“বর্তমানের শিথিল শ্রম আইনকে শিথিলতর করলে আর্থিক কর্মকান্ডে গতি আসবে না” – আজিম প্রেমজি, আইটি সংস্থা উইপ্রোর প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার।
প্রথম হোঁচট-টা এবার খেতে হলো।
৮ ঘণ্টা শ্রমদিবসের আন্তর্জাতিক সনদকে বদলে প্রশাসনিক এক আদেশনামায় যোগী আদিত্যনাথ তা ১২ ঘণ্টায় নিয়ে গেছিল। এলাহাবাদ হাইকোর্টের নোটিশ পাওয়ার পর উত্তর প্রদেশ সরকার তা তড়িঘড়ি ফেরত নিল।
কিন্তু বহাল থাকলো আরও প্রায় ৩৮ টি শ্রম আইনকে বাতিল করার সিদ্ধান্ত। “উত্তর প্রদেশ টেম্পোরারি এক্সজেমশন ফর সার্টেন লেবার “লজ অর্ডিন্যান্স, ২০২০” – এই দানবীয় অধ্যাদেশ মারফত এক কলমের খোঁচায় ১০০০ দিন (অর্থাৎ, প্রায় তিন বছরের জন্য) এর জন্য হিমঘরে পাঠিয়ে দিল যাবতীয় শ্রম আইন। এরপর যেন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হলো। শ্রম আইনকে বাতিল করার প্রতিযোগিতা। উত্তর প্রদেশে বাদে এখন পর্যন্ত ৮টি রাজ্য শ্রম দিবসকে ১২ ঘণ্টায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে – গুজরাট-হিমাচল প্রদেশ-হরিয়ানা-ওড়িষ্যা-মহারাষ্ট্র-রাজস্থান-বিহার ও পঞ্জাব। অসম ও ত্রিপুরা ওই পথে হাঁটার তোড়জোড় শুরু করেছে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের নোটিশের পর তারা আর কতটা এগোবে তা এখন দেখার আছে।
আগামী তিন বছরের জন্য যোগী আদিত্যনাথ সরকার কবরে পাঠালো এমনকি সেই সমস্ত আইন, যা মৌলিক মানবাধিকারের সাথে যুক্ত। সেগুলো হলো, পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত আইন, ন্যূনতম মজুরি, মাতৃত্বকালীন আইন, গ্রাচ্যুইটি প্রভৃতি। আর, যে সমস্ত আইন বাতিল করেছে সেগুলো হলো ট্রেড ইউনিয়ন আইন, শিল্প বিরোধ আইন, পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আইন, কন্ট্রাক্ট শ্রমিক আইন, সম কাজে সম মজুরি প্রভৃতি।
মধ্যপ্রদেশ সরকার ফ্যাক্টরিজ আইনে আমূল বদল ঘটালো। কন্ট্রাক্ট শ্রমিক আইন ও শ্রম বিরোধ আইনে এমন সব পরিবর্তন আনলো, যার ফলে নিয়োগকর্তাকে দেওয়া হলো অবাধে ছাঁটাই করার অধিকার; শ্রম বিরোধ নিরসনের, তার সুষ্ঠু মীমাংসার অত্যন্ত মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারকে কেড়ে নেওয়া হলো। ৪৯ জন পর্যন্ত কর্মী সরবরাহকারী কনট্রাক্টরদের কোনো ধরনের লাইসেন্সের প্রয়োজন থাকবে না। ফলে, যে কোনো নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি ছাড়াই তারা তাদের কারবার চালিয়ে যেতে পারবে। কারখানা সংক্রান্ত সমস্ত ধরনের ইন্সপেকশন, আইন প্রনয়নকে বলবৎ করার যাবতীয় বিধি ব্যবস্থাকে লাটে তুলে দেওয়া হলো। শ্রমিকদের বুনিয়াদি গণতান্ত্রিক অধিকার, যেমন মজুরি, ক্ষতিপূরণ, নিরাপত্তা ইত্যাদি হয়ে দাঁড়ালো অর্থহীন।
মধ্যপ্রদেশ কল্যাণ পর্ষদে নিয়োগকর্তাদের মাথা পিছু শ্রমিকদের জন্য যে ৮০ টাকা জমা দিতে হতো, তা আর দিতে হবে না। সমস্ত দোকান-সংস্থা খোলা থাকবে সকাল ৬.০০ থেকে রাত ১২.০০ পর্যন্ত। গুজরাট সরকার ও ১২০০ দিনের জন্য সমস্ত শ্রম আইনকে স্থগিত রাখলো।
আজ কোভিড-১৯-র সুযোগ নিয়ে ভারতের বৃহৎ কর্পোরেট ঘরানাগুলো পুরোদমে মাঠে নেমে পড়েছে। ভারত সরকারের সচিব হীরালাল সামারিয়া ৫ মে তারিখে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্য সচিবের কাছে একটা প্রশাসনিক নির্দেশিকা পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, প্যান্ডেমিক উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে যে বিরাট চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে তাকে যুজতে শ্রম আইন সংস্কারকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিতে হবে। তিনি জানিয়েছেন, ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট, শ্রম দিবসকে ৮ ঘণ্টার থেকে ১২ ঘণ্টায় নিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা দরকার। বোঝাই যাচ্ছে, বিভিন্ন রাজ্য সরকারের কাছে শ্রম দিবস সহ অন্যান্য শ্রম সংস্কারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে এই ধরনের নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে। আর, শুধু বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার গুলোই নয়, এ প্রশ্নে কংগ্রেস, বিজেডি, নিতীশ কুমার, তেলেঙ্গানার ওয়াই এস রেড্ডী ও সমানভাবে তাল মিলিয়ে চলছে। আর এ ব্যাপারে নীতি আয়োগ শানিয়েছে তার তাত্ত্বিক যুক্তি।
নীতি আয়োগের সিইও অমিতাভ কান্ত শ্রম কানুনের ঢালাও সংস্কারের সপক্ষে নির্লজ্জ ওকালতি করে বলেছেন, “১৯৯১ সালের সংস্কার কর্মসূচীর পর এতোদিন বাদে শ্রম আইনকে আপাদমস্তক বদলে সবচেয়ে দুঃসাহসিক ও বলিষ্ঠ উদ্যোগের সূত্রপাত ঘটালো উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশ। অনেকগুলো আইনকে তুলে, শিল্পকে খোলামেলা পরিবেশে কাজের এক বিরাট সুযোগ করে দেওয়া হলো। কোভিড-১৯ অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করলো লাল ফিতের ফাঁস, ইন্সপেক্টর রাজ, আর যত সব মান্ধাতার আমলের শ্রম আইন”। (ইটস নাও অর নেভার, ১২ মে, টাইমস অফ ইন্ডিয়া)। ৮ মে, ভারতের প্রথম সারির শিল্প ও ব্যবসায়ী সংগঠন ফিকি-অ্যাসোচাম-সিআইআই সহ ১২ সংগঠন কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রীর সঙ্গে এক টেলি কনফারেন্স করে। সেখানে তারা সম্মিলিতভাবে যে প্রস্তাবগুলো রাখেন তা হলো – আগামী ২-৩ বছরের জন্য গোটা দেশেই সমস্ত শ্রম কানুন স্থগিত রাখা, সমস্ত শিল্প সংস্থায় ৮ ঘণ্টার শ্রমদিবসকে ১২ ঘণ্টায় নিয়ে যাওয়া, সমস্ত রাজ্যগুলোকে অন্তত এক বছরের জন্য ন্যূনতম মজুরি সংশোধন না করা (অর্থাৎ মজুরি ফ্রিজ করা), লকডাউন পর্যায়ে সমস্ত শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি প্রদানের যে নির্দেশনামা বা অ্যাডভাইজারি জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইন বলে করা হয় তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা এবং এবং গোটা পর্যায়ের মজুরির বদলে এপ্রিল-মে মাসে তা লে অফ হিসাবে মান্যতা দেওয়া হোক। সরকারের কাছে উচ্চগ্রামে এই আব্দার ও করা হয়, অবিলম্বে শ্রমিকদের কাজে ফিরে আসার জন্য প্রশাসনিক নির্দেশ যেন জারি করা হয়। আর শ্রমিকরা তা পালন না করলে তার পরিণতির জন্য যেন তারা প্রস্তুত থাকেন। তারা দাবি তোলেন, জাতীয় বিপর্যয় আইনের বদলে এবার থেকে শিল্পগুলোকে চলতে দেওয়া হোক শিল্প – শ্রম আইনের অধীনে। শ্রম আইনকে ঠান্ডা ঘরে পাঠানোর পেছনে বনিক সংগঠন ও কেন্দ্রীয় সরকারের একই যুক্তি – অতিমারীর পর ভেঙে পড়া আর্থিক ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন এবং ব্যবসা ও বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে এটা নাকি অপরিহার্য এক পূর্বশর্ত।
দিল্লি মসনদের নীতিকারদের একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে, যে কোভিড-১৯-এর পর বহুজাতিক সংস্থাগুলো নাকি চীনে তার পাত্তারি গুটিয়ে চলে আসবে ভারতে। তাই, বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠলে তো সোনায় সোহাগা। সংবাদ মাধ্যমে একটা খবর প্রকাশিত হয় যে, কোনো এক প্রথম সারির জাপানি বহুজাতিক সংস্থা নাকি যোগী সরকারের এক উচ্চপদস্থ আমলা কে জিজ্ঞেস করেন, চীন থেকে সরে এসে তারা যদি এখানে বিনিয়োগ করেন, তবে কি কি বাড়তি সুযোগসুবিধা সরকার তাদের দেবে। তারপর থেকেই নাকি উত্তরপ্রদেশে শ্রম আইন বদলানোর একটা হিড়িক পড়ে যায়। মোদীর মেক ইন ইন্ডিয়ার পেছনেও ওই একই ভাবনা ছিল। ভারতের তুলনায় চিনের মজুরি বেশি, তাই, চীন থেকে উৎপাদন শিল্পগুলো ভারতে চলে আসবে -- এমন একটা খোয়াব মোদীর আমলাকূল দেখেছিলেন। পরবর্তীতে তা যে কতখানি ভ্রান্ত তা প্রকট হয়ে ওঠে। এমনকি ভিয়েৎনাম-বাংলাদেশে কিছু শিল্প (যেমন পোষাক - বস্ত্র) গেলেও তা এদেশের সীমানা মাড়ায়নি। এই সমস্ত অতি পন্ডিত লোকজনেরা ভুলে যান যে, বিশ্বব্যাঙ্কের বহু আলোচিত সমীক্ষাই দেখিয়েছে, শিল্প স্থাপনের জন্য নিয়োগ কর্তারা যে সমস্ত অনুকূল পরিবেশগুলোও খোঁজেন, সেখানে শিথিল শ্রম আইন রয়েছে পঞ্চম স্থানে। তা সত্ত্বেও নীতি আয়োগের প্রধান অমিতাভ কান্ত তার পূর্বোলিখিত লেখায় প্রস্তাব দিয়েছেন, আগামী তিন বছরের জন্য সমস্ত শ্রম আইন বাতিল থাকুক, তুলে দেওয়া হোক ছাঁটাই-লে অফ-ক্লোজারের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছ থেকে আগাম অনুমতি নেওয়ার শর্ত, আর আগাম অনুমতির জন্য বর্তমানে যে সংখ্যাটি ১০০ রয়েছে, তা ১০০০ করা হোক।
ভারতের প্রথম সারির আই টি সংস্থার কর্ণধার আজিম প্রেমজি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “এটা খুবই দুঃখজনক যে বেশ কিছু রাজ্য সরকার, ব্যবসায়ী মহলের সুপারিশে সেই সমস্ত শ্রম আইনকে তুলে দিচ্ছে যেগুলো শ্রমিকদের সুরক্ষিত করে। ... বিগত কয়েক দশক ধরে আইনগুলো এতটাই পাল্টেছে যে এখন আর সেগুলো শিল্পের কাছে মাথাব্যথার কারণ হয়ে নেই। ইতিমধ্যেই শিথিল হওয়া আইনগুলোকে শিথিলতর করলে তা আর্থিক কর্মকাণ্ডকে গতি দেবে না, উল্টে তা নিম্ন আয়সম্পন্ন শ্রমিক ও গরিবদের অবস্থাকে আরো সংকটাপন্ন করে তুলবে। শ্রমজীবী মানুষদের ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর এই যে প্রকরণ, তা রীতিমতো এক ভুল পদক্ষেপ।” বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর যে আচরণ করা হয়েছে, তাকে তিনি অন্যায্য আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “এটা শ্রম ও ব্যবসার মধ্যে গড়ে ওঠা সামাজিক চুক্তির মূলেই আঘাত করেছে। সেজন্য আজ শুরু হয়েছে এই নজিরবিহীন বিপরীত মুখী অভিবাসন। এই আচরণ শুধু অন্যায্যই নয় তা একেবারেই অকার্যকরী। শিল্প ও শ্রমিকদের স্বার্থ গভীর ভাবেই আন্তঃসম্পর্ক যুক্ত। বিশেষ করে, এরকম অভূতপূর্ব আর্থিক সংকটের সময়ে।”
শ্রম আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে নানা মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর্থিক পুনরুজ্জীবনের পথে শ্রম আইন সংশোধনের এই তত্ত্ব যে নেহাতই অসাড়, তা বারবারই প্রমাণিত হয়েছে। তবে এ প্রশ্নে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, আইন আদালতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে প্রশাসনিক স্তরে অর্ডিন্যান্স বা নির্দেশনামার মধ্য দিয়ে আইনসভা যে সমস্ত আইন ও বিধিগুলোকে এতোদিন অনুমোদন দিয়েছিল, আজ এক কলমের খোঁচায় প্রশাসন তা খারিজ করে দিচ্ছে নতুন কোনো আইন তৈরি না করিয়ে। মনে রাখা দরকার, শ্রম বিষয়টা যুগ্ম তালিকায় আছে বটে, কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে রাজ্যগুলো এই অজুহাতে কেন্দ্রীয় শ্রম আইনগুলোকে খারিজ করতে পারে। এরকম ঢালাও ক্ষমতা আইনসভা কিন্তু প্রশাসনকে ন্যস্ত করেনি। যে কোনো নতুন আইন যথাযথ ফোরামগুলোতে ব্যাপক আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি হতে পারে আগের কোনো আইনকে বাতিল করে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, সেখানে আইনসভার কোনো ভূমিকাই নেই। প্রশাসনই আইনসভার উপরে নিজের স্থান করে নিচ্ছে – যা ভয়ংকর এক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। করোনার এই অভূতপূর্ব সংকট জনক পরিস্থিতিতে জাতীয় বিপর্যয় আইনকে কার্যকর করে প্রশাসন তার হাতের মুঠোয় যথেচ্ছ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিচ্ছে, যখন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের সুযোগটাও নেই।
পাশাপাশি, গোটা শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে একটা পরিকল্পিত আক্রমণ এই বলে শানানো হচ্ছে যে চীন থেকে নতুন কোনো সংস্থার এদেশে বিনিয়োগ করতে আসার পথে যেন শ্রমিকশ্রেণিই দায়ী। আর, তাই এই অবাধ্য শ্রেণিটাকে শায়েস্তা করতে যে কানুনগুলো তাদের সুরক্ষা দিত, সেগুলোকে এবার কেড়ে নাও। শ্রম বিরোধ উত্থাপন ও নিরসন করার এক অত্যন্ত মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করে রাষ্ট্র শ্রমের দর কষাকষির সেই হাতিয়ারকেই ছিনিয়ে নিচ্ছে যাকে ধরে সে বাড়িয়ে নেয় নিজের শ্রেণির দরকষাকষির ক্ষমতা। বলা বাহুল্য, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা তার শতবার্ষিকীর প্রধান বার্তাই “লেবার গ্যারান্টিস” হিসাবে চিহ্নিত করেছে। তার সদস্য দেশগুলোর কাছে সে আবেদন রেখেছে, শ্রমিকদের দরকষাকষির ক্ষমতা, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, তাদের স্বার্থবাহী মজবুত আইন, সামাজিক সুরক্ষা, শোভন কাজ, কর্মস্থলে নিরাপত্তা -- এক কথায় হিউমান সেন্ট্রিক বা মানবতা কেন্দ্রীক নীতি গুলো কে সামনে আনতে। কোভিড-১৯ উত্তর পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী মানুষের উপর নেমে আসা অশেষ যন্ত্রণা ও বিপর্যয় নিরসনে ত্রিপাক্ষিক ফোরামগুলোকে মজবুত বানানো, শ্রম ও শ্রমিকদের বুনিয়াদি গণতন্ত্রকে আরও উন্নত করার নীতি ঘোষণা করেছে আইএলও।
এটা এক নির্মম সত্য, যে ভারতের বিপুল বিশাল শ্রমজীবী মানুষ কোনো ধরনের শ্রম আইনের আওতায় আসেন না। ২০১৮-১৯-এর আর্থিক সমীক্ষাই জানিয়েছে, দেশের ৯০ শতাংশ শ্রমশক্তি ইনফর্মাল। অ্যানুয়াল সার্ভে অফ ইন্ডাস্ট্রিজ (এএসআই)-এর সমীক্ষা দেখিয়েছে আমাদের দেশে মজুরির বৃদ্ধি বা ওয়েজ গ্রোথ ক্রমেই নীচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। ২০০১-০৫-এ যা ছিল ৪ শতাংশ, ২০১১-১৫-তে তা হয় ১১.৭ শতাংশ কিন্তু, ২০১৬-১৮-তে তা কমে দাঁড়ায় ৬.৫ শতাংশ হারে। এএসআই-এর তথ্য এটাও দেখিয়েছে, ২০১৭-১৮-র জিডিপিতে সংগঠিত সেক্টারের মুনাফার অংশ ছিল ৪.৪০ শতাংশ, কিন্তু জিডিপি-তে মজুরির অংশ ছিল মাত্র ১.৩০ শতাংশ। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন, যত উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ততো কমেছে শ্রমিকদের মজুরি। এটা শুধু ভারতের নয়, এটা নব্য উদারবাদী অর্থনীতির বিশ্বব্যাপী প্রবণতা। বিগত কয়েক দশক ধরে এই নব্য উদারবাদী অর্থনীতি গড়ে তুলেছে ৬ কোটি ১ লক্ষ কাজ, যার ৯২ শতাংশই ইনফর্মাল। সমস্ত শ্রমকানুন যাদের কাছে মরীচিকা মাত্র। বিশ্ব জুড়েই দেখা গেছে, জিডিপি বৃদ্ধির সাথে মজুরি বৃদ্ধির কোনো সম্পর্কই থাকছে না। আইএলও দেখিয়েছে, শ্রমের উৎপাদনশীলতার সাথে (লেবার প্রডাক্টিভিটি) মজুরি সমানুপাতিক হারে না বাড়ায় জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রে মজুরির অংশটা ক্রমাগত নিম্নগামী হয়েছে, আর বহু দেশে তা এমনকি ১৯৯০-এর আগের পর্বকাল থেকেও কমেছে। এই বৃদ্ধিকে “মজুরি হীন বৃদ্ধি” বা ওয়েজলেস গ্রোথ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে আই এল ও। ভারতের শ্রম আইন কিন্তু কোনদিনই ঠেকাতে পারলো না মজুরির এই চলমান ধ্বসকে।
ঘটনা এটা নয় যে, ভারতে অর্থনীতি গড় গড় করে এগোচ্ছিল, আর কোভিড-১৯ এসে ছারখার করে দিল সেই সাজানো বাগানকে। অতিমারীর আগে গোটা দেশটাই এক নাছোড় মন্দার কবলে পড়েছিল। সমস্ত ক্ষেত্রে আর্থিক শ্লথগতি, মুখ থুবড়ে পড়া উৎপাদন শিল্প, ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব, কৃষি ক্ষেত্রে বিরাট সংকট, রেকর্ড মাত্রায় বিদেশী পুঁজির পলায়ন (গত বছরে ১ থেকে ৪ অক্টোবর মূলধনী বাজার থেকে রেকর্ড মাত্রায় ৩, ৯২৪ কোটি টাকার বিদেশি পুঁজি দেশান্তরী হয়), ইয়েস ব্যাঙ্কের পতন, বিপুল অনাদায়ী ঋণের ভারে ঝুঁকে পড়া ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক, – দেশের অর্থনীতির নাভিশ্বাস উঠেছিল। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা না থাকাই ছিল এই আর্থিক সংকটের প্রধানতম কারণ, দেশের শ্রম আইনের কড়াকড়ি নয়। কোভিড-১৯ সেই মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিল। সেই সময় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে অর্থমন্ত্রী শিল্প মহলের জন্য ১.৫ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেন। কিন্তু তাতেও মরা গাঙে বান এলো না। ভারতের শ্রম আইনে কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের অবাধ নিয়োগকে নিয়ন্ত্রিত করার আইন থাকলেও সব কিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিনের পর দিন সরকারী-রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলোতে হু হু করে বেড়েছে কন্ট্রাক্ট শ্রমিক। ছাঁটাই বা লকআউটের বিধি নিষেধ থাকলেও গোটা দেশে ধর্মঘট নয়, বেআইনি লকআউট-ই হয়ে উঠেছে সারা দেশের প্রধান ধারা।
আজকের এই অতিমারী সৃষ্ট গণস্বাস্থ্য সংকট আর্থিক সংকটের পাশাপাশি নির্দয়ভাবে সামনে তুলে ধরলো এক বিরাট মানবিক সংকটকে। আমরা লকডাউনের হাত ধরে দেখলাম বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্মান্তিক ট্রাজেডি। আমরা দেখলাম, জাতীয় বিপর্যয় আইন কিভাবে কেড়ে নিল শ্রমিকদের নিজ ঘরে ফেরার একান্ত মৌলিক গণতান্ত্রিক আইনকে। তাঁদের পর্যাপ্ত খাদ্য, বকেয়া মজুরি, পানীয় জল, আশ্রয় স্থল, চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলো। অনাহারের জ্বালায়, চরম নিরাপত্তাহীনতার মুখে লাখে লাখে পরিযায়ী শ্রমিক যখন মাইলের পর মাইল হেঁটে ঘরে ফেরা শুরু করলেন, তখন মালিকদের সংগঠন মাঠে নামলো তাঁদের প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে। সেই আর্থিক কর্মকান্ড শুরু করার তাগিদে। প্রথমে মালিকপক্ষ ঐ অসংগঠিত বিপুল শ্রমশক্তিকে পরিত্যাগ করলো সংগঠিত ও সচেতনভাবে, তারপর এখন সংগঠিত শ্রমশক্তির কাছ থেকে সব কিছু নিঙড়ে আদায় করতে খড়কুটোর মতো যে আইনগুলোকে তাঁরা এতোদিন আঁকড়ে ছিল, সেগুলোকেই ছিনিয়ে নিতে কোমর বেঁধে নামলো।
কোভিড ১৯ দেখালো, সব কিছু থেকে রাষ্ট্রের হাত গুটিয়ে নেওয়ার ফলে কি বিরাট মাশুল গুনতে হলো গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে, গোটা দুনিয়া জুড়ে। চোখে আঙ্গুল তুলে এটাও দেখালো, সব কিছুকে বিসর্জন দিয়ে অন্ধভাবে মুনাফার পেছনে ছোটার নির্মম পরিণতি। যখন নতুন করে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে বাড়াতে আবার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর গুরুত্ব সামনে আসতে শুরু করলো তখন মোদী সরকার ফিরে গেল বেলাগাম বে সরকারীকরণ, বিরাষ্ট্রীকরণের। কয়লা, প্রতিরক্ষা তেল থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান সমস্ত ক্ষেত্রগুলোর দরজাকে ব্যক্তি পুঁজির কাছে হাটখোলা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থনীতিকে আরও গভীর সংকটের কানাগলিতে ফেলে দিল।
-- অতনু চক্রবর্তী