গত ৪ এপ্রিল, ২০২০ সালে প্রকাশিত ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণে ছাড় সংক্রান্ত সার্কুলারটি সম্পর্কে এতদিনে অনেকেই জেনেছেন। ভারতের মতো দেশে, যেখানে নিয়মিত কন্যাভ্রূণ হত্যা হয় ও লিঙ্গানুপাত ভয়াবহ, সেখানে ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণে ছাড় দেওয়া যায় নাকি? বলা বাহুল্য, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ইউএন, ইউনেস্কো ও অন্যত্র ছিঃ ছিঃ পড়ে যাবে। তাই আঙুল খানিক বেঁকানো হয়েছে। বলা হয়েছে, জুন মাস পর্যন্ত, করোনা-পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যস্ততার কারণে, আল্ট্রাসাউন্ডে যে ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ হচ্ছে না, সে সংক্রান্ত নথি জমা করতে হবে না।
ভ্রূণের আল্ট্রাসাউন্ড করতে গেলে কিছু ফর্ম ফিল আপ করতে হয়। নিশ্চিত করা হয় যে মা জানেন, কী হতে চলেছে। নিশ্চিত করা হয় যে কোনওভাবে ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ করা হচ্ছে না। এই ফর্মগুলি ফিল আপ করতে কিছুটা সময় খরচ হয়। ওয়ার্ক ফোর্স কম থাকলে সময় লাগবে আরও বেশি। সুতরাং ফর্ম ফিল আপ আর বাধ্যতামূলক থাকবে না ৩০শে জুন অবধি৷ এপ্রিল, মে, জুন, তিন মাস।
আপাতদৃষ্টিতে হয়ত মনে হচ্ছে জরুরি একটি আপৎকালীন সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাস্তবে, এই তিন মাস লিঙ্গ-নির্ধারণ ও সেই অনুযায়ী গর্ভপাতের পোয়াবারো। বলে রাখা ভালো, মোটামুটি ১০ মিলিয়ন কন্যাভ্রূণ দু-দশকে ভারতে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করা হয়, ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ বিরোধী কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও। আর এদেশে প্রতি ১২ মিলিয়নে ১ মিলিয়ন মেয়ে জন্মালেও এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায় বা তাদের মেরে ফেলা হয়। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ সংক্রান্ত বে-আইনি চক্রও এদেশে যথেষ্ট সক্রিয়। রাজস্থানের অখ্যাত গাঁয়ের মানুষটিও জানেন, শহরের কোন নির্দিষ্ট সেন্টারটিতে গেলে বে-আইনিভাবে ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ করা যাবে৷ গ্লোবাল অ্যাভারেজের চেয়ে ভারতে রোজ সাত হাজার মেয়ে কম জন্মায়।
প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লিঙ্গ-নির্বাচনের আরও নানা পদ্ধতি বেরিয়েছে। যেমন ইন ভিটরো ফার্টিলাইজেশন, প্রি-ইমপ্লান্টেশন জেনেটিক ডায়াগনোসিস ও প্রি-ইমপ্লান্টেশন জেনেটিক স্ক্রিনিং, স্পার্ম-সর্টিং। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসেছে মোবাইল সেক্স সিলেকশন ক্লিনিক, যারা পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামে গ্রামে। ধনীরা হুশ করে থাইল্যান্ড-এ উড়ে গিয়ে লিঙ্গ-নির্ধারণ করিয়ে আনছেন, কারণ সেখানে তা নিষিদ্ধ নয়। আরও বেশি রেস্ত থাকলে যাচ্ছেন আমেরিকায়।
হরিয়ানার নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী যখন কাশ্মীর-সংক্রান্ত ৩৭০ ধারা খারিজ হওয়ার পর হরিয়ানভি ভাই-বেরাদরদের কাশ্মীরী মেয়ে এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তখন সেই প্রতিশ্রুতিতে ‘কাশ্মীরী’ বিশেষণটি আমাদের নজরে পড়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম, কাশ্মীরী-তনয়াদের চূড়ান্ত অবজেক্টিফিকেশন! ঠিকই। কিন্তু সমস্যাটির আরও একটি পরত আছে। আসলে হরিয়ানায় বিবাহের জন্য বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে সত্যিই মেয়ের বড় আকাল। তাই ‘বউ আমদানি করা’ ভোট-লোভীদের একটি প্রচলিত আশ্বাস। এভাবে চলতে থাকলে ‘মাত্রুভূমির’ ডিস্টোপিয়া ঘনিয়ে আসা অসম্ভব নয়৷
হরিয়ানার জিন্দ জেলার বিবিপুর গ্রামের উদাহরণ দেওয়া যাক। গোটা জিন্দ জেলাতেই ১০০০ জন ছেলে পিছু ৮৭০ জন মাত্র মেয়ে (২০১১ জনগণনা অনুযায়ী)। তাই পশ্চিমবঙ্গ বা বিহারের দরিদ্র এলাকা থেকে বউ আমদানি হয় এখানে। এমনকী কেরল থেকেও বধূ আসে৷ বিবিপুরেও তেমনই ব্যবস্থা। যে মেয়েদের অন্য রাজ্য থেকে বিয়ে করে আনা হয়, তাদের সংসারে প্রায় ক্রীতদাসীর দশা। বিদেশী বউ-এর নাম এখানে ‘পারোস’৷ তারা না এখানকার ভাষা বোঝে, না বোঝে রীতিনীতি। তাদের পারিবারিক সম্পদে কোনও অধিকার নেই। বরের (কখনও কখনও শ্বশুরবাড়ির অন্য পুরুষদেরও) যৌন সম্ভোগের উপকরণ হয়ে ওঠা, বাচ্চা বিয়োনো, আর উদায়স্ত খেটে চলা — এভাবেই এদের দিন কাটে। ‘অ্যাকশন এইড ইন্ডিয়া’ এই আমদানি-কৃত বধূদের নিয়ে সুদীর্ঘ কাল কাজ করেছে। বিবিপুর এমন এক গ্রাম, যেখানে বউ আমদানি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট জেতেন সরকার। এখানকার অন্যতম সংগঠনের নাম ‘কুঁয়ারা ইউনিয়ন’।
অথচ এই দুর্গতির পরেও জিন্দ জেলার মানুষের মেয়েদের প্রতি মনোভাব একই থেকে গেছে৷ এই আমদানি-কৃত বধূদের পেটে কন্যাসন্তান এলে সেই সন্তানকেও মেরে ফেলা হয়। ফলে লিঙ্গানুপাতের উন্নতি ঘটে না৷ এই গ্রামে গেলেই মানুষজনের কাছে পাওয়া যায় হরিয়ানা আর রাজস্থানের সেই সব ডাক্তার ও ক্লিনিকের নাম, যেখানে বে-আইনি লিঙ্গনির্ধারণ ও গর্ভপাত দুই-ই চলে৷
ভারতবর্ষের এই লিঙ্গানুপাতিক অসাম্য কিন্তু একদিনে আসেনি। মেয়েরা রাতারাতি উধাও হয়ে যায়নি৷ দশকের পর দশক ধরে লিঙ্গনির্ধারণ করে ভ্রূণহত্যা করা হয়েছে। আজ তা প্রায় মহামারীর আকার ধারণ করেছে এদেশে৷ ইউনিসেফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বলছে, এটি পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, গুজরাট বা হিমাচল প্রদেশের সমস্যা শুধু নয়, উড়িষ্যা বা ব্যাঙ্গালোরেও বাড়ছে কন্যাভ্রূণ হত্যা। পরবর্তী জনগণনাতে শিশু-জনসংখ্যার ক্ষেত্রে পুরুষ-নারী অনুপাতের আরও অধঃপতন ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে৷
শিশুদের জনসংখ্যার তুলনা করলে দেখা যাবে, ১৯৯১ সালে ১০০০ জন ছেলে পিছু ছিল ৯৪৭ মেয়ে। ২০০১ সালের জনসংখ্যা বলছে, ১০০০ জন ছেলে পিছু আছে ৯২৭ জন মেয়ে। ১৯৯১ সাল থেকে নানা ভারতীয় জেলায় মেয়েদের সংখ্যা কমেছে আর পাঞ্জাবের জেলাগুলোতে কমেছে সবচেয়ে বেশি। মহারাষ্ট্র, গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানাতেও চাইল্ড সেক্স রেশিও-তে পঞ্চাশ সূচক অবনমন দেখা যাচ্ছে। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও লিঙ্গ-নির্ধারণ ও লিঙ্গ-নির্বাচনমূলক গর্ভপাত আজ কোটি টাকার ব্যবসা এদেশে।
গুজরাটের অপতিদার ও রাজপুতদের মধ্যে, উত্তরপ্রদেশে রাজপুত ও গুজ্জরদের মধ্যে, পাঞ্জাবের মোয়াল ব্রাহ্মণ ও খুত্রিদের মধ্যে কন্যা ভ্রূণহত্যার প্রবণতা মারাত্মক। ১৯৯০ সালে আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন আসার পর নারীবিদ্বেষে ও কন্যাভ্রূণ হত্যায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল।
Indian Ministry of Health and Family Welfare বলছে, কন্যাভ্রূণ হত্যা “has its roots in India‘s long history of strong patriarchal influence in all spheres of life.”
মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে পিতামাতাকে যৌতুক দিতে হয়। ফলে পরিবারের কাছে কন্যারা সবসময়ই বোঝা হিসেবে বিবেচিত। ভারতে গর্ভের শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ ও কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার প্রধান কারণই এই যৌতুক।
২০১১ সালের জনগণনার কালে জয়পুরের এক রিক্সাওয়ালা বলেছিলেন, তিনি গরিব মানুষ। তাই মেয়ের বিয়ের পণ দিতে অপারগ। তাঁর মতো বাড়িতে মেয়ে না হওয়াই ভাল। অথচ পণবিরোধী আইন পাশ হয়েছে সেই ১৯৬১ সালে!
শুধু নিম্নবিত্ত পরিবারেই যে মেয়ে চাওয়া হয় না, তা নয়। দিল্লির পেডিয়াট্রিশিয়ান মিতু খুরানার কথাই ধরা যাক। ২০০৫-০৬ সাল নাগাদ মিতু খুরানাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাঁর অজান্তেই তাঁর আল্ট্রাসাউন্ড করা হয়। তারপর যমজ কন্যার অস্তিত্ব জেনে তাঁকে চাপ দেওয়া হতে থাকে গর্ভপাতের জন্য। মিতু জেদ করে ২০০৫ সালে বাপের বাড়িতে চলে আসেন, মেয়েদের জন্ম দেন। পরে শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেলে শাশুড়ি তাঁর মেয়েদের একজনকে মেরে ফেলতে চায়। মিতু সময়মতো এসে পৌঁছনোয় দুধের শিশুটি বেঁচে যায়।
পুত্রসন্তানই বংশরক্ষা করে, পুত্রই মুখাগ্নি করার অধিকারী — এসব লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক ধারণাগুলোর মধ্যেই আছে কন্যাভ্রূণ হত্যার বীজ। কিছুদিন আগেও উত্তর চব্বিশ পরগণায় পুকুর থেকে উদ্ধার হয়েছে ডজন দুয়েক ভ্রূণ৷ খেতে-খামারে, নদীতে এরকম লাশ ভেসে যেতে প্রায়শই দেখা যায়৷
রক্ষণশীল পরিবারেই কন্যাভ্রূণ হত্যার ঝোঁক বেশি৷ মজার ব্যাপার, এদেশে মেয়েকে আবার ‘ঘরের লক্ষ্মী’-ও মানা হয়৷ অর্থাৎ, মেয়েদের দেবী যত সহজে ভাবা যাচ্ছে, সহমানবী হিসেবে তার বেঁচে থাকার অধিকার তত সহজে মানা যাচ্ছে না।
১৯৯৪ সালে Pre-conception and Pre-natal Diagnostic Techniques (Prohibition of Sex Selection) Act চালু হয়। ২০০৩ সালে এর বদল ঘটানো হয়, আসে Prenatal Diagnostic Techniques (Regulation and Prevention of Misuse) Act। কিন্তু কোনওটিই যথাযথ ভাবে প্রয়োগ হয়েছে কি?
এই আইন মোতাবেক রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে সুপারভাইসারি বোর্ড থাকার কথা, এক যোগ্য কর্তৃপক্ষ থাকার কথা, আর থাকার কথা সহায়ক অ্যাডভাইজারি কমিটি। প্রথমবার আইন অমান্য করলে ১০০০০ টাকা জরিমানা ও তিন বছর কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। পরের বার থেকে আরও অনেক বেশিদিন জেল ও বেশি জরিমানা হতে পারে। এই কর্তৃপক্ষ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় মেডিকাল কাউন্সিলের উপর ফরমান জারি করে এবং জন্মপূর্ব লিঙ্গ-নির্ধারণ নিষিদ্ধ করে। যে ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা এ কাজ করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কাউন্সিলকে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়। জন্মপূর্ব যে কোনও পরীক্ষা করার আগে মায়ের লিখিত অনুমতি (আঞ্চলিক ভাষায়) নিতে বলা হয়।
কিন্তু সমীক্ষায় দেখা যায়, দক্ষিণ দিল্লিতে মাত্র ৪০ শতাংশ পুরুষ ও ৩০ শতাংশ মহিলা এইসব আইনকানুন সম্পর্কে জানেন৷ তারপর লিখিত বোর্ড ঝোলানো বাধ্যতামূলক হয়৷ তা সত্ত্বেও সচেতনতা যথেষ্ট বেড়েছে কি? এমনকি যাঁরা আইনটি জানেন, তাঁদের মধ্যেও অনেকে বিশ্বাস করে, যাঁদের ছেলে জন্মায়নি, সে দম্পতি বড়ই দুর্ভাগা।
PCPNDT অ্যাক্টের উদ্দেশ্য ছিল, ১) লিঙ্গি-নির্ধারণ প্রক্রিয়া বন্ধ করা ২) লিঙ্গ-নির্বাচনমূলক গর্ভপাত আটকানো ৩) এই জাতীয় অপরাধের শাস্তি বিধান করা৷ এই আইনের ৬ নং সেকশন অনুযায়ী ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ শাস্তিযোগ্য। সেকশন ২২ বলে, ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন অবৈধ। ২৩(৩) সেকশনে বলা আছে জেনেটিক ল্যাব, জেনেটিক কাউন্সেলিং, জেনেটিক ক্লিনিক, বা কোনও ডাক্তারের সাহায্যে নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনও প্রি-ন্যাটাল ডায়গনস্টিটিক টেকনিক প্রয়োগ করা (নির্দিষ্ট কারণ ব্যতিরেকে) নিষিদ্ধ। মুম্বাই হাইকোর্টের একটি রায় এই অ্যাক্টকে আরও প্রসারিত করেছে। ঘোষণা করেছে, লিঙ্গ-নির্ধারণই এ দেশে কন্যাভ্রূণ হত্যার সমান অপরাধ৷ কারণ তা নারীর অস্তিত্বের অধিকার খর্ব করে৷
তবুও, আইনের প্রয়োগে যথেষ্ট গাফিলতি আছে। হরিয়ানার মতো সঙ্কটাপন্ন লিঙ্গানুপাতের রাজ্যে কোনও অনলাইন পোর্টালের ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত করা যায়নি, যার মাধ্যমে সরাসরি লিঙ্গ-নির্ধারণ ও গর্ভপাতের ব্যাপারে অভিযোগ জানানো যায় সত্বর, যদিও এমন পোর্টাল তৈরির আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে বহুদিন যাবৎ। ২০১৪-১৬র মধ্যে নাকি হরিয়ানায় মাত্র সাতটি লিঙ্গ-নির্ধারণের অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছিল। বলা বাহুল্য, সংখ্যাটি হাস্যকর রকমের অবাস্তব।
প্রধানমন্ত্রী ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’ কর্মসূচী ঘোষণা করেন ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারী, আন্তর্জাতিক শিশুকন্যা দিবসে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল লিঙ্গবৈষম্যের দিক থেকে প্রথম সারিতে থাকা রাজ্যগুলিতে, যে রাজ্যগুলিতে লিঙ্গ-অনুপাত অতি সঙ্কটজনক অবস্থায় পৌঁছেছে বা পৌঁছচ্ছে, সেখানে নানা জনসচেতনতামূলক কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে কন্যা-শিশুর মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করা, গর্ভকালীন লিঙ্গনির্ধারণ আটকানো, লিঙ্গভিত্তিক ভ্রূণ নির্বাচন আটকানো, শিশুকন্যাকে সযত্নে ভূমিষ্ঠ হতে দেওয়া, তার শিক্ষায় উৎসাহ-প্রদান। প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়৷ পাখির চোখ ধরা হয় উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, বিহার, দিল্লির মতো রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে।
কিন্তু সমাজকর্মী বিহার দার্ভে উদ্যোগ নিয়ে ‘রাইট টু ইনফর্মেশন অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে যে সব নথি পেলেন এবং প্রকাশ করলেন ‘সিএজি’ রিপোর্টে, তাতে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় শিশু ও নারীকল্যাণ মন্ত্রক বরাদ্দ টাকার ২০ শতাংশের বেশি উল্লিখিত রাজ্যগুলিতে পাঠাতেই পারেনি। যেটুকু টাকা পাঠানো হয়েছে খেপে খেপে, তা-ও হয়েছে আগের বছরের কাজের খতিয়ান না দেখে। প্রাথমিক বরাদ্দ ১০০ কোটি হলেও, ২০১৬-১৭ সালেই কেন্দ্র থেকে মাত্র ১৯৯৯৯ লক্ষ টাকা দেওয়া হয় ১০০টি বাছাই করা জেলার জন্য। যার মধ্যে মাত্র ৫৪৮৯ লক্ষ টাকা বিভিন্ন রাজ্যে বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পাঠানো গেছে। তার মধ্যে আবার মাত্র ১৮৬৫ লক্ষ টাকা খরচ করা গেছে বলে খবর৷ কী খাতে সেটুকুও খরচ হল, তা জানার জন্য কোনও নথি তলব করেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক। ফলে উক্ত অর্থের অনেকখানিই ব্যয় হয়েছে বিজ্ঞাপনে আর ঢক্কানিনাদে। সে বিজ্ঞাপনের ভাষা ও ভাষ্যও অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক। যেমন বহুল সমালোচিত হয়েছে এক বিজ্ঞাপনী দেওয়াল-লিখন, যা আসলে এই প্রকল্পেরই জয়গান গাইতে চেয়েছিল। ‘জন্মাতেই যদি না দাও মেয়েকে, তবে কার হাতের রুটি খাবে?’ — এই ছিল সেই দেওয়াল-লিখনের ভাষা। ‘বেটি’ ও ‘রোটি’-র ‘অবশ্যম্ভাবী’ অন্ত্যমিল সচেতন নাগরিককে হতচকিত করেছিল। বোঝা গেছিল, কন্যা-শিশুর বেঁচে থাকা ও শিক্ষার অধিকার নিয়ে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচী যাদের হাত ধরে বাস্তবায়িত হবে, তাদের নিজেদেরই সচেতনতা প্রশ্নাতীত নয়।
অডিটে দেখা যাচ্ছে, ‘বেটি বচাও ...’-এর টাকা সব থেকে কম ব্যবহৃত হয়েছে লাল কালিতে মোটা দাগে চিহ্নিত সেই বিপদসঙ্কুল রাজ্যগুলিতেই — হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, দিল্লি, উত্তরাখণ্ডে। ‘নিধি আয়োগ’-এর সমীক্ষা দেখাচ্ছে ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’-এর পরে সেক্স রেশিও-র খুব একটা উন্নতি হয়নি এইসব জায়গায়। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’ দেখাচ্ছে, এই রাজ্যগুলিতে শিশুর প্রতি অপরাধ-অত্যাচারও কমেনি। নারী-শিক্ষার হার বেড়েছে, তবে খুব সামান্য, গড়ে ১ শতাংশ মতো৷
পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে কন্যাভ্রুণ হত্যা আটকানো যাবে না। এমনকী সরকারী মুখপাত্ররাও যদি বেটির রুটি বানানো নিয়ে দেওয়াল লেখেন, এমনকি স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকরাও যদি পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বেরোতে না পারেন এবং লিঙ্গ-নির্ধারণে সাহায্য করেন, তবে সাধারণ মানুষের আর দোষ কী? আবার অন্যদিকে, কন্যাভ্রূণ হত্যাই পিতৃতন্ত্রকেও চিরস্থায়ী করে। মেয়েদের সংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে বাড়তে থাকে যৌন হিংসা। বাড়ে ট্র্যাফিকিং ও নারী পণ্যায়ন।
উপরে তথ্যনিষ্ঠভাবে ভারতে লিঙ্গ-নির্ধারণমূলক ভ্রূণহত্যার খতিয়ান দেওয়ার চেষ্টা হল মাত্র। সারা পৃথিবীতে লিঙ্গানুপাতে অসাম্যের দিক থেকে ভারতের স্থান চতুর্থ।
‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্পের হোতাদের এইসব সরল তথ্য ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ফর্ম ফিল আপে যেটুকু ‘অসুবিধে’ এই কোভিড-ঊনিশ-আক্রান্ত সময়ে, তার চেয়ে ফর্ম ফিল আপ বন্ধ হলে অসুবিধে বা ক্ষতির আশঙ্কা অনেক বেশি৷ বিকল্পও হয়ত ছিল। শুধু ফর্ম ফিল আপ-এর জন্য প্রতি সেন্টারে একজন বা দুজন বাড়তি কর্মী রাখা যেত। অনেক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী কিন্তু নিজেরাই প্রশ্ন তুলছেন যে সব কিছুর আগে, স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেখার আগে, এই ‘সুবিধে’-টি করে দেওয়ার জন্য সরকার এত উদগ্রীব কেন? তিনমাস পরে সেক্স রেশিও আরও বিসদৃশ হয়ে উঠতে পারে৷ এ সম্ভাবনা সরকারের মাথায় আসেনি, এমনটা অসম্ভব ঠেকছে। তাহলে? এ কি ইচ্ছাকৃত শৈথিল্য? নাকি এ উদাসীনতা, সমস্যার গুরুত্ব বোঝার ব্যর্থতা?
দুটির কোনওটিই অভিপ্রেত ছিল না৷
(লেখাটি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম নামক ই-ম্যাগাজিন থেকে গৃহীত)