারতের জনসংখ্যা যেখানে বহুগুণ বেশি। ভারত রাষ্ট্রের পরিচালকদের কাছে জনগণের জীবনের দাম কতটুকু! লক ডাউন পর্বের জন্য শ্রমিকদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ মজুরি মিটিয়ে দেবেন নির্দেশ দিয়েই নিষ্ক্রিয় হয়ে থেকেছে। অবশ্য এ দোষে যেমন কেন্দ্রের মোদী সরকার দুষ্ট, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রীয় দাবি কণ্ঠ তোলা রাজ্যের তৃণমূল সরকারও দোষী। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানো হল বহু দিন ফেলে রেখে। কেন্দ্র প্রথমত কখনই ফেরানোর দায়দায়িত্ব নিতে চায়নি। তার জন্য জুজু দেখায় সংক্রমণ ছড়ানোর। রাজ্য সরকারগুলোও প্রথম দিকে দায় এড়ানোর সুবিধাবাদী অবস্থান থেকে কেন্দ্রের ছড়ানো জুজুকে অজুহাত বানায়, গাজোয়ারী অনড় মনোভাবকে ঘাঁটাতে চায়নি, বিরল ব্যাতিক্রম তৎপর হয় কেবলমাত্র কেরল। তারপর যখন দেশজুড়ে ঘরে ফেরানোর দাবি-ঝড় উঠল সেই ধাক্কায় বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলো বাধ্য হল কেন্দ্রের ওপর চাপ তৈরি করতে। আর কেন্দ্র বাধ্য হল একগুয়েমী ছাড়তে। নিমরাজি হল রেল কর্তৃপক্ষ। তাও আবার বেঁকে বসেছিল ভাড়ার টাকা বহন করবে না বলে। রেল প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে ১৫০ কোটি টাকা দান করতে পারে, আর তার এক-তৃতীয়াংশ টাকা ছাড় দিয়ে শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে পারে না! ভাড়ার পুরো দায়টা চাপাতে চেয়েছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর, তারা না পারলে তাদের যে রাজ্য থেকে যে রাজ্যে পাঠানো হচ্ছে সেই রাজ্যগুলোর ওপর। শ্রমিকরা যখন ভাড়া গুণতে অস্বীকার করল, রাজ্যগুলো যখন তা মানতে অস্বীকার করল, এই দড়ি টানাটানির মাঝে কংগ্রেস যখন বিশেষ ‘সাহায্যদানে’র তাস খেলে বসল, এইসমস্ত চাপের ফলে মোদীর কেন্দ্র সেই ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করল, ভাড়ার ৮৫ শতাংশ বহন করার অবস্থান গ্রহণ করল। তবে সোজা কথায় নয়, গণতান্ত্রিক অধিকার ও যুক্তরাষ্ট্রীয় দাবির প্রতি বদান্যতা প্রদর্শনবশতও নয়, অবনত হল লাগাতার দেশজোড়া প্রতিবাদ আর বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকদের রুখে দাঁড়ানোর চাপের সামনে।